‘খাসপুকুরে’ গাছা থানার ওসি’র মৎস্য খামার!
বিশেষ প্রতিনিধি : বাণিজ্যিকভাবে ‘খাসপুকুরে’ মৎস্য খামার ও পুকুর পাড়ে গরুর খামার করেছেন গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের গাছা থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) ইসমাইল হোসেন। গাছা থানার পলাশোনা মৌজার এ খাস পুকুরের আয়তন ৩ একর ১১ শতাংশ বা স্থানীয় মাপে প্রায় সাড়ে ৯ বিঘা। গাজীপুর সিটি করপোরেশনের বড় খাসপুকুরগুলোর মধ্যে এটি অন্যতম। আগে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা এ পুকুর লিজ এনে মাছ চাষ করতেন।
বর্তমানে থানার ওসি বেনামে লিজ এনে পুকুরটি একধরণের দখল করে নিয়েছেন বলে স্থানীয়রা অভিযোগ করেন। এছাড়া থানার ওসি পুকুরপাড়ে গড়ে তুলেছেন নিজস্ব গরুর খামার।
ওসি ইসমাইল হোসেন বলেন, ‘মৎস্য চাষ ও গরু পালন আমার বিশেষ শখ। শখের বশবর্তী হয়েই যুবলীগ নেতা জুয়েল মন্ডলের কাছ থেকে পুকুরটি ভাড়ায় এনে আমরা মাছ চাষ করছি। পুকুরপাড়ে এক খণ্ড জমি ভাড়া নিয়ে গরুর খামারও করেছি। এতে দোষের কিছু নেই’।
গাজীপুরের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মোহাম্মদ মশিউর রহমান বলেন, ‘থানার ওসিকে আমরা পুকুর লিজ দেইনি। কোন ব্যক্তির নামে খাস পুকুর লিজ দেওয়ার নিয়মও নেই। এমনকি পুকুর লিজ নিয়ে সাব-লিজ দেওয়ারও কোন বিধান নেই’।
গাজীপুরের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) কার্যালয়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গাজীপুর সিটি করপোরেশনের ৩৫ নম্বর ওয়ার্ডের পলাশোনা মৌজায় অবস্থিত আলোচিত সাড়ে নয় বিঘা আয়তনের খাসপুকুরটি ‘সু-দৃষ্টি মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটির লিঃ’ এর নামে গত ০৩-০৪-২০১৯ ইং তারিখে বাংলা ১৪২৬ সন থেকে ১৪২৮ সনের জন্য অর্থাৎ তিন বছর মেয়াদী লিজ দেওয়া হয়েছে। অথচ উক্ত সমিতি বিগত ২০১৪ সালেই বিলুপ্ত হয়ে গেছে বলে গাজীপুর সদর উপজেলা সমবায় কার্যালয়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে।
গাজীপুর সিটি করপোরেশনের মূল ভূখণ্ড থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন একটি দ্বীপের মতো গ্রামের নাম ‘পলাশোনা’। একটি খালের ওপর ব্রিজের মাধ্যমে এই গ্রামের সাথে গাজীপুর নগরির সংযোগ স্থাপিত হয়েছে। সিটি করপোরেশনভূক্ত হলেও এখনো এলাকায় তেমন উন্নয়নের ছোঁয়া লাগেনি। গ্রামটির চারদিকে বিস্তীর্ণ আবাদী জমি ও জলাভূমি বেষ্টিত। বর্ষা মৌসুম হওয়ায় বর্তমানে গ্রামের চারদিকে শুধু থৈ থৈ পানি।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, প্রায় সাড়ে নয় বিঘা আয়তনের বিশাল খাসপুকুরটি তাদের এলাকার একটি ঐতিহ্য। ইতিপূর্বেও বিভিন্ন প্রভাবশালী মহল নামে-বেনামে পুকুরটি দখলের চেষ্টা করেছে। পুকুরটি স্থানীয়দের ব্যবহারের জন্য বরাবরই উম্মুক্ত ছিল। প্রায় দেড় বছর আগে গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের (জিএমপি) স্থানীয় গাছা থানার ওসি পুকুরটির দখল নেওয়ার পর এলাকাবাসীর মধ্যে একধরণের ভীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। পুলিশের ভয়ে স্থানীয়রা পুকুরের কাছেও যাওয়ার সাহস পান না।
পুকুরটি রক্ষনাবেক্ষনের পরিবর্তে থানার ওসি মৎস্য চাষের নামে পুকুরের যথেচ্ছা ব্যবহার করছেন অভিযোগ করে স্থানীয়রা জানান, মাছের অক্সিজেন সরবরাহের নামে বিশেষ যন্ত্র চালিত কৃত্রিম ঢেউ সৃষ্টির কারণে চার পাড় ভেঙ্গে পুকুরে বিলীন হচ্ছে। কৃত্রিম ঢেউয়ের তোড়ে পুকুর পাড়ে জনচলাচলের গুরুত্বপূর্ণ রাস্তাটিও ভেঙ্গে সংকোচিত হয়ে গেছে। এমনকি পুকুর পাড়ের স্থানীয় বাসিন্দারাও থাকেন ওসির আতঙ্কে।
থানার ওসির ভয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পুকুর পাড়ের একজন বাসিন্দা অভিযোগ করে জানান, ওসির লোকজন পুকুর পাড়ে তাদের ব্যক্তি মালিকানা জায়গায় ১২টি গাছ কেটে ফেলেছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পাশের আরেক বাড়ির মালিক জানান, ওসির গরুর খামারের গোবরের গন্ধে তারা বাড়িতে থাকতে পরেন না। ওসিকে বিষয়টি অবহিত করা হলে তিনি বিকল্প ব্যবস্থার আশ্বাস দিলেও এখনো কোন কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি। তবে গত কুরবানির ঈদে ৪০টি ষাঁড় গরু বিক্রির পর ওসি তার খামারে আর কোন নতুন গরু উঠাননি। খামারটি অন্যত্র স্থানান্তরের দাবী জানান স্থানীয় বাসিন্দারা।
এদিকে সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, পুকুরের ওপর একটি ঘর নির্মাণ করেছেন গাছা থানার ওসি ইসমাইল হোসেন। পাশেই ওসির আলোচিত গরুর খামার। কথা হয় পুকুর ও গরুর খামারের তত্ত্বাবধানে নিয়োজিত বাচ্চু মিয়ার সাথে। তিনি জানান, গাছা থানার ওসি ইসমাইল হোসেনের এলাকা নরসিংদী জেলার পাঁচদোনায় তাদের বাড়ি। ওসি ইসমাইল হোসেন তার (বাচ্চুর) খালাতো ভাই। ওসির দুই সহোদর আশরাফ উদ্দিন ও আফতাব উদ্দিনও তার সাথে পুকুর ও গরুর খামার দেখা-শুনা করেন। তারা থাকেন পুকুরে কাঠের মাচার ওপর নির্মিত ঘরে। তাদের রান্না-বান্নাও হয় সেখানে।
ওসি ইসমাইল হোসেনের ভাই আশরাফ উদ্দিন জানান, তারা পুকুরটিতে ৫০০ কেজি পোনা ছেড়েছেন। ইতিমধ্যে মাছের ওজন প্রায় এক কেজি হয়েছে। বর্ষার পর আরো এক হাজার কেজি পোনা ছাড়ার পরিকল্পনা রয়েছে তাদের।
পলাশোনা গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা ইদ্রিস আলী জানান, এই গ্রামের অধিকাংশ মানুষই কৃষি নির্ভর। এছাড়া গ্রামে কয়েকটি জেলে পরিবারও রয়েছে। অর্থাভাবে গ্রামের হত দরিদ্র পরিবারগুলো ছেলে-মেয়েদের লেখা-পড়ার খরচ চালাতে পারেন না। পুকুরটি আগে মুক্তিযোদ্ধাদের নামে লিজ আনা হলেও এলাকার ছাত্র ও বেকার যুবকরা পুকুরটিতে মাছ চাষ করে পড়া-লেখার খরচ যোগাতো। প্রায় দেড় বছর আগে গাছা থানা যুবলীগের প্রভাবশালী নেতা রাশেদুজ্জামান জুয়েল মন্ডল এলাকার ছেলেদের মারধর করে পুকুরের দখল নেয়। পরে তিনি (জুয়েল মন্ডল) গাছা থানার ওসি ইসমাইল হোসেনের কাছে পুকুরের দখল হস্তান্তর করেন। থানার ওসি পুকুরের দখল নেওয়ার পর এলাকাবাসী ভয়ে পুকুরের আশপাশেও যেতে সাহস পান না।
স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার রফিকুল ইসলাম (রফিক কমান্ডার) জানান, আওয়ামীলীগের নাম ভাঙ্গিয়ে এলাকার কতিপয় ভূমিদস্যু জমি দখলসহ বিভিন্ন অপকর্মে লিপ্ত। থানার ওসিকে হাতে রাখতে ওই ভূমিদস্যু চক্রটি নানা অপকৌশলে পুকুর দখলে নিয়ে ওসিকে উপহার দিয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় এক আওয়ামীলীগ নেতা বলেন, আমাদের দলীয় কোন্দল ও নেতৃত্বের দুর্বলতার কারণে প্রশাসনের লোভী কর্মকর্তারা সুযোগ নিচ্ছেন। তিনি বলেন, পুকুরটি আমাদের এলাকাবাসীর হক। অন্য জেলা থেকে এসে কেউ আমাদের গ্রামের পুকুরে বাণিজ্যিকভাবে মাছ চাষ করবে তা মেনে নেয়া যায় না। আমাদের এলাকায় অনেক বেকার যুবক রয়েছে। আর কেউ না হোক; অন্তত আমাদের দলের বেকার যুবকদের পুকুরটি চাষাবাদের জন্য লিজ দেওয়া হলেও মেনে নেওয়া যেত।
এসব বিষয়ে মোঠফোনে জানতে চাইলে হলে গাছা থানার ওসি ইসমাইল হোসেন বলেন, ‘পুকুরটি স্থানীয় যুবলীগ নেতা জুয়েল মন্ডল লিজ এনেছেন। মৎস্য চাষ ও গরু পালন আমার বিশেষ শখ। শখের বশবর্তী হয়েই যুবলীগ নেতা জুয়েল মন্ডলের কাছ থেকে পুকুরটি ভাড়ায় এনে আমরা মাছ চাষ করছি। পুকুরপাড়ে এক খণ্ড জমি ভাড়া নিয়ে গরুর খামারও করেছি। এতে দোষের কিছু নেই’।
কৃত্রিম ঢেউয়ে পুকুর পাড় ও পুকুর পাড়ের সরকারি রাস্তা ভেঙ্গে যাওয়ার ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘আমি ভাঙ্গন ঠেকাতে প্রায় সাত হাজার টাকার বাঁশ কিনে পুকুরপাড়ে পুঁতে দিয়েছি’।
এব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে যুবলীগ নেতা রাশেদুজ্জামান জুয়েল মন্ডল বলেন, তিনি ‘সু-দৃষ্টি মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটির লিঃ’ এর সভাপতি। উক্ত সমিতির নামে তিনি এক লাখ ৬১ হাজার টাকায় পুকুরটি গাজীপুর জেলা প্রশাসন থেকে লিজ এনে গাছা থানার ওসি ইসমাইল হোসেনকে সাব-লিজে দিয়েছেন। উল্লেখিত সমিতি বিলুপ্ত হয়নি বলেও তিনি দাবী করেন।
এদিকে উক্ত সমিতির ব্যাপারে জানতে চাইলে গাজীপুর সদর উপজেলা সমবায় কর্মকর্তা সাবিনা খান জানান, ‘বর্তমানে ‘সু-দৃষ্টি মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটির লিঃ (রেজি: নং- ১২৮)’ এর কোন কার্যক্রম নেই। উক্ত সমিতি বিগত ২০১৪ সালে বিলুপ্ত হয়ে যায়। যার বিলুপ্তির স্মারক নং- ১২৬২, তারিখ ০৯-০৭-২০১৪ ইং’।
বিগত ২০১৪ সালে অর্থাৎ বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার পাঁচ বছর পরে উল্লেখিত সমিতির নামে ২০১৯ সালে কিভাবে খাসপুকুর লিজ দেওয়া হলো জানতে চাইলে গাজীপুরের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মোহাম্মদ মশিউর রহমান বলেন, ‘সমিতিটি বিলুপ্ত কিনা আমাদের জানা ছিল না। সমিতি বিলুপ্ত হয়ে থাকলে পুকুরের লিজ বাতিল করা হবে’।
থানার ওসি খাস পুকুরে কিভাবে মাছ চাষ করেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘থানার ওসিকে আমরা পুকুর লিজ দিইনি। কোন ব্যক্তির নামে খাস পুকুর লিজ দেওয়ার নিয়মও নেই। এমনকি পুকুর লিজ নিয়ে সাব-লিজ দেওয়ারও কোন বিধান নেই। এমন অভিযোগ প্রমাণ হলে লিজ বাতিল করা হবে। এমনকি অভিযুক্ত লিজ গ্রহিতা পরবর্তীতে আর কোন লিজে অংশ নিতে পারবেন না’।