দুদকের নজরে সব দপ্তর
গাজীপুর কণ্ঠ ডেস্ক : প্রতিটি সরকারি-বেসরকারি দপ্তর ২৪ ঘণ্টাই দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) গোয়েন্দা নজরদারিতে আছে। চলছে দুর্নীতিবাজদের হাতেনাতে ধরার জন্য নজরদারি ও আকস্মিক সাঁড়াশি অভিযান। এর ফলে দুর্নীতিতে জড়িতদের মধ্যে দেখা দিয়েছে দুদক আতঙ্ক।
কখন, কোথায় দুদক হানা দেয় এই ভয়ে অস্থির সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন দপ্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-কর্মচারীরাও এই আতঙ্কের বাইরে নয়। বিশেষ করে দুদকের হটলাইন ১০৬ নম্বরে কে, কখন ফোন করে কী তথ্য দিয়ে দেয় এই ভয় কাজ করছে বেশি। পাশাপাশি দুদক কর্মকর্তাদেরও কঠোর নজরদারির মধ্যে রাখা হয়েছে।
এরই মধ্যে আসামির সঙ্গে গোপন আঁতাত করায় এক পরিচালককে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। চলমান কার্যক্রমের বিষয়ে জানতে চাইলে দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ বৃহস্পতিবার বলেন, ‘প্রতিটি দপ্তর ২৪ ঘণ্টা আমাদের নজরদারিতে আছে। হটলাইনে হোক বা লিখিত অভিযোগ হোক দুর্নীতিবিরোধী প্রতিষ্ঠান হিসেবে কোনো অভিযোগই আমরা ছেড়ে দিতে পারি না। আপনারা যেটাকে অভিযান বলছেন, আমরা সেটাকে বলছি কাজ। দুদক যেসব আকস্মিক অভিযান পরিচালনা করে তাতে দেখবেন দায়ীদের গ্রেপ্তার করা হয় না বরং সতর্ক করা হয়। এসব অভিযান নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ারও কিছু নেই।’
তিনি বলেন, ‘দুর্নীতি দমনে নতুন সরকারের রাজনৈতিক অঙ্গীকার আমাদের আত্মবিশ্বাসী করে তুলেছে। দুর্নীতি বন্ধে সরকারের অঙ্গীকার বাস্তবায়নে সর্বশক্তি নিয়োগ করেছে কমিশন। নিয়োগ বাণিজ্য, ভর্তি বাণিজ্য, কমিশন বাণিজ্য, ফাইল আটকে রাখা, ঘুষ গ্রহণ ও প্রদানসহ যেখানেই দুর্নীতির গন্ধ পাওয়া যাবে সেখানেই দুদক হাজির হয়ে যাবে।’
দুদক চেয়ারম্যান আরও বলেন, ‘অভিযোগ পাওয়া গেলে মন্ত্রী-এমপিদেরও ছাড় দেওয়া হবে না। অভিযোগ পেলে আমরা অনুসন্ধান করব। আমরা দেখব এবং ধরব। কিন্তু অভিযোগ কই, আমরা তো মন্ত্রী-এমপিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ পাচ্ছি না।’ দুদকের সাম্প্রতিক বিভিন্ন অভিযান নিয়ে সমালোচনা ও নেতিবাচক মন্তব্যের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি বলেন, ‘কমিশনের প্রতিটি অভিযান আইনানুগ প্রক্রিয়ায় হচ্ছে। কোনো ব্যক্তির ক্ষতি করতে সরকারি কর্মচারী কর্তৃক আইন আমান্যকরণ দ-নীয় অপরাধ, যা কমিশনের তফসিলভুক্ত অপরাধও। তাই আইন অমান্য করে জনগণের কোনো ক্ষতিসাধন কিংবা ক্ষতি সাধনের চেষ্টা করা হলে আরও কঠোর আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দুর্নীতিমুক্ত দেশ গড়া বর্তমান সরকারের অন্যতম অঙ্গীকার ছিল। গত ৭ জানুয়ারি সরকার গঠনের পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও তার বক্তব্যে দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে হঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন। এই অবস্থায় দুদকও গত তিন সপ্তাহে বেশ কিছু ব্যতিক্রম অভিযান চালিয়েছে রাজধানীর নামি স্কুল, ভূমি অফিস, হাসপাতাল, মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট, বিএসটিআই, শুল্ক বিভাগসহ বিভিন্ন দপ্তরে। অভিযানের পর কর্মস্থলে অনুপস্থিত ও অনিয়মে জড়িত ব্যক্তিদের সতর্ক করে চিঠি দিয়েছে এবং সংশ্লিষ্ট দপ্তরে তাদের বিরুদ্ধে শাস্তির সুপারিশ করেছে। এই অবস্থায় জনপ্রশাসন, পুলিশ, স্থানীয় সরকার, শুল্ক বিভাগ, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, ব্যাংক, বিমা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের মধ্যে দুদক আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। শুধু দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের মধ্যেই যে আতঙ্ক তা নয়, দুর্নীতিতে জড়িত নয় এমন কর্মকর্তারাও ভয়ের মধ্যে আছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বেশ কয়েকজন সরকারি কর্মকর্তা ও পুলিশ সদস্য জানান, হুট করে কখন দুদক অভিযান চালায় এ নিয়ে আতঙ্কে আছেন তারা। অফিসে গিয়ে না পেলেই শাস্তিমূলক ব্যবস্থার সুপারিশ করবে এই ভয়ে আছেন অনেকে। ফলে কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া কেউ কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকছেন না।
দুদক গত কয়েক দিনে কাস্টম, ভূমি অফিসসহ বিভিন্ন দপ্তরে অভিযান চালিয়ে হাতেনাতে আসামিদের গ্রেপ্তার করে।
বৃহস্পতিবার চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসে অভিযান চালিয়ে ঘুষ গ্রহণের সময় আনসার কমান্ড্যান্ট ও বিসিএস আনসার ক্যাডারের কর্মকর্তা আশিকুর রহমানকে ঘুষের ১ লাখ টাকাসহ গ্রেপ্তার করে। একই দিন দুর্নীতির দায়ে পটুয়াখালীতে গ্রেপ্তার হয়েছেন জনতা ব্যাংকের তিন কর্মকর্তা। আগের দিন বুধবার কিশোরগঞ্জে ঘুষ গ্রহণের সময় গ্রেপ্তার হন ভূমি অফিসের সার্ভেয়ার গিয়াসউদ্দিন। একই দিন গোপালগঞ্জের কাশিয়ানীতে গ্রেপ্তার হন সোনালী ব্যাংক কর্মকর্তা ও বরিশালে ত্রাণের চাল বিতরণে অনিয়মের দায়ে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আমানুল্লাহ। বুধবার দুদক স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ২৩ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে শান্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেয়। একই দিন দুর্নীতির অভিযোগে নৌপরিবহন অধিদপ্তরের সাবেক প্রধান প্রকৌশলী নাজমুল হককে গ্রেপ্তার করা হয়। মামলা করা হয় বেসিক ব্যাংকের ১৩ দুর্নীতিবাজের নামে। এর আগে মঙ্গলবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দুর্নীতিবাজ দম্পতি আবজাল-রুবিনার স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি জব্দ করা হয়। বেআইনি চারটি ইটভাটা উচ্ছেদ করা হয়। একই দিন রাজধানীর উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুল অ্যান্ড কলেজে অভিযান চালায় দুদক। এ সময় কোচিং বাণিজ্যে জড়িত থাকায় ৩০ শিক্ষককে কারণ দর্শানোর নোটিস দেওয়া হয়।
২১ জানুয়ারি ঢাকাসহ সারা দেশের ১০টি হাসপাতালে একযোগে অভিযান চালায় দুদক। এ সময় ব্যাপক অনিয়ম ও ৬২ শতাংশ চিকিৎসককে হাসপাতালে অনুপস্থিত পায় দুদক। তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করা হয়। ১৯ জানুয়ারি রাজধানীর আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজে ভর্তির অনিয়মের অভিযোগ পেয়ে অভিযান চালায় কমিশন। ১৭ জানুয়ারি দুদক বগুড়ায় পরিবেশ অধিদপ্তরে আকস্মিক অভিযান চালায়। এতে ছাড়পত্র ও লাইসেন্স নবায়নে ঘুষ লেনদেনের প্রমাণ পায়। একই সঙ্গে দেখা যায়, ওই দপ্তরের অধীনে থাকা দুই হাজার ইটভাটার মধ্যে ১ হাজার ১৪৪টিই অবৈধ। একই দিন ভর্তি অনিয়মের জন্য ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজে অভিযান চালানো হয়।
১৩ জানুয়ারি বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউটে (বিএসটিআই) অভিযান চালিয়ে নিয়োগ বাণিজ্যে ঘুষ লেনদেন ও অনিয়মের প্রমাণ পায় কমিশন। ১০ জানুয়ারি চট্টগ্রামের ঘুষের টাকাসহ শুল্ক কর্মকর্তাকে হাতেনাতে আটক করা হয়। ৯ জানুয়ারি দুদক ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারসহ বিভিন্ন কারা হাসপাতালে অভিযান চালিয়ে দাগি আসামিরা ঘুষের বিনিময়ে হাসপাতালের বেড দখলে রাখার প্রমাণ পায়। ৪ জানুয়ারি সিভিল এভিয়েশন ও ৩ জানুয়ারি পিপলস লিজিংয়ে দুর্নীতিবিরোধী অভিযান চালায় দুদক।
এসব অভিযান প্রসঙ্গে দুদকের মহাপরিচালক ও এনফোর্সমেন্ট ইউনিটের প্রধান সমন্বয়ক মোহাম্মাদ মুনীর চৌধুরী বলেন, কোনো সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত হলে তিনি আর সরকারি কর্মচারী থাকেন না। সরকারি কর্মকর্তার মর্যাদা রাখতে হলে অবশ্যই ঘুষ দুর্নীতিমুক্ত থাকতে হবে। প্রতিটি সরকারি দপ্তরে ঘুষ প্রদান ও গ্রহণের ঘটনাগুলো হাতেনাতে ধরার জন্য কঠোর গোয়েন্দা নজরদারি করছে দুদক। তাছাড়া যে কেউ হটলাইন ১০৬ ফোন করে দুর্নীতি ও অনিয়মের তথ্য জানাতে পারেন। আমরা প্রতিনিয়ত অনেক ফোন পাচ্ছি। সেগুলো যাচাই-বাছাই করে অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে।
সূত্র: দেশ রূপান্তর