গাজীপুরে ত্রাণের জন্য ছুটছেন রাস্তায় রাস্তায়

গাজীপুর কণ্ঠ ডেস্ক : সোমবার বেলা দুইটা। জয়দেবপুর রেল জংশনের শেষ মাথায় জনা বিশেক মানুষের জটলা। অধিকাংশই নারী। প্রতিবেদক জংশনের ২ নম্বর প্ল্যাটফর্ম ধরে একটু এগোতেই ছুটে আসে তারা। কোনো ত্রাণদাতা বা প্রশাসনের লোক ভেবে শুরু হয় তাদের হইচই। চারদিক ঘিরে ধরে ত্রাণ পাওয়ার আশায় শুরু হয় কাকুতি-মিনতি। প্রতিবেদক কিছুটা অসহায়ত্ববোধ করে নিজের পরিচয় দেন। সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে শুরু হয় তাদের অভিযোগের ডালি। গল্পে গল্পে শোনা হয় তাদের দুঃখ–কষ্টের কথা।

সোমবার (০৬ এপ্রিল) প্রথম আলো- পত্রিকায় প্রকাশিত ‘ত্রাণের খোঁজে রাস্তায় নেমেছে তারা’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে এ সকল তথ্য উঠে এসেছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গৃহকর্মীর কাজ করেন পারভীন আক্তার। স্বামী কালো মিয়া দিনমজুর। দুই ছেলেমেয়ে নিয়ে তাঁরা থাকেন নগরের পূর্ব চান্দনায় একটি ভাড়া বাসায়। দেশের সাম্প্রতিক পরিস্থিতিতে দুজনই বেকার হয়ে পড়েছেন। ঘরে যে কয়দিনের বাজার ছিল, তাতে চলেছে গত শুক্রবার রাত পর্যন্ত। এরপর শনি ও রোববার দুপুর পর্যন্ত চলেছেন প্রতিবেশীর কাছ থেকে চাল ও ডাল ধার নিয়ে। কিন্তু এখন ভবিষ্যৎ সংকটের আশায় কেউ ধারও দিচ্ছেন না। তাই ত্রাণের জন্য ছুটছেন রাস্তায় রাস্তায়।

পারভীন তাঁর প্রতিবেশী হোসনা বেগমের কাছ থেকে জানেন সরকারি ত্রাণের কথা। তাই লাজলজ্জার মাথা খেয়ে আজ সকাল থেকেই বেরিয়ে পড়েন রাস্তায়। তিনি প্রথমে জয়দেবপুরের রাজবাড়ী এলাকায় জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে, পরে শিববাড়ী মোড় ও জোড়পুকুর এলাকায়ও গিয়েছেন। কিন্তু কোথাও ত্রাণ না পেয়ে সবশেষ অপেক্ষা করছিলেন রেল জংশনে।

পারভীন বলেন, ‘সকাল থেকে না খেয়ে ঘুরতাছি। যে যেখানে বলতাছে, সেখানেই যাইতেছি। কিন্তু কেউ তো সহায়তা দিচ্ছে না। ঘরে একটা পয়সা নাই যে বাজার করব। এভাবে চলতে থাকলে শেষ পর্যন্ত না খেয়ে মরতে হবে।’

ত্রাণের অপেক্ষায় থাকা আরেক নারী মোমেনা বেগম। তিনিও সকাল থেকে না খাওয়া। দুপুরের দিকে কেউ একজন তাঁকে একটি খাবারের প্যাকেট দেন। মোমেনা সেই খাবার খাবেন, ঠিক এমন সময় জংশনে থাকা এক অন্ধ নারী খাবার না পেয়ে কান্নাকাটি করতে থাকেন। মোমেনা তাঁর কষ্ট সহ্য করতে না পেরে খাবার ওই অন্ধকে দিয়ে দেন। জংশনে বসে তিনিও বারবার আক্ষেপ করছিলেন।

মোমেনা বলেন, ‘আমি তো চোখে দেখি, কোনো না কোনোভাবে হয়তো কিছু খেতে পাব। কিন্তু এরা অন্ধ, এমনভাবে চাইছে যে না দিয়ে পারলাম না।’ তিনি জানান, তাঁর এক ছেলে আছে। সে লেগুনা চালিয়ে সংসার চালাত। এখন কাজ বন্ধ ছেলেরও কোনো আয় নাই। তাই বাধ্য হয়েই ত্রাণের জন্য রাস্তায় নেমেছেন।’

এমন গল্প আরও শোনা গেল জংশনে থাকা মদিনা, নুরজাহান, সিমলা, বীথি, ফাতেমাসহ অনেকের কাছে। তাঁরা সবাই হতদরিদ্র।

রেল জংশন থেকে বেরিয়ে অল্প দূরত্বের গাজীপুর জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনের সড়কে গিয়েও এমন জটলা দেখা যায়। তাঁদের অধিকাংশই নারী। পেশায় কেউ গৃহকর্মী কেউবা দিনমজুর। তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে কাজ বন্ধ হওয়ায় সবাই বেকায়দায়। অপেক্ষা করছিলেন ত্রাণসহায়তার। কিন্তু দীর্ঘ সময় অপেক্ষার পরও ত্রাণ না পেয়ে বাড়ি ফেরেন তাঁরা।

নাজমা আক্তার কখনো ইটভাঙা, কখনোবা মাটি কাটার কাজ করেন। স্বামী রিকশাচালক। দুই সন্তান স্কুলে পড়ে। স্বামী–স্ত্রীর আয়ে টেনেটুনে সংসার চলত তাঁদের। এখন বেকার হয়ে পড়ায় দুজনই ছুটছেন সরকারি ত্রাণের পেছনে। এর মধ্যে স্বামীকে পাঠিয়েছেন এক জায়গায় আর তিনি অপেক্ষা করছেন জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে। সাংবাদিক পরিচয় জেনে তিনি বলছিলেন, ‘আমরা রাস্তার নামার লোক না ভাই। সংসারে বাজারঘাট যা ছিল সব শেষ। মানুষের কাছ থেকে আর ধারদেনাও করা যাচ্ছে না। এখন উপায় না পেয়ে রাস্তায় নামতে হয়েছে।’

এর আগে বেলা ১১টার দিকে টঙ্গীর নতুন বাজার এলাকায় গিয়েও এমন মানুষের জটলা দেখা যায়। টঙ্গী রেল জংশন ও শহীদ আহসান উল্লাহ মাস্টার উড়ালসড়কের আশপাশে ছড়িয়ে–ছিটিয়ে ছিলেন তাঁরা। তাঁদের সবার অপেক্ষা ছিল ত্রাণের জন্য। প্রায় ১০ মিনিট অপেক্ষার পর দেখা যায়, কোনো এক ব্যক্তি একটি লেগুনায় কিছু চাল নিয়ে এসেছেন। এটা দেখে হুমড়ি খেয়ে পড়েন সবাই। শুরু হয় কাড়াকাড়ি। একপর্যায়ে ওই ত্রাণদাতা উপায় না দেখে ত্রাণ না দিয়েই চলে যান।

আজ গাজীপুর নগরের টঙ্গী, কলেজ গেট, শিববাড়ী, রাজবাড়ি, জোড়পুকুর, জয়দেবপুর রেল জংশনসহ এমন কয়েকটি এলাকা ঘুরে এসব ছিন্নমূল মানুষকে দেখা যায়। যাদের প্রত্যেকেই রাস্তায় রাস্তায় ছুটছিল দুমুঠো আহারের জন্য।

সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে দেশে চলছে সরকারের অঘোষিত লকডাউন। এতে বেকায়দায় পড়েছে সমাজের ছিন্নমূল মানুষ। এমন পরিস্থিতিতে তাদের অধিকাংশই বেকার হয়ে পড়েছে। তাই বাঁচার তাগিদে এসব ছিন্নমূল মানুষ ত্রাণের জন্য ছুটছে নগরের অলিগলিতে।

এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক এস এম তরিকুল ইসলামের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বলেন, সরকারের ত্রাণ ও দুর্যোগ মন্ত্রণালয় থেকে যে বরাদ্দ এসেছে, তা সিটি করপোরেশন এলাকায় মেয়র ও উপজেলা পর্যায়ে ইউএনওকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তাঁরা পর্যায়ক্রমে ত্রাণ বিতরণ করছেন।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button