টঙ্গীর শ্রমিক লীগ নেতা মতির এত সম্পদ!

গাজীপুর কণ্ঠ ডেস্ক : টঙ্গীর অতি পরিচিত নাম বিকম মতি। পুরো নাম মতিউর রহমান। শ্রমিক লীগ টঙ্গী আঞ্চলিক শাখার সভাপতি তিনি। আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক ক্ষমতা তাঁকে ধনে-মানে, ক্ষমতায় কানায় কানায় পূর্ণ করে দিয়েছে। শ্রমিক নেতা হলেও ব্যবহার করেন একাধিক বিলাসবহুল গাড়ি। টঙ্গীতে রয়েছে তাঁর একাধিক গগনচুম্বী অট্টালিকা। নামে-বেনামে রয়েছে বিপুল ভূসম্পদ। টঙ্গীর বিসিক শিল্প মালিকদের কাছে এক জলজ্যান্ত ত্রাসের নাম বিকম মতি। বিসিক এলাকা দাবড়ে বেড়ায় তাঁর নিজস্ব সন্ত্রাসী বাহিনী। ওই সন্ত্রাসী বাহিনীর কাছে জিম্মি শিল্প মালিকরা।

টঙ্গী বিসিক শিল্পনগরীর একজন শিল্প মালিক নাম প্রকাশ না করে বলেন, ‘মাঝেমধ্যে অদ্ভুত ফোন আসে। অন্য প্রান্ত থেকে শীতল কণ্ঠে বলা হয়, মতি চাচা বলছি। একটি বড় কর্মসূচি আছে। লাখ পাঁচেক টাকা দিয়েন। লোক পাঠাচ্ছি।’ আবার কখনো একই ভঙ্গিতে শীতল কণ্ঠে বলেন, ‘কারখানার ওয়েস্টেজগুলো আমার ছেলেদের দিয়েন। অন্য কাউরে দিলে ঝামেলার দায় কিন্তু আমি নিতে পারুম না।’ তাঁর এসব শীতল কণ্ঠের ত্রাসের নির্দেশ দু-একবার অমান্য করে নানাভাবে নাজেহাল হয়েছেন অনেক শিল্প মালিক।

শৈশব-কৈশোর-যৌবনের বড় একটা অংশ অতি দারিদ্র্যের মধ্যে কাটে বিকম মতির। টঙ্গী বিসিক শিল্পনগরীতে রাষ্ট্রায়ত্ত অলিম্পিয়া টেক্সটাইল মিল লিমিটেডে কেরানি হিসেবে চাকরিজীবন শুরু। এরশাদ যখন ক্ষমতায় টঙ্গীর রাজাধিরাজ তখন সরকার পরিবার। ওই পরিবারের রাজনৈতিক কর্তা হাসানউদ্দিন সরকারের ঘনিষ্ঠ হয়ে কেরানি থেকে বিকম মতি হয়ে যান নিউ অলিম্পিয়া টেক্সটাইল মিলের সিবিএ নেতা। এরশাদের পতনের পর ভোল পাল্টে ভিড়তে থাকেন আওয়ামী লীগে। শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লীগের অঙ্গসংগঠন জাতীয় শ্রমিক লীগ টঙ্গী আঞ্চলিক কমিটির সভাপতির পদ বাগিয়ে নেন। এর পরই টঙ্গীতে অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠেন বিকম মতি।

অব্যাহত লোকসানের কারণে ২০০১ সালে ৯টি বস্ত্রকল শ্রমিক মালিকানায় হস্তান্তর করা হয়। এর মধ্যে একটি টঙ্গীর নিউ অলিম্পিয়া টেক্সটাইল মিলস। শ্রমিক মালিকানায় কারখানা হস্তান্তরের শর্ত ছিল, শ্রমিকরা কারখানায় উৎপাদন করে নিজেদের বেতনের ব্যবস্থা করবেন এবং দীর্ঘ মেয়াদে মিলের বকেয়া ঋণ পরিশোধ করবেন। তবে উৎপাদন অব্যাহত রাখতে হবে। ওই সময় টঙ্গীর নিউ অলিম্পিয়া টেক্সটাইলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিয়োগ করা হয় সিবিএ নেতা মতিউর রহমান ওরফে বিকম মতিকে। ২০১৭ সালে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রী ইমাজউদ্দিন প্রামাণিকের সময় প্রস্তুত করা এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, প্রায় ২৫০ একর জমির ওপর নির্মিত নিউ অলিম্পিয়া টেক্সটাইল মিলটি বন্ধপ্রায়। কাজ করছেন মাত্র ১১৮ জন শ্রমিক। ২০০১ সাল থেকে বর্তমান পর্যন্ত সরকারকে ঋণের কোনো কিস্তি পরিশোধ করা হয়নি।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, বাস্তবে নিউ অলিম্পিয়া টেক্সটাইল মিলে কাপড় রং করার ক্ষুদ্র একটি অংশ চালু আছে। নামমাত্র অর্থে ওই অংশটি ভাড়া দেওয়া হয়েছে বিকম মতির ছেলে নয়নকে। কারখানার বাকি অংশের উৎপাদন বন্ধ রেখে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছে ভাড়া দেওয়া হয়েছে গুদাম হিসেবে। ওই ভাড়া তোলেন বিকম মতি। শেয়ারহোল্ডার শ্রমিকদের বার্ষিক সভায় এসবের হিসাব উত্থাপন করা হয় না বলে জানিয়েছেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক শ্রমিক শেয়ারহোল্ডার। তাঁরা বলেন, বাস্তবে মিলটি লুটপাট করে খাচ্ছেন বিকম মতি। আমাদের প্রতিবাদ করার সাহস নেই। এখানে রয়েছে তাঁর বিশাল সন্ত্রাসী বাহিনী।

সরেজমিনে গিয়ে আরো দেখা গেছে, লোপাট করা হয়েছে মিলের গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্রাংশ। অবশিষ্ট যা আছে, মরিচা ধরে খসে পড়ছে। মিলটি তিলে তিলে ধ্বংস হতে থাকলেও ক্রমাগত বাড়ছে বিকম মতির সম্পদ।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, টঙ্গীর মধুমিতা লেভেলক্রসিং পেরিয়ে ১০০ গজ উত্তরে এগোলে রয়েছে চার ইউনিটের ১০ তলা একটি ভবন। নাম ‘মতিমহল’। এই মতিমহলের মালিক বিকম মতি। ওই ভবন থেকে কয়েক শ গজ সামনে এগোলে আরিচপুর এলাকায় রয়েছে তাঁর আরেকটি বাড়ি। বাড়িগুলোতে বাস করছে ভাড়াটিয়ারা। বিকম মতি টঙ্গীতে বাস করেন না। তিনি বাস করেন উত্তরায়।

আরিচপুর এলাকায় পাশাপাশি মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে তিনটি ১২ তলা ভবন। ভবন তিনটির নির্মাণকাজ শেষে এখন চলছে রং করার কাজ। তিনটি ভবনেরই সামনে ঝোলানো সাইনবোর্ডে রয়েছে সাতজন অংশীদারের নাম। এসব নামের মধ্যে বিকম মতির নামও রয়েছে। স্থানীয় বাসিন্দা আবু বকর সিদ্দিক বলেন, ‘এ ভবন তিনটি আসলে বিকম মতির। প্রশাসনকে ধোঁকা দিতে অন্য সদস্যদের নাম সাইনবোর্ডে লেখা হয়েছে।’

কোনাবাড়ীতে রয়েছে বিকম মতির ১৩০ কাঠা জমি।

বিকম মতি নিজে আওয়ামী লীগ নেতা হলেও নিউ অলিম্পিয়া মিল লুটপাটে অংশীদার করেছেন স্থানীয় বিএনপি নেতাদের। মিলের উপদেষ্টা করা হয়েছে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে গাজীপুর-২ আসনে বিএনপির প্রার্থী সালাউদ্দিন সরকারকে। পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান করা হয়েছে টঙ্গী থানা বিএনপির সহসভাপতি আবুল হাশেমকে।

নিউ অলিম্পিয়া টেক্সটাইল মিল গ্রাস করেই ক্ষান্ত হননি বিকম মতি। সন্ত্রাসী বাহিনী এবং দলের পদবি ব্যবহার করে নিজের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছেন টঙ্গী বিসিক এলাকায়। টঙ্গী বিসিক শিল্পনগরীর ঝুট ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ, শ্রমিক অসন্তোষ বাধিয়ে মালিকদের কাছ থেকে সুবিধা নেওয়া, শিল্প মালিক সমিতি দখল, চাঁদাবাজি—সব কিছুই বিকম মতির নিয়ন্ত্রণে।

টঙ্গী বিসিক শিল্পনগরী এলাকায় বিকম মতির প্রায় ৫০ জনের একটি সন্ত্রাসী বাহিনী সক্রিয়। বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠানের ট্রাক বোঝাই মালামাল পর্যন্ত তারা ছিনতাই করে নেয়। ছিনিয়ে নেয় কারখানার ওয়েস্টেজ মালামাল। বাহিনীটি বিসিক এলাকায় বিকম মতির সন্ত্রাসী বাহিনী হিসেবে পরিচিত। মাঝেমধ্যে পুলিশ এই বাহিনীর কোনো সদস্যকে গ্রেপ্তার করলেও রাজনৈতিক হস্তক্ষেপে দ্রুতই ছেড়ে দেয়। ৫০ জনের সন্ত্রাসী বাহিনীর নেতৃত্ব দেন সেলিম, আলাউদ্দিন, শাহাদত ও ইস্রাফিল। গত মার্চে ডিবি পুলিশের হাতে দুটি অস্ত্রসহ গ্রেপ্তার হন সন্ত্রাসী সেলিম। সম্প্রতি জামিনে মুক্ত হয়ে তিনি আবার বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন।

এসব বিষয়ে জানতে চাইলে মতিউর রহমান ওরফে বিকম মতি বলেন, ‘দীর্ঘদিন চাকরি করার অর্থ জমিয়ে সম্পদ গড়েছি। আমি শ্রমিক মালিকানায় থাকা টঙ্গীর নিউ অলিম্পিয়া টেক্সটাইলের এমডি। কারখানাটি আংশিক চালু রয়েছে। সরকারের কোনো কিস্তি দিতে পারিনি, এ কথা ঠিক। তবে আমি মাস্তান পালি না। এ অভিযোগ সঠিক নয়। আমি রাজনীতি করি, মাস্তান পোষার প্রয়োজন হয় না। আর কোনো শিল্প মালিক আমার সামনে এসে বলতে পারবে না, তাদের আমি জিম্মি করে রেখেছি।’

 

সূত্র: কালের কণ্ঠ

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button