পদ বিক্রি বদলি বাণিজ্যে: শতকোটি টাকার মালিক কৃষক লীগের মোতাহার হোসেন মোল্লা

গাজীপুর কণ্ঠ ডেস্ক : এক সময় উপজেলা নির্বাচনে প্রার্থী হিসেবে দাঁড়ানোর মতো খরচের টাকাও তার ছিল না। সহজ-সরল জীবনযাপন ছিল তার। কিন্তু মাত্র আট বছরের ব্যবধানে শুধু পদ-বাণিজ্য ও প্রমোশন, বদলি তদবির করেই তিনি আজ শত-কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন। হাঁকিয়ে বেড়ান ৪৫ লাখ টাকার দামি গাড়ি। করেছেন নামে-বেনামে কয়েকটি বাড়ি ও ফ্ল্যাট। দলের পদ-বাণিজ্য করতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদিত ৩১১ সদস্যের কেন্দ্রীয় কমিটির তোয়াক্কা না করে নিজের ইচ্ছামতো পদ দিয়েছেন আরও প্রায় দু’শত ব্যক্তিকে। কেন্দ্র থেকে শুরু করে উপজেলা কমিটি গঠনেও নিয়েছেন ৫ লাখ থেকে ৫০ লাখ টাকা। ফলে খুব অল্প সময়ে এখন তিনি শত-কোটি টাকার মালিক। বলছিলাম কৃষক লীগ সভাপতি মোতাহার হোসেন মোল্লার কথা।
কৃষক লীগের সভাপতি হওয়ার পর থেকে যিনি কপাল ফুলে কলাগাছ হয়েছেন। কৃষক লীগ, আওয়ামী লীগ ও তার এলাকার বিভিন্ন নেতার সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
কাপাসিয়া উপজেলার এক নেতা জানান, মোতাহারের তো উপজেলা নির্বাচনে দাঁড়ানোর টাকাটাও ছিল না। আমরা কয়েকজন মিলে টাকা-পয়সা ম্যানেজ করে দিলাম। তারপর সে নমিনেশন দাখিল করল। আর আজ তার শত-কোটি টাকা। দামি গাড়িতে চড়ে বেড়ায়। দলের কাউকে সে পাত্তা দেয় না।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২০১৬ সালে কৃষক লীগের সভাপতি হন মোতাহার হোসেন মোল্লা। এর দু’বছর পর তিনি আবারও কাপাসিয়া উপজেলা নির্বাচন করেন। কিন্তু সেবার তাকে বিএনপির এক প্রার্থীর কাছে হারতে হয়। যাতে চরম ইমেজ সংকটে পড়েন এই নেতা। কিন্তু তাতে কি পদ তো আছে। তিনি সভাপতি হওয়ার পর কৃষক লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির ৩১১ সদস্য অনুমোদিত থাকার পরও বিভিন্ন শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীকে কেন্দ্রীয় বিভিন্ন পদ দিতে থাকেন। সর্বশেষ কলাবাগান থানার ফিরোজ ক্যাসিনো কাণ্ডে গ্রেফতারের সময় নিজেকে কৃষক লীগের কেন্দ্রীয় নেতা হিসেবে দাবি করেন। সে সময় তিনি একটি কৃষক লীগের নিয়োগপত্র দেখান। যাতে লেখা ছিল, তাকে কৃষক লীগের কেন্দ্রীয় সহসভাপতির পদে নিয়োগ দেওয়া হলো। বিষয়টি জানার পর দলের নেতাদের মধ্যে সমালোচনার ঝড় ওঠে। পরে তারা জানতে পারেন ফিরোজ নামে সন্ত্রাসীকে কৃষক লীগের পদ দেওয়ার জন্য মোতাহার প্রায় ২০ লাখ টাকা নিয়েছেন। কেন্দ্রীয় নেতারা মোতাহারের কাছে জবাব চাইলে তিনি কোনো জবাব দিতে পারেননি।
কৃষক লীগের এক নেতা জানান, উনি তো দলকে শেষ করে দিয়েছেন। দেশের ৭০টি জেলা, ৫০০-এর বেশি থানা ইউনিট ছাড়াও ওয়ার্ড কমিটিতে সভাপতি হওয়ার পর থেকে দু’তিনবার কমিটি দিয়েছেন। প্রতিটি জেলা-উপজেলায় কৃষক লীগের ত্যাগীদের বাদ দিয়ে বয়লার ও হাইব্রিড নেতাদের কাছে ৫ লাখ থেকে ১০ লাখ টাকা নিয়ে কমিটি দিয়েছেন। কেন্দ্রীয় কমিটির কোনো মিটিংও তিনি করতেন না। কমিটির সদস্যদের কাছে অভিযোগ এসেছে বিল্ডার্স বিশ্বাস, আপন জুয়েলার্স ও এশিয়ান টিভির মালিককে কৃষক লীগের পদ দিয়ে তিনি ৪৫ লাখ থেকে ৫০ লাখ করে টাকা নিয়েছেন। কমিটির নেতা কতজন তা জানতে চাইলে তিনি কোনো তালিকা দেখাতেন না। অথচ এসব শিল্পপতি কৃষক লীগের কেন্দ্রীয় পদে আছেন বলে দাবি করেন। সব মিলিয়ে কেন্দ্রীয় কমিটির নেতা এখন প্রায় ৩০০ জন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদিত কমিটি হলো মাত্র ৩১১ জনের। এই কমিটির বাইরেও তিনি ইচ্ছামতো লোকজন ঢুকিয়েছেন। আরেক নেতা জানান, তিনি সভাপতি হওয়ার পর থেকে কৃষক লীগের কোনো মিটিং-সভা তেমন হয় না। তিনি তার পদ-বাণিজ্য আর গণপূর্তের বিভিন্নজনের বদলি ও প্রমোশন নিয়ে ব্যস্ত। অথচ গত ৭ বছর ধরে দলে কোনো সম্মেলন হয় না। কিন্তু জেলা-উপজেলা কমিটি ঠিকই তিনি দু’তিনবার করে করেছেন। নিজের কেন্দ্রের খবর নেই। দল কী হলো সেদিকে তার কোনো চিন্তা নেই।
কেন্দ্রীয় এক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, এক সময় কৃষক লীগ কৃষকের কথাগুলো প্রধানমন্ত্রীর কাছে তুলে ধরত। কিন্তু তিনি সভাপতি হওয়ার পর থেকে তা থমকে গেছে। আগে তামাক লীগ, ইক্ষু লীগসহ ফসলভিত্তিক কৃষকের কথাগুলো কৃষক লীগ তুলে ধরত, আন্দোলন করত কিন্তু এখন কৃষক লীগ মানুষের কাছে হাসির পাত্র হয়ে গেছে। একটি কেন্দ্রীয় কমিটির কি ৩০০ নেতা থাকে, দলে এ নিয়ে ব্যাপক হাসিঠাট্টা হয়। দলের এক ভাইস প্রেসিডেন্ট ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, কৃষক লীগ আর কৃষক লীগ নেই। কৃষকের মধ্যে থাকার কথা ছিল; কিন্তু তারা এখন আলোচনাতেও নেই। কৃষকের কোনো দাবি ও কৃষকের পক্ষে কথা বলতে পারেন না তাহলে কিসের কৃষক লীগ?
উনি সভাপতি হওয়ার পর থেকে কৃষকবান্ধব কোনো কর্মসূচি পাইনি। কৃষক লীগ তো এখন গঠনতন্ত্র অনুযায়ী চলে না, তার দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকে সাত বছরে কার্যনির্বাহী পরিষদ কমিটির কোনো সভা নোটিসে হয়েছে বলে আমার জানা নেই।
এছাড়াও দলের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী ২৩ জন ভাইস প্রেসিডেন্ট থাকার কথা থাকলেও এর বাইরে আরও আছে। তিনি টাকা নিয়ে দলে কিছু শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীকে পদ দিয়েছেন, এটা তো সত্য। কেন্দ্রীয় পদের বাইরে যারা পদ নিয়েছেন তারা মাঝেমধ্যে আসেন, এসব বিষয় নিয়ে দলের অন্য নেতাদের মধ্যে চরম অসন্তুষ্টি আছে। তাকে বললেই সে বলে, দল চালানোর জন্যই এসব করেছি। টাকা না থাকলে দল চালাব কী করে? মোতাহার কিছু কাজ একা একা করতে গিয়েই ধরা খেয়েছে। তাছাড়া তার পেছনে কিছু লোকজনও আছে, যারা তাকে ভুলপথে পরিচালিত করছে বলেও যোগ করেন ওই নেতা।
এসব ব্যাপারে মোতাহার হোসেন মোল্লাকে কয়েকদফা ফোন করা হলে তাকে পাওয়া যায়নি।
আরো জানতে….
টঙ্গীর শ্রমিক লীগ নেতা মতির এত সম্পদ!