মানুষের আস্থা বেড়েছে ৯৯৯-এ
গাজীপুর কণ্ঠ ডেস্ক : ঘূর্ণিঝড় ‘বুলবুল’-এর তাণ্ডবে উত্তাল মেঘনার বুকে অনিশ্চয়তার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছিলেন ৩০ শ্রমিক। বরিশালে মেঘনার মিয়ারচর নামে একটি চ্যানেল খননকাজে নিয়োজিত ছিলেন বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) খনন বিভাগের একটি খননযন্ত্রের (ড্রেজার) এই শ্রমিকেরা। ঘূর্ণিঝড়ের পূর্বাভাস জেনে শ্রমিক ও প্রকৌশলীরা খননকাজে ব্যবহৃত ছয়টি পন্টুন কিনারে নোঙর করে তাতে অবস্থান করছিলেন। রোববার দুপুরে ঘূর্ণিঝড়ের তাণ্ডবে একটি পন্টুনের নোঙর ছিঁড়ে যায়। ৩০ শ্রমিকসহ মেঘনার বুকে ভেসে যায় পন্টুনটি। আতঙ্কিত হয়ে পড়েন পন্টুনে থাকা শ্রমিকেরা। এমন ঘোর বিপদেও দিশা হারাননি এক শ্রমিক। রমজান আলী নামের ওই শ্রমিক ৯৯৯ নম্বরে ফোন দিয়ে বাঁচার আকুতি জানালেন। তখন বেলা ২টা ৫৮ মিনিট। ভয়ার্ত রমজানের আকুতি শুনে এগিয়ে আসেন পুলিশ, বিআইডব্লিউটিএ ও কোস্টগার্ডের সদস্যরা। দুই ঘণ্টার অভিযানে ৩০ শ্রমিকের সবাইকে জীবিত উদ্ধার করা হয়।
বরিশালের পুলিশ সুপার সাইফুল ইসলাম বলেন, ৯৯৯-এ ফোন আসাতেই দ্রুততম সময়ের মধ্যে শ্রমিকদের উদ্ধার করা গেছে।
জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯-তে কাজ করেন এমন কর্মকর্তারা জানান, অ্যাম্বুলেন্সে দ্রুত রোগী ফেরি পারাপার, প্রাণনাশের আশঙ্কা, ধর্ষণ-সংক্রান্ত ঘটনা, গৃহকর্মী নির্যাতন, কাউকে আটকে রাখা, লিফটে আটকে পড়া, অসুস্থ হয়ে পড়ে থাকা, দুর্ঘটনা, অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা, পারিবারিক সমস্যা, শব্দদূষণ, ছিনতাইসহ নানা বিপদ থেকে উদ্ধারে মানুষকে সহযোগিতা করছেন তাঁরা।
নাগরিকের জরুরি যেকোনো প্রয়োজনে কোনো একটি মুঠোফোন থেকে ৯৯৯-এ বিনা পয়সায় ফোন করা যায়। প্রতিদিন ২৪ ঘণ্টা চালু থাকে এই সেবা। ৯৯৯ সার্ভিসের প্রশিক্ষিত কর্মীরা প্রয়োজন অনুযায়ী ফায়ার সার্ভিস, পুলিশ বা অ্যাম্বুলেন্স সেবা প্রদানকারীর সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দেন। ৯৯৯ নম্বরে কেউ ফোন করলে সমস্যার ধরন, নাম-পরিচয় ও ঠিকানা জেনে ব্যবস্থা নেওয়া হয়। যেমন কেউ পুলিশের সেবার জন্য ফোন করলে তাৎক্ষণিকভাবে ওই এলাকার সংশ্লিষ্ট থানা-পুলিশের সঙ্গে ফোনে ওই ব্যক্তিকে কথা বলিয়ে (টেলি কনফারেন্স) সহায়তার ব্যবস্থা করা হয়।
গত ১৫ অক্টোবর, দুপুর ১২টা ৮ মিনিট। জাতীয় জরুরি সেবার ৯৯৯ নম্বরে ফোন করলেন সোনিয়া। ঢাকার কেরানীগঞ্জে থাকেন তিনি। সোনিয়া জানান, তাঁর স্বামীকে মুন্সিগঞ্জ জেলগেট থেকে একদল লোক অপহরণ করে মুক্তারপুর ফেরিঘাট এলাকায় একটি বাড়িতে আটকে রেখেছে। তারা ৬ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করেছে। ৯৯৯ নম্বরে ফোন দিলে অপারেটর তাৎক্ষণিক সোনিয়াকে মুন্সিগঞ্জ থানার দায়িত্বরত পুলিশ কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলিয়ে দেন। সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে বাড়িটি চিহ্নিত করে এবং অভিযান চালায়। সেখান থেকে সোনিয়ার স্বামীকে উদ্ধার করা হয়। সঙ্গে শিপলু নামের একজনকে আটক করে পুলিশ।
সোনিয়া বলেন, পুলিশকে সরাসরি ফোন করলে হয়তো এত দ্রুত সহায়তা পেতেন না। কিন্তু ৯৯৯-এ ফোন করার ২০ মিনিটের মধ্যে পুলিশ ঘটনাস্থলে হাজির হয়। পুলিশ না গেলে হয়তো স্বামীকে ফিরেই পেতেন না। এই ফোন করতে তাঁর কোনো খরচ হয়নি। উল্টো অপারেটর ফোন করে খোঁজ নিয়েছেন, তিনি সেবা পেয়েছেন কি না।
একইভাবে গত কয়েক দিনে ৯৯৯-এ ফোন করে পুলিশের সহায়তায় থামানো হয় বাল্যবিবাহ, উদ্ধার করা হয় নিখোঁজ শিশু, বন্ধ করা হয় গাছ কাটা। যেকোনো বিপদে পড়লে, সাইবার অপরাধের শিকার হলে ৯৯৯-এ ফোন দিয়ে দ্রুত সেবা পাওয়া যায়। গত ২০ মাসে ৯৯৯ সেবায় বলার মতো এমন আরও অনেক কাহিনি জমা হয়েছে।
জাতীয় জরুরি সেবা বিভাগের প্রধান ও পুলিশের অতিরিক্ত উপমহাপরিদর্শক তবারক উল্লাহ বলেন, ৯৯৯-এ মানুষের আস্থা বেড়েছে, আর তাই চাহিদাও বেড়েছে। বেড়েছে সেবার মানও। কমে গেছে বিরক্তিকর কল আসা। আগে একজনকে সাধারণ ডায়েরি করতে হলে থানায় যেতে হতো, থানা থেকে অনেক সময় সহযোগিতা পেত না। এখন ৯৯৯-এ কল করার সঙ্গে সঙ্গে সেবা মিলছে। এটাতে জনগণ অনেক খুশি।
তিনি আরও বলেন, ‘আগে আমাদের যে সংকট ছিল, তা দূর করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, যেন কেউ কল করলেই বোঝা যায় কলার আইডি, কলার এনআইডি। সিস্টেম উন্নয়নে কাজ চলছে। এ ছাড়া ৯৯৯ সেবা ব্যবহারের নীতিমালা করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সরকার ৯৯৯ নিজস্ব অফিসের জন্য জমিও বরাদ্দ দিয়েছে। এখন বেসরকারি টেলিফোন অপারেটররা সহযোগিতা করলে আমরা আরও বেশি সহযোগিতা করতে পারব কলারদের। তবে এটা ঠিক, আমাদের অপারেটরদের প্রশিক্ষণের দরকার। অপারেটররা প্রশিক্ষণ পেলে এই সেবা আরও জনপ্রিয়তা পাবে, আরও বেশি মানুষ সহযোগিতা পাবে।’
জাতীয় জরুরি সেবা কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, গত ২০ মাসে ৯৯৯ থেকে সেবা পেতে ১ কোটি ২৯ লাখ ৭৮ হাজার ৭২৩ জন ফোন দিয়েছেন। এসব ফোনের মধ্যে প্রায় ২২ লাখ লোকই বিভিন্ন তথ্য জানতে চেয়ে কল দিয়েছেন। আর সেবা নিয়েছেন ২৬ লাখ ৮৫ হাজার ৬৪ জন। এগুলোর মধ্যে ১ লাখ ১ হাজার ১১৪টি কলই এসেছে পুলিশের সহায়তা চেয়ে। এ ছাড়া দুর্ঘটনার খবর জানাতে ও নিরাপত্তা চেয়ে এবং অ্যাম্বুলেন্সের জন্য ফোন এসেছে প্রায় ৪০ হাজার।
জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯-এর কার্যক্রম পরিচালিত হয় রাজধানীর আবদুল গণি রোডের পুলিশ কন্ট্রোল রুম থেকে। চারদিকে শুধু ফোনের ক্রিং ক্রিং শব্দ। কেমন চলছে এ সেবা, জানতে সম্প্রতি জরুরি সেবার কল সেন্টারে গিয়ে দেখা যায়, দুটি তলায় সাড়ে চার শর বেশি কর্মী কাজ করছেন। যাঁরা কল রিসিভ করেন, তাঁদের বলা হয় কলটেকার। কলটেকারদের তত্ত্বাবধান করার জন্য আছেন কয়েকজন কর্মকর্তা। দিনরাত ২৪ ঘণ্টা এখানে চার পালায় কাজ করেন তাঁরা। অ্যাম্বুলেন্স সেবার জন্য রয়েছে আলাদা ডেস্ক।
২০১৭ সালের ১২ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রীর তথ্যপ্রযুক্তিবিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয় রাজধানীর আবদুল গণি রোডে জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯-এর কার্যক্রম উদ্বোধন করেন। এখান থেকে শুধু পুলিশ নয়, জরুরি প্রয়োজনে ফায়ার সার্ভিস ও অ্যাম্বুলেন্স সেবাও পাওয়া যায়। দেশের যেকোনো প্রান্ত থেকে যে কেউ এই সেবার জন্য ফোন করতে পারেন। ৯৯৯-এ ফোন করতে কোনো খরচ নেই।
সূত্র: প্রথম আলো