গাছা থানায় নববধূকে আটকে তালাকে স্বাক্ষর করাল পুলিশ!

গাজীপুর কণ্ঠ ডেস্ক : হাতের মেহেদির রং এখনো মোছেনি। কাটেনি আনন্দের রেশ। অথচ বিয়ের পাঁচ দিনের মাথায় স্বামীকে তালাক দিতে হয়েছে এক নববধূকে। তবে স্বেচ্ছায় নয়, থানাহাজতে আটকে রেখে কাজি ডেকে জোরপূর্বক নেওয়া হয়েছে তাঁর স্বাক্ষর।

এখানেই শেষ নয়, ছেড়ে দেওয়ার আগে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে এলাকা ছাড়ার এবং এ ঘটনা কারো কাছে প্রকাশ না করার শর্তও দেওয়া হয়েছে নববধূকে। মীমাংসার কথা বলে বরের পরিবারের কাছ থেকে দুই লাখ ৭০ হাজার টাকা আদায় করা হলেও নববধূকে দেওয়া হয়েছে মাত্র ৬০ হাজার।

‘পুলিশ সেবা সপ্তাহ’ চলার মধ্যেই এমন অমানবিক ঘটনা ঘটেছে গাজীপুর মহানগরীর গাছা থানায়।

বরকে তালাক দিতে বাধ্য হওয়া এই নববধূ রুমানা আক্তারের (২৩) বাড়ি কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার ঢেকিপাড়া সালতা গ্রামে। তিনি গাজীপুর মহানগরীর মালেকের বাড়ি এলাকার ভুসির মিল সড়কের মোজাম্মেল টাওয়ারে ভাড়া বাসায় থাকতেন। স্থানীয় প্রীতি সোয়েটার কারখানায় লিংকিং স্যাম্পলম্যান পদে চাকরি করতেন রুমানা। পুলিশের হুমকির কারণে মঙ্গলবার বাড়ির মালিকের স্ত্রী তাঁকে বাসা থেকে বের করে দিয়েছেন। এখন তাঁর ঠিকানা হয়েছে রাস্তা।

মঙ্গলবার দুপুরে স্থানীয় লোকজনের কাছ থেকে খবর পেয়ে ওই এলাকায় গিয়ে রুমানার সঙ্গে দেখা হয় এই প্রতিবেদকের। ভয়ার্ত রুমানা কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘কত স্বপ্ন ছিল। এখন ভয়ে আতঙ্কে আছি। গাজীপুরে না থাকতে পুলিশ ও বরের স্বজনদের ক্যাডাররা ক্রমাগত হুমকি দিচ্ছে। বলছে কেউ বাঁচাতে পারবে না। বাসা থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে। এখানে কোনো আত্মীয়-স্বজন নেই। কোথায় গিয়ে থাকব? কার কাছে আশ্রয় নেব?’

রুমানা অভিযোগ করেন, পুলিশের কাছে বিচারের আশায় গিয়ে উল্টো বরকেই তালাক দিতে হয়েছে তাঁকে। তিনি বলেন, ‘বিচার যখন পেলাম না, যাওয়ারও স্থান নেই। তাই গাড়ির চাকার নিচে মাথা দিয়ে দুনিয়া থেকে বিদায় নেব।’

রুমানার ভাড়া বাসায় গেলে স্থানীয় লোকজন জানায়, কুমারখালীর ঢেকিপাড়া সালতা গ্রামের আকমল হোসেন ও জামেলা বেগম রুমানার পালিত মা-বাবা। বাবা আকমল হোসেন মাছ বিক্রি করে সংসার চালান। ২০১৩ সালে এসএসসি পাস করার পর অভাবের কারণে গাজীপুরে এসে প্রীতি সোয়াটারে চাকরি নেন রুমানা। দুই বছর পর পরিবারের সিদ্ধান্তে এক প্রবাসীর সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। ওই সংসারে তাঁর দুই বছরের একটি মেয়ে রয়েছে। সাত-আট মাস আগে ভুসির মিল এলাকার আলমগীর হোসেনের ছেলে সাদেক আহমেদ সজলের সঙ্গে রুমানার পরিচয় হয়। ভাড়া বাসার সামনে সজলের ফ্লেক্সিলোডের দোকান রয়েছে। পরিচয় থেকে তাঁদের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। দেড় মাস আগে সজল রুমানাকে বাধ্য করে প্রবাসী স্বামীকে তালাক দিতে। স্থানীয়ভাবে প্রভাবশালী সজলের মা-বাবা তাদের প্রেমের খবর জানতেন। বিপত্তি বাধে গত ৩১ জানুয়ারি বৃহস্পতিবার গাজীপুর মহানগরীর গাজীপুরা কাজি অফিসে গিয়ে রুমানা ও সজলের বিয়ের পর। তিন লাখ টাকা দেনমোহরে বিয়ে শেষ করে নবদম্পতি রাতে বাসায় আসার পর সজলের বাবা বিয়ে মেনে না নিয়ে রুমানাকে ঘর থেকে বের করে দেন। বাধ্য হয়ে সজল রুমানাকে তাঁর ভাড়া বাসায় রেখে যান।

রুমানা জানান, এ ঘটনার পরদিন সকাল থেকে সজলের মোবাইল বন্ধ পান তিনি। বিকেলে সজলের ভগ্নিপতি ও ভাই এলাকার উঠতি ছেলেপেলে নিয়ে বাসায় আসেন। তাঁরা হুমকি দিয়ে বলেন, রাতের মধ্যে তাঁকে এলাকা ছেড়ে চলে যেতে হবে। নইলে মানসম্মান নিয়ে এলাকায় থাকতে পারবেন না। রাস্তায় টানা-হেঁচড়া করা হবে। রাতটুকু থাকার সময় দিয়ে তাঁরা চলে যান। গত শনিবার দুপুরে সজলের ভগ্নিপতি এসে বিছানায় পাঁচ হাজার টাকা ছুড়ে দিয়ে চলে যেতে বলেন। নইলে পরিণতি ভয়াবহ হবে বলে আবার শাসিয়ে যান।

রুমানা বলেন, সারারাত ভেবেচিন্তে তিনি রবিবার সকালে গাছা থানায় গিয়ে সব খুলে বলেন। পুলিশ বলার পর লিখিত অভিযোগ দেন। অভিযোগ তদন্ত করতে দেওয়া হয় উপপরিদর্শক (এসআই) হাফিজুর রহমানকে। এরপর হাফিজ সজল ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের থানায় ডেকে পাঠান। পুলিশ সজলকে হাজতখানায় আটকে রাখে। এরই মধ্যে কয়েকজন প্রভাবশালী সজলের হয়ে থানায় ফোন করলে পাল্টে যায় পরিস্থিতি।

রুমানা বলেন, এসআই হাফিজ তাঁকে হাজতে আটকে রেখে সজলকে তালাকের জন্য চাপ দেন। সজলকে মারধর করার কথা বলে নানা ভয়ও দেখানো হয় তাঁকে। সজলের কথা ভেবে রাজি হলে সোমবার সকাল ১১টার দিকে ৩৪ নম্বর ওয়ার্ডের কাজী অফিস থেকে কাজীকে থানায় ডেকে আনা হয়। এরপর তাঁর কাছ থেকে জোরপূর্বক স্বাক্ষর নেওয়া হয়। ৬০ হাজার টাকা হাতে দিয়ে এসআই হাফিজ তাঁকে এলাকা ছেড়ে চলে যেতে বলেন।

জানতে চাইলে এসআই হাফিজ বলেন, ‘দুই পক্ষের সম্মতিতে মীমাংসা করে দেওয়া হয়েছে। থানায় কাজী ডাকা হয়নি। এসব হয়েছে বাইরে।’ তিনি দাবি করেন, কত টাকা দিয়ে মীমাংসা করা হয়েছে তাও জানেন না তিনি। তিনি রুমানাকেও কোনো হুমকি দেননি বলেও দাবি করেন।

কাজী আবুল হোসেন সুমন বলেন, ফোন পেয়ে থানায় গিয়ে তিনি তালাক নামায় কনে রুমানার স্বাক্ষর নিয়েছেন। ওই সময় এসআই গোলাম রসুল ও হাফিজ উপস্থিত ছিলেন।

গাছা থানার ওসি মো. ইসমাইল হোসেন বলেন, ‘শুনেছি মেয়েটি ভালো না। একাধিক বিয়ে করেছে। বহু ছেলের সঙ্গে সম্পর্ক। এলাকার কয়েকজন মুরব্বির পরামর্শে বিষয়টি মীমাংসা করে দেওয়া হয়েছে।’ তবে থানায় কাজী এনে তালাকের বিষয়ে তিনি কিছু জানেন না দাবি করে বলেন, টাকা লেনদেনের বিষয়েও তাঁর জানা নেই।

সজলের মোবাইল বন্ধ থাকায় তাঁর সঙ্গে কথা বলা যায়নি। বাবা আলমগীর হোসেন বলেন, তাঁর ছেলের বয়স মাত্র ২৪ বছর। তাঁর দাবি, সজলকে ফুসলিয়ে মেয়েটি বিয়ে করেছিলেন। থানায় বসে বিষয়টি ফয়সালা করা হয়েছে।

বাড়ির মালিকের স্ত্রী নাজমা বেগম বলেন, থানা থেকে ফোন দিয়ে পুলিশ রুমানাকে বাসা থেকে বের করে দিতে বলেছে। নইলে সমস্যা হবে। তাই তাঁকে বের করে দিয়েছেন। তিনি আরো জানান, তিন বছর ধরে রুমানা তাঁর বাসায় ভাড়া থেকেছেন। তাঁর মধ্যে খারাপ কিছু দেখেননি।

গাছা সার্কেলের সহকারী কমিশনার আশরাফুল ইসলাম বলেন, ঘটনাটি তাঁর জানা নেই। তবে থানা হাজতে আটকে এবং কাজী ডেকে তালাক পুলিশ নিতে পারে না। তিনি বলেন, ‘কোনো নারী খারাপ হলেও বিচার পাবে না—এটা হতে পারে না।’

গাজীপুর মহানগর পুলিশের কমিশনার ওয়াই এম বেলালুর রহমান বলেন, তিনি এ বিষয়ে কিছু জানেন না। তিনি বলেন, ‘এখন পুলিশ সেবা সপ্তাহ চলছে। আমরা মানুষকে সর্বোচ্চ সেবা দেওয়ার চেষ্টা করছি। অভিযোগ পেলে দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

 

 

 

সূত্র: কালের কণ্ঠ

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button