সেভেন রিংস সিমেন্ট ফ্যাক্টরি ফসলি জমিতে, নদীর পাড় দখল করে সম্প্রসারণ

গাজীপুর কণ্ঠ ডেস্ক : কালীগঞ্জ উপজেলার চরমিরপুর গ্রামে ফসলি শ্রেণীর প্রায় ৮৩ একর জমির ওপর বৃহৎ কারখানা গড়ে তুলেছে সেভেন সার্কেল গ্রুপের প্রতিষ্ঠান সেভেন রিংস সিমেন্ট। এরপর দখলে নিয়েছে কারখানার পেছনের অংশে শীতলক্ষ্যা তীরবর্তী প্রায় পাঁচ একর জমি। দখল করা নদীর জমিতে বালি ভরাট করে বিভিন্ন ধরনের স্থাপনাও নির্মাণ করেছে প্রতিষ্ঠানটি। স্থানীয় ভূমি অফিসের জরিপেই এ তথ্য দেয়া হয়েছে। সরেজমিন পরিদর্শনেও এর সত্যতা পাওয়া গেছে।
অবৈধভাবে সরকারি সম্পত্তি দখলে রাখা বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের তালিকা করেছে কালীগঞ্জ উপজেলা ভূমি অফিস। টানা কয়েক দিন জরিপ চালিয়ে তৈরি প্রতিবেদন সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসক, নদী কমিশন ও বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) কাছে পাঠিয়েছে ভূমি অফিস।
ভূমি অফিসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কালীগঞ্জ উপজেলার চরমিরপুর মৌজায় শীতলক্ষ্যা নদীর তীরবর্তী জমি দখল করেছে সেভেন রিংস সিমেন্ট। পরবর্তী সময়ে সেখানে ভবন নির্মাণ করেছে প্রতিষ্ঠানটি। পাশাপাশি নদীতে চারটি ক্রেনও রেখেছে তারা।
কালীগঞ্জ পৌরসভার চরমিরপুর মৌজায় আনুমানিক ৮০ একর ফসলি জমিতে গড়ে উঠেছে সেভেন রিংস সিমেন্ট কারখানাটি। এর বাইরে প্রতিষ্ঠানটির দখলে রয়েছে শীতলক্ষ্যা নদীর তীরের জমি, যার বেশির ভাগই শিকস্তি ভূমি হিসেবে রেকর্ডভুক্ত। আরো প্রায় দুই একর নদীর জমি দখল করে ভরাট করেছে প্রতিষ্ঠানটি। পাশাপাশি সেভেন রিংস সিমেন্টের দখলে রয়েছে ‘খ’ তফসিল গেজেটভুক্ত প্রায় আট একর অর্পিত সম্পত্তি।
অন্যদিকে ‘ক’ তফসিল গেজেটভুক্ত চরমিরপুর মৌজার অর্পিত সম্পত্তির (কেস নথি নং ১৪৮/৬৭ এবং ১৬১/৭৫) ২ একর ৬১ শতাংশ জমি লিজ নেয়া হয়েছে কোম্পানিটির নামে। যদিও আইন অনুযায়ী ফসলি বা নামা শ্রেণীর জমি কেবল মাছ চাষ বা চাষের ক্ষেত্রে ব্যবহার হওয়ার কথা। কিন্তু সেভেন রিংস ফসলি জমি ইজারা নিয়ে সেখানে কারখানা স্থাপন করেছে।
কালীগঞ্জ খেয়াঘাট থেকে নৌকা নিয়ে ঘোড়াশাল ব্রিজে যেতে হাতের বাম পাশে সেভেন রিংস সিমেন্টের বিশাল কারখানা। নদীর পাড়ে নির্দিষ্ট জায়গা রেখে শিল্প-কারখানা গড়ে তোলার শর্ত থাকলেও প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে তা মানা হয়নি। কালীগঞ্জ-ঘোড়াশাল সড়কের পাশে নিজেদের কেনা ফসলি শ্রেণীর জমিতে প্রথমে কারখানাটি স্থাপন করা হয়। এরপর পর্যায়ক্রমে তারা নদীর দিকে নিজেদের সীমানা বড় করেছে।
দখলের বিষয়ে জানতে চাইলে সেভেন সার্কেল গ্রুপের অ্যাডভাইজার (এস্টেট) আবুল কালাম আজাদ বলেন, ১৯৯৯ সালে কালীগঞ্জের চরমিরপুর মৌজায় একটি ইটভাটার ও স্থানীয়দের কাছ থেকে ২৫০ বিঘা জমি ক্রয় করে সেখানে কারখানা স্থাপন করা হয়। পুরো জমিটিই ফসলি শ্রেণীর হলেও সেখানে নদীর বা সরকারি কোনো সম্পত্তি নেই।
সরেজমিন দেখা যায়, ব্যক্তি ও শিল্প-কারখানার দখলে এমনিতেই সংকুচিত হয়ে পড়ছে শীতলক্ষ্যা। কালীগঞ্জের ঘোড়াশালে এসে আরো সংকুচিত হয়েছে। সংকুচিত হয়ে আসা নদীর এ অংশে চারটি ক্রেন ও সারি সারি জাহাজ নোঙর করে রেখেছে সেভেন রিংস। ফলে শীতলক্ষ্যা দিয়ে চলাচলকারী অন্যান্য ছোট-বড় নৌযানকে নদীপথে চলতে বেশ বেগ পেতে হয়। ছোট নৌকাগুলো চলতে পারলেও বড় নৌযানকে সমস্যায় পড়তে হয়।
জানতে চাইলে আবুল কালাম আজাদ এ প্রসঙ্গে বলেন, আমাদের তিনটি ক্রেনের অনুমতি রয়েছে। যখন বাড়তি অর্ডার থাকে, তখন নদীতে অতিরিক্ত ক্রেন দিয়ে দ্রুত জাহাজে পণ্য লোড ও আনলোড করা হয়।
সেভেন রিংসের কারখানাসংলগ্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, কারখানার পেছনের অংশটি কিছুটা ইউ আকৃতিতে নদীর ভেতরে চলে গেছে। সেখানে নতুন করে আরো একটি ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে।
কালীগঞ্জের সহকারী কমিশনার (ভূমি) মোহাম্মদ জুবের আলম বলেন, শীতলক্ষ্যা পাড়ের অধিকাংশ শিল্পপ্রতিষ্ঠানই কালীগঞ্জ-ঘোড়াশাল সড়কের পাশে জমি কিনে গড়ে উঠেছে। পরবর্তী সময়ে প্রতিষ্ঠানগুলো নদীর পাড় দখল করে তাদের কারখানা বিস্তৃত করেছে। সেভেন রিংসও সেখানে নদীর জমি দখল করেছে।
ব্যক্তিমালিকানাধীন ২৫০ বিঘা জমি কিনে কারখানা স্থাপন করার যে দাবি সেভেন রিংসের পক্ষ থেকে করা হয়েছে, তা নিয়েও সন্দেহ পোষণ করেন এ কর্মকর্তা। তিনি বলেন, মনে হয় না ব্যক্তিশ্রেণীর জমি এত হবে! আমরা জরিপের সময়ও সেখানে সরকারি অনেক সম্পত্তি পেয়েছি, যেগুলো দখলমুক্ত করার জন্য এরই মধ্যে সংশ্লিষ্ট সব দপ্তরকে অবহিত করা হয়েছে। দ্রুতই অবৈধ দখলে থাকা এসব সরকারি সম্পত্তি উদ্ধারে বিশেষ অভিযান পরিচালনা করা হবে।
দখলের পাশাপাশি প্রতিনিয়ত দূষণও হচ্ছে শীতলক্ষ্যার। শীতলক্ষ্যার চরমিরপুর অংশে সেভেন রিংসের কারখানার সামনের প্রায় পাঁচ কিলোমিটার অংশে শিল্পবর্জ্য ও পোড়া ডিজেলের দূষণে কালচে রঙ ধারণ করেছে পানি। নদীর পানিতে ভাসতে দেখা যায় পোড়া ডিজেল ও মবিলের স্তর।
নদী রক্ষায় স্থানীয়ভাবে কাজ করে যাচ্ছে স্বেচ্ছাসেবক সংগঠন বাংলাদেশ নদী পরিব্রাজক দল। সংগঠনের সভাপতি ও নদী গবেষক মনির হোসেন বলেন, শীতলক্ষ্যা নদীর কালীগঞ্জ খেয়াঘাট থেকে ঘোড়াশাল ব্রিজ পর্যন্ত অংশটি দখল ও দূষণে বিপন্নপ্রায়। ব্যক্তি উদ্যোগের পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের প্রতিষ্ঠানও নিয়মিত নদী দখল ও দূষণ করছে। সেভেন রিংস সিমেন্টও রয়েছে এর মধ্যে। প্রতিষ্ঠানটি তাদের নির্ধারিত জায়গার বাইরে গিয়ে নদীর জমিতে স্থাপনা নির্মাণ করেছে। তাদের দূষিত বর্জ্যও নদীতে ফেলছে।
এ সংক্রান্ত আরো জানতে…….
কালীগঞ্জে চার কোম্পানির দখলে ‘শীতলক্ষ্যার ১৫ একর জমি’, উদ্ধারের দায়িত্ব নিচ্ছে না কেউ!
কালীগঞ্জে শীতলক্ষ্যার ৩ একর জমি ভরসা গ্রুপের দখলে
সূত্র: বণিক বার্তা