কোনাবাড়ির আতঙ্ক কাউন্সিলর সেলিম
গাজীপুর কণ্ঠ ডেস্ক : গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের কোনাবাড়ি এলাকায় ভয়াবহ আতঙ্কের নাম মো. সেলিম রহমান। তিনি ৮ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর।
তবে স্থানীয়দের অভিযোগ, ওই ওয়ার্ড ছাড়াও কোনাবাড়ির আরও চার ওয়ার্ডসহ কাশিমপুর এলাকাতেও রয়েছে তার ও তার ক্যাডার বাহিনী নেতৃত্বাধীন সিন্ডিকেটের ত্রাসের রাজত্ব।
মিল-ফ্যাক্টরিতে ঝুট ব্যবসা, কাঁচাবাজার ও ডিশ ব্যবসায় চাঁদাবাজি, অবৈধ গ্যাস সংযোগসহ নানা অপকর্মে জড়িত চক্রটি। জমি দখল থেকে শুরু করে বাদ নেই ফুটপাত দখল ও আবাসিক হোটেল ব্যবসার নামে পতিতাবৃত্তির নিয়ন্ত্রণও। ওই চক্রের বিরুদ্ধে যারাই কথা বলেছে, তাদের ওপর চালানো হয়েছে নির্যাতন। টর্চারসেলে নিয়ে চরম শায়েস্তা করা হয়েছে বা মামলা দিয়ে করা হয়েছে হয়রানি।
এছাড়া মাদক ব্যবসায়ও রয়েছে তার চক্রের ব্যাপক পরিচিতি। ‘ইয়াবা সম্রাট’ হিসেবে টক অব দ্য কান্ট্রি টেকনাফের সাবেক এমপি আবদুর রহমান বদির সঙ্গেও রয়েছে সেলিম রহমানের গলায় গলায় ভাব।
বদি তাকে বুকে টেনে নিয়ে মাথায় হাত বুলান- সম্প্রতি ওই ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে। এলাকায় আলোচনা আছে- ইয়াবার টাকায় সেলিম কক্সবাজারে একটি ফ্ল্যাটেরও মালিক। ওয়ান-ইলেভেন (ফখরুদ্দিন আহমদের নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক) সরকারের সময়ে যৌথবাহিনীর ক্রসফায়ারের তালিকায়ও ছিল সেলিম রহমানের নাম। জনশ্রুতি রয়েছে- বহু টাকা-পয়সা খরচ করে ওই নাম কাটিয়েছিলেন তিনি।
অধুনালুপ্ত কোনাবাড়ি ইউনিয়নের হরিণাচালা এলাকার মাহবুবুর রহমানের (ড্রাইভার) ছেলে সেলিম রহমান শুরুতে কোনাবাড়ী ইউনিয়ন ছাত্রদলে যুক্ত ছিলেন। বিএনপি সরকার তখন ক্ষমতায়। সেই থেকেই নানা অপকর্মে তার নাম যুক্ত হতে থাকে।
গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন গঠন হওয়ার প্রথম নির্বাচনে (২০১৪) তিনি ৮নং ওয়ার্ডে বিএনপির সমর্থন নিয়ে কাউন্সিলর নির্বাচিত হন। সেই সেলিম এখন আওয়ামী লীগের ‘নেতা’। তবে দীর্ঘদিনেও এখানে দলের কমিটি গঠিত না হওয়ায় এখনও কোনো পদ-পদবি পাননি তিনি।
সেলিম ও তার সিন্ডিকেটের নানা অপকর্মের আমলনামা সুদীর্ঘ হলেও গত বছরের ২৬ জুন একটি প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনের সুযোগে আবারও কাউন্সিলর নির্বাচিত হন তিনি। ওই নির্বাচনে যারা তার বিরোধিতা করেছিলেন, তাদেরও নানাভাবে হেনস্তা করেছেন সেলিম।
কাউন্সিলর সেলিমের একের পর এক অপকর্মে বিব্রত স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গ সংগঠনগুলো। এখানকার নেতাকর্মীরা বলছেন, কাউন্সিলর সেলিমের কারণে এখানে সরকারি দলের ভাবমূর্তি চরমভাবে ক্ষুণ্ণ হচ্ছে। তাই তার বিরুদ্ধে অনতিবিলম্বে ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানিয়েছেন স্থানীয় নেতাকর্মীরা।
স্থানীয়রা অভিযোগ করেছেন, কোনাবাড়ির হরিণাচালা, দেওলিয়াবাড়ী, চমকনগর, গুচ্ছগ্রাম, জমিদার মাঠ, সাবেক পুলিশ ফাঁড়ি এলাকা থেকে শুরু করে জেলখানা রোডের পূর্ব ও পশ্চিমে ঝুটপল্লী পর্যন্ত এলাকার পাঁচ লাখের বেশি মানুষ প্রতি মুহূর্তে তটস্থ থাকেন কাউন্সিলর সেলিমের ভয়ে। একই অবস্থা আশপাশ এলাকার আরও ১২ লাখের বেশি বাসিন্দার।
হরিণাচালা এলাকার ইদ্দি মিয়া জানান, গত সিটি নির্বাচনে তিনি ওই ওয়ার্ডে সেলিম রহমানের প্রতিদ্বন্দ্বী কাউন্সিলর প্রার্থী আওয়ামী লীগ নেতা মো. হেলালুর রহমান হেলুর নির্বাচন করেছেন। এ অপরাধে কাউন্সিলর সেলিম ক্ষিপ্ত হয়ে আমার বাড়ির ডিশ লাইন কেটে দেন। পরিচ্ছন্ন কর্মীদের আমার বাড়ির উচ্ছিষ্ট (বর্জ্য) নেয়া বন্ধ করে দেন। উল্টো বিভিন্ন বাড়ির ময়লা-আবর্জনা এনে আমার বাড়ির সামনে ফেলে রাখেন। পরে স্থানীয় সংসদ সদস্য মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হকের হস্তক্ষেপে এর সমাধান পাই।
একই এলাকার নজরুল ইসলামকেও হেনস্তা করেছেন কাউন্সিলর সেলিম। নজরুল বলেন, এলাকার বিভিন্ন বাসাবাড়িতে আমার ডিশ লাইনের ব্যবসা রয়েছে। কাউন্সিলর সেলিমের নির্বাচন না করার অপরাধে আমার নিজের বাড়ির সংযোগসহ বিভিন্ন বাসাবাড়ির সব সংযোগ কেটে দেয় তার লোকজন। এতে আমার প্রায় দুই লাখ টাকা আর্থিক ক্ষতি করা হয়। সফি নামে এক ব্যক্তি অভিযোগ করেন, তার কাছ থেকে দুই লাখ টাকা হাতিয়ে নেয় সেলিম সিন্ডিকেট।
দেওলিয়াবাড়ীর ইজ্জত আলী বলেন, নির্বাচনের পর কাউন্সিলর সেলিম আমাকে ফোন করে ৫ লাখ টাকা চাঁদা চান। বিষয়টি স্থানীয় কয়েকজনকে জানালে সেলিম আমার সঙ্গে দুষ্টুমি করেছে বলে পাশ কাটিয়ে যান।
মোটর চালক লীগ কোনাবাড়ি থানা কমিটির সভাপতি মো. মনজুরুল আলম বলেন, আমি গাজীপুর সিটির গত নির্বাচনে হেলালুর রহমানের নির্বাচন করেছি। এতে কাউন্সিলর সেলিম আমার ওপর ক্ষিপ্ত হন। তার ক্যাডার আবদুর রশিদ ও জাকির হোসেনের নেতৃত্বে ১০-১২ সন্ত্রাসী নতুনবাজারে আমাদের মোটর চালক লীগ কার্যালয়ে হামলা চালায়। বঙ্গবন্ধু ও প্রধানমন্ত্রীর ছবি এবং আসবাবপত্র ভাংচুর করে। তারা আমাকেসহ নেতাকর্মীদের মারধর করে রক্তাক্ত জখম করে। এ ঘটনায় সেলিম রহমানকে প্রধান আসামি করে জয়দেবপুর থানায় মামলাও করা হয়েছিল।
মনজুরুল আলম আরও বলেন, কোনাবাড়ি পুলিশ ফাঁড়ির সাবেক ইনচার্জ মো. মোবারক হোসেনের যোগসাজশে সেলিম রহমান এলাকায় বিভিন্ন অপকর্ম চালাত। ওই পুলিশ কর্মকর্তাকে দিয়ে আমাকেসহ অনেকের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করে। এছাড়া ডিবির (গোয়েন্দা পুলিশ) হাতে যাকে-তাকে ধরিয়ে দিয়ে লাখ লাখ টাকাও হাতিয়ে নিয়েছে কাউন্সিলর সেলিম।
মোটর চালক লীগ সভাপতি বলেন, ফাহাদ স্পিনিং ও আপেল নিটওয়্যারে ব্যবসা করতেন মাইদুল ও আমার ছোট ভাই দোলন। এসআই মোবারকের মাধ্যমে তাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দেয়া হয়। পরে মাইদুলকে তার (সেলিম) নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আমার ছোট ভাই দোলনকে ব্যবসা থেকে সরিয়ে দেয়।
নিজের আত্মীয়স্বজনও ছাড় পান না কাউন্সিলর সেলিমের কাছ থেকে। ফুফাত ভাই হরিণাচালা এলাকার করম উদ্দিন যুগান্তরকে বলেন, ডিবির কথা বলে আমার কাছ থেকে ১ লাখ ৫ হাজার টাকা হাতিয়ে নিয়েছে সেলিম।
স্থানীয়দের কাছ থেকে জানা গেছে, চাঁদাবাজির প্রতিবাদ করায় ৮ নম্বর ওয়ার্ড শ্রমিক লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মো. আলমগীর হোসেনকে নির্মমভাবে মারধর করে সেলিম ও তার বাহিনীর সদস্যরা। পরে প্রাণভিক্ষা চেয়ে রক্ষা মেলে আলমগীরের। একইভাবে ওয়ার্ড শ্রমিক লীগের সভাপতি মো. শহিদকেও কাউন্সিলর সেলিমের ক্যাডাররা মারধর করে।
সেলিমের অপকর্মের প্রতিবাদ করায় রেহাই পাননি কোনাবাড়ি ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মো. সোলেমান মিয়াও। তাকে মেরে ফেলার জন্য প্রকাশ্যে গুলি করা হয়। চাঁদা না দেয়ায় সেলিমের ক্যাডারদের নির্যাতনের শিকার হয়েছেন পুকুরপাড় এলাকার বাচ্চু মিয়াসহ অর্ধশত ব্যক্তি। নির্যাতনের শিকার লোকজন সেলিমের ভয়ে মামলা কিংবা জিডি করতেও সাহস পাননি।
স্থানীয়রা জানান, জেলখানা রোডের জমিদার মাঠের গোডাউনগুলো থেকে মাসে লাখ টাকা আদায় করা হয়। নতুনবাজার ঢাল এলাকা থেকে পায় আনুমানিক দুই লাখ টাকা। টাকা ছাড়া জন্মনিবন্ধন সনদ পাওয়া যায় না। নতুন বাড়িঘর বানাতে গিয়েও কাউন্সিলর সেলিমকে টাকা দিতে হয়, তা না হলে অনাপত্তিপত্র মেলে না। অবৈধ সংযোগের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করায় তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির এক কর্মকর্তাকে মারধর করে সেলিম ও তার ক্যাডাররা। ওই তিতাস কর্মকর্তা দেওয়ালিয়াবাড়ী এলাকার ডা. মোস্তফার বাড়ির ভাড়াটিয়া ছিলেন। স্থানীয়রা জানান, এলাকায় বৈধ গ্যাস সংযোগের চেয়ে অবৈধ সংযোগের সংখ্যাই বেশি। ৮নং ওয়ার্ডসহ আশপাশের এলাকায় সেলিম ও তার বাহিনীর দেয়া দেড় হাজারের বেশি অবৈধ সংযোগ রয়েছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে- আলেক মৃধা, সাইফুল মৃধা, আক্কাস মৃধা, রমিজ পাঠান, সুবাহান, লোকমান (কবিরাজ), সারোয়ার, আনোয়ারা, আবুল, বদি, জলিল, সামাদ, টাঙ্গাইলা বাড়ি, মুক্তিযোদ্ধার বাড়ি, মুকবর আলী, আজিজ ও আমির হোসেনের বাড়ির সংযোগও।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, সেলিম কাউন্সিলর ও তার লোকজন অবৈধ গ্যাস সংযোগ দিয়ে রাইজারপ্রতি মাসে ৯শ’ টাকা করে হাতিয়ে নিচ্ছে। এককালীন রাইজারপ্রতি পঞ্চাশ হাজার থেকে এক লাখ টাকা পর্যন্তও নিয়েছে তারা। এছাড়া শিল্প-কারখানায় সংযোগ দিতে এক থেকে দেড় লাখ টাকা নিয়েছে। এর মধ্য দিয়ে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে ওই চক্রটি। এসবের সঙ্গে জড়িত কাউন্সিলরের সহযোগী রেজাউল মাস্টার, আউয়াল মোল্লা, আবদুর রশিদ, জাকির হোসেন, নাজমুল ইসলাম প্রমুখ। কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে এখনও পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।
সেলিম রহমানের অপকর্মের সহযোগীরা হল- রশিদ, এরশাদ, লায়ন, মো. আলী, মাহিন, সোহেল, শহিদ, জাহিদ (আলীর শ্যালক), রমজান, রুবেল, আউয়াল, নাজমুলসহ অর্ধশত লোক। এদের বিরুদ্ধে হত্যা, ধর্ষণ, নারী নির্যাতন, ডাকাতি, জমি দখল, চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন ধরনের অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগ ও মামলা রয়েছে।
এক ব্যবসায়ী জানান, স্থানীয় আবদুল ওহাবের বাড়ির ছাদ একটু বাড়তি হওয়ার অপরাধে প্রতিপক্ষের সঙ্গে বিবাদ হয়। ওই ঘটনা মিটিয়ে দেয়ার কথা বলে সেলিম কাউন্সিলর দুই লাখ টাকা হাতিয়ে নেন আবদুল ওহাবের কাছ থেকে। দক্ষিণ দেওলিয়াবাড়ীর ফারুকের ১০ লাখ টাকা, আজিজুল ইসলামের কাছ থেকে ৩ লাখ ৭৫ হাজার, বসু মাদবরের কাছ থেকে ৫০ হাজার টাকা হাতিয়ে নেয়ারও অভিযোগ রয়েছে সেলিম রহমানের বিরুদ্ধে।
কাউন্সিলর সেলিমের মেয়ে শাহীন ক্যাডেট একাডেমির কোনাবাড়ি শাখায় ষষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্রী থাকা অবস্থায় দুষ্টুমি করতে গিয়ে একসময় হাতে স্টাপলারের পিন গেঁথে যায়। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে সেলিম ও তার ক্যাডাররা ওই শাখার ইংরেজির শিক্ষক মো. শাহিন আহাম্মেদকে ওই একাডেমিতেই পিটিয়ে আহত করে। শতাধিক শিক্ষার্থীর উপস্থিতিতে শিক্ষককে মারতে মারতে টেনেহিঁচড়ে রাস্তায় নিয়ে যায়। সহকর্মী ও প্রিয় শিক্ষার্থীদের সামনে এমন অপদস্থ হয়ে ওই শিক্ষক আর একাডেমিতে আসেননি।
এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে কাউন্সিলর সেলিম রহমান বলেন, আমার বিরুদ্ধে উল্লিখিত একটি অভিযোগও সত্য নয়। বিভিন্ন লোকজন নিজেদের স্বার্থসিদ্ধি না করতে পেরে আমার বিরুদ্ধে এসব কথা বলছেন। তবে কক্সবাজারে তার একটি ফ্ল্যাট থাকার কথা স্বীকার করেন সেলিম রহমান। তিনি বলেন, আমি রাজনীতি করি, রাজনীতির জন্য আমার অনেকের সঙ্গেই সম্পর্ক রয়েছে। এজন্য সাবেক এমপি বদির সঙ্গে আমার সুসম্পর্ক রয়েছে। আমি যদি এতই খারাপ হতাম তবে গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের ৮নং ওয়ার্ডের জনগণ আমাকে দুইবার কাউন্সিলর নির্বাচিত করতেন না।