পাকিস্তানি পদার্থবিদের বাংলাদেশ বন্দনা
পাকিস্তানের প্রভাবশালী গণমাধ্যম ‘ডন’ এ লেখা এক সম্পাদকীয়তে বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থায় উন্নতি এবং এই প্রসঙ্গে তার দেশকে বাংলাদেশের পথ অনুসরণের পরামর্শ দেন তিনি।
গাজীপুর কণ্ঠ ডেস্ক : পাকিস্তানের প্রভাবশালী গণমাধ্যম ‘ডন’ এ প্রকাশিত এক সম্পাদকীয়তে সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের অগ্রগতি এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে দেশটির সঙ্গে বাংলাদেশের পার্থক্য তুলে ধরা হয়েছে। পাকিস্তানি পদার্থবিদ পারভেজ হুদভয় এর লেখা ওই সম্পাদকীয়র শুরুতে বলা হয়েছে- “বাংলাদেশ কোনও স্ক্যান্ডিনেভিয়ান স্বর্গরাজ্য নয়। দেশটি দরিদ্র এবং জনবহুল, প্রাকৃতিক দুর্যোগপূর্ণ, মাঝে মাঝে সেখানে সন্ত্রাসী কার্যকলাপ পরিলক্ষিত হয়।”
সম্পাদকীয়তে বলা হয়, ‘দুর্বল গণতান্ত্রিক’ শাসনব্যবস্থা সত্বেও ‘লাইফ সাপোর্টে থাকা দেশ’ -এর অবস্থান থেকে নিজেকে বের করে আনতে সক্ষম হয়েছে বাংলাদেশ। এখন তো কোনও কোনও অর্থনৈতিক বিশ্লেষক বাংলাদেশকে এশিয়ার পরবর্তী অর্থনৈতিক পরাশক্তি বলে মনে করেন। গত বছর বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৭.৮%, যেখানে ভারতের ছিল ৮% এবং পাকিস্তানের মাত্র ৫.৮%। মাথাপিছু বৈদেশিক ঋণের পরিমাণও পাকিস্তানের অর্ধেক। আর বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের পরিমাণ পাকিস্তানের চেয়ে চারগুণ বেশি।
এই প্রবৃদ্ধির বেশিরভাগই রফতানি নির্ভর। যা ১৯৭১ সালে শুন্যের কোঠা থেকে ২০১৮ সালে এসে দাঁড়িয়েছে বছরে সাড়ে তিন হাজার কোটি মার্কিন ডলারেরও বেশি, যেখানে পাকিস্তানের বাৎসরিক রফতানি আয় আড়াই হাজার কোটি ডলারের কিছু কম।
উদাহরণস্বরূপ টেনে আনা হয়েছে বস্ত্রশিল্পকে, বলা হয়েছে- বাংলাদেশে তুলা উৎপন্ন হয় না, কিন্তু পাকিস্তানে হয় এবং বস্ত্রশিল্প খাতে প্রচুর সুবিধা দেওয়া সত্বেও মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেনি পাকিস্তানের বস্ত্রশিল্প খাত।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের হিসাব অনুযায়ী, ২০২১ সালে নাগাদ বর্তমানের তুলনায় বাংলাদেশের রিজার্ভের পরিমাণ বাড়বে প্রায় দেড় গুণ। বর্তমানে দুই দেশের মানুষের গড় সম্পদের পরিমাণ প্রায় একই এবং কোনও কারণে পাকিস্তানি মুদ্রার দাম পড়ে গেলে ২০২০ সাল নাগাদ কাগজে-কলমে বাংলাদেশিরা তাদের তুলনায় সম্পদশালী হয়ে উঠবেন।
পাকিস্তানি পদার্থবিদের চোখে বাংলাদেশের উন্নয়নের অন্যান্য দিকগুলোও আর্থিক খাতের মতোই সমান আশ্চর্যজনক। তিনি লিখেছেন, পঞ্চাশের দশকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের জনসংখ্যা ছিল চার দশমিক ২ কোটি, যেখানে পশ্চিম পাকিস্তানের তৎকালীন জনসংখ্যা ছিল তিন কোটি ৩৭ লাখ। কিন্তু বর্তমানে বাংলাদেশের জনসংখ্যা সাড়ে ১৬ কোটি আর পাকিস্তানের ২০ কোটি। ধারাবাহিক জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচী এদেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কমাতে সক্ষম হয়েছে বলে মনে করেন তিনি। কিন্তু, আজ পর্যন্ত পাকিস্তানে এখনও পর্যন্ত এ ধরনের কোনও পরিকল্পনা দেখা যায়নি।
বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাতকেও আকর্ষণীয় হিসেবে উল্লেখ করেছেন তিনি। বলছেন, টিকাদান কর্মসূচীসহ স্বাস্থ্যখাতে বিভিন্ন কর্মসূচীর ফলে পাকিস্তানের চেয়ে বাংলাদেশে শিশু মৃত্যুর হার কম। মানুষের গড় আয়ুও বেশি।
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা বলছে, পাকিস্তানের তুলনায় বাংলাদেশের নারীরাও এগিয়ে অনেকাংশে। এদেশে ৩৩ দশমিক ২ শতাংশ নারী কর্মমুখী, যেখানে পাকিস্তানে এই সংখ্যা ২৫ দশমিক ১ শতাংশ।
সম্পাদকীয়তে আরও বলা হয়, তুলনামূলক সম্পদশালী পাকিস্তানকে পেছনে ফেলে তারা যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছে তা আরও বিস্ময়কর! কারণ যুক্তরাষ্ট্র, চীন কিংবা সৌদি আরবের মতো দেশটি প্রাকৃতিক সম্পদে পরিপূর্ণ নয়। তাদের নেই রাসায়নিক অস্ত্র, নেই বিশ্বসেরা সেনাবাহিনী এমনকি দক্ষ পেশাজীবীতেও পরিপূর্ণ নয় দেশটি।
পারভেজ উল্লেখ করেন, ‘৫০ এবং ‘৬০-এর দশকে পাকিস্তানিরা বাঙালিদের হেয় করতো শারীরিক গঠনের কারণে। তারা মনে করত, কেবল ধান ফলাতে আর মাছ ধরাতেই বাঙালির কর্মদক্ষতা সীমাবদ্ধ। এমনকি, লম্বা, সুদর্শন এবং ঊর্দুভাষীদেরকেই তারা ‘ভাল মুসলিম’ বলে মনে করত।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানিদের গণ-আত্মসমর্পণের ফলে দ্বি-জাতি তত্ত্ব রীতিমতো উবে যায়। পরাজিত পশ্চিম পাকিস্তানিরা ভবিষ্যদ্বাণী করেছিল, বাংলাদেশ কখনোই অর্থনৈতিকভাবে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে না এবং তারা ফিরে আসবে পাকিস্তানের মানচিত্রে।
তবে, পাকিস্তানিদেরই একটা অংশ মনে করতেন ওই পরাজয় থেকে শিক্ষা নেবে পাকিস্তান। অন্তত সব নাগরিকের সমাধিকার নিশ্চিত করা হবে। কিন্তু বাস্তবে তেমন কিছুই ঘটেনি। বৈষম্য আরও প্রকট হয়েছে বলে মনে করেন দেশটির বিখ্যাত পরমাণু পদার্থবিদ হুদভয়।
পাকিস্তান শুধু ভারতের সাথে প্রতিহিংসার প্রতিযোগিতাই করে গেছে। ১৯৭৩ সালে জুলফিকার আলি ভুট্টো বেলুচিস্তানে ন্যাপ সরকারকে বিলুপ্ত করে দিলে দেশটির ভেতরে বিদ্রোহ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। যার ফলস্বরূপ ফাঁসিতে ঝুলতে হয় তাকে।
যা-ই হোক, বর্তমানে বাংলাদেশ আর পাকিস্তান আলাদা দু’টি রাষ্ট্র। রাষ্ট্রনীতিও আলাদা। জনগণের উন্নয়ন এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে বাংলাদেশ নিজের ভবিষ্যৎ খুঁজে নিয়েছে। প্রতিবেশি রাষ্ট্র ভারতের সাথে সীমান্ত বিরোধ সত্বেও প্রাথমিক চাহিদাগুলোর ক্ষেত্রে আপোষ করেনি বাংলাদেশ।
কিন্তু, পাকিস্তানে জনগণের উন্নয়ন রাষ্ট্রের প্রথম চিন্তার বিষয় না। নীতিনির্ধারকরা জনগণের চেয়ে ভারতকে হারানোই রাষ্ট্রের প্রধান দায়িত্ব বলে মনে করেন। এজন্য প্রতিবেশি ইরান আর আফগানিস্তানের সাথেও তাদের সম্পর্কের অবনতি হয়েছে।
বাংলাদেশও অভ্যন্তরীণ সমস্যায় জর্জরিত। কিন্তু, এখনও সেখানে বিভিন্ন সংস্কৃতি এবং উদার পরিবেশ বিরাজমান। বাংলাদেশে সরকারের ভেতরকার লোকজনদের কেউ কেউ দুর্নীতিগ্রস্থ এবং অবিশ্বস্ত। তবে জনগণের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে সরকার উন্নয়নে মনযোগী, পাকিস্তানের মতো অস্ত্রের দিকে ঝুঁকে পড়েনি তারা।
পদার্থবিদ পারভেজ মনে করেন, বাংলাদেশের এমন এগিয়ে যাওয়া পাকিস্তানের জন্য শিক্ষণীয়। অস্ত্র দিয়ে ভারতকে মোকাবেলার বাস্তবতা বিবর্জিত অবস্থান থেকে তাদেরকে সরে আসতে হবে। সুউচ্চ ভবনে দাঁড়িয়ে ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ বলে গলা ফাটিয়ে যুক্তরাষ্ট্র, চীন আর সৌদি আরবের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের ফলে বিশ্বে দেশটির কোনও উল্লেখযোগ্য অবস্থান নেই।