মাধ্যমিক শিক্ষা : বিদ্যালয়েই সোস্যাল মিডিয়ায় আসক্ত ৩০ শতাংশ শিক্ষার্থী

গাজীপুর কণ্ঠ, শিক্ষা ডেস্ক : রাজধানীর একটি সরকারি বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণীর শিক্ষার্থী কাউসার মাহমুদ। ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়াকালীনই সোস্যাল মিডিয়ায় অ্যাকাউন্ট খোলে। অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত মাঝে মধ্যে লগ-ইন করত। তবে নবম শ্রেণীতে উঠে স্মার্টফোন হাতে পাওয়ার পর সোস্যাল মিডিয়ার সঙ্গে সম্পৃক্ততা বেড়ে যায় এ শিক্ষার্থীর। ক্লাসের ফাঁকেই সোস্যাল মিডিয়ায় চোখ রাখতে থাকে। সোস্যাল মিডিয়ায় এ আসক্তি কমিয়ে দেয় তার পড়ালেখায় মনোযোগ।

সোস্যাল মিডিয়ার সঙ্গে ছেলের আসক্তিতে উদ্বিগ্ন বাবা মাইনুল ইসলাম। তিনি বলছিলেন, ‘ও অষ্টম শ্রেণিতে এ প্লাস পেয়েছিল। ভালো ফলাফল করেছিল প্রাথমিক সমাপনীতেও। তবে নবম শ্রেণী থেকে পড়ালেখার চেয়ে ওর মনোযোগ বেশি সোস্যাল মিডিয়ায়। ওর কাজিনদের মাধ্যমে জানলাম, ও দুটি পেজ ম্যানেজ করে। সব মিলিয়ে ছেলের পড়ালেখা নিয়ে দুশ্চিন্তার মধ্যে রয়েছি।’

মাধ্যমিক শিক্ষার্থীরা সোস্যাল মিডিয়া ব্যবহার করছে কিনা, করলে হার কত, তা জানতে গত বছর জরিপ চালায় জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থাপনা একাডেমি (নায়েম)। ঢাকার ১০টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ৪০০ শিক্ষার্থীর ওপর জরিপটি চালানো হয়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার শিক্ষার্থীদের একাডেমিক ফলাফলে কী প্রভাব ফেলছে, তাও জানার চেষ্টা করা হয় জরিপে।

‘সোস্যাল মিডিয়া পার্টিসিপেশন অব দ্য সেকেন্ডারি স্কুলস ইন ঢাকা সিটি’ শীর্ষক নায়েমের জরিপ প্রতিবেদন বলছে, স্কুল চলাকালেই সোস্যাল মিডিয়ায় আসক্ত ২৯ দশমিক ৫ শতাংশ শিক্ষার্থী। এর মধ্যে ১৩ শতাংশ শিক্ষার্থী আবার এটি ব্যবহার করছে পাঠদান চলাকালেই। যদিও বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের মোবাইল ফোন ব্যবহার নিষিদ্ধ করেছে সরকার। তবে এ নির্দেশনা বাস্তবায়নে ব্যর্থ হচ্ছেন শিক্ষকরা।

বিদ্যালয়ে ফোন নিষিদ্ধ করা হলেও শিক্ষার্থীরা লুকিয়ে ব্যবহার করছে বলে জানান শিক্ষকরা। রাজারবাগ পুলিশ লাইনস স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ মো. লিয়াকত আলী বলেন, নিয়ম অনুযায়ী আমাদের প্রতিষ্ঠানে স্মার্টফোন ব্যবহার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। এর পরও কিছু শিক্ষার্থী স্কুলে ফোন নিয়ে আসছে। মাঝে মধ্যে শিক্ষকরা কিছু শিক্ষার্থীকে মোবাইলসহ চিহ্নিত করেন। প্রতিদিন তো মনিটরিং করা সম্ভব নয়। শুধু স্কুলে নয়; বাড়িতেও তারা অধিকাংশ সময় সোস্যাল মিডিয়ায় ব্যয় করছে। অনেক অভিভাবকই অভিযোগ করেন, তার সন্তান দরজা বন্ধ করে ফেসবুক কিংবা ইউটিউবে সময় কাটাচ্ছে, যা তাদের পড়ালেখায় মারাত্মকভাবে ক্ষতি করছে।

সোস্যাল মিডিয়া ব্যবহারে মাধ্যমিক শিক্ষার্থীদের পড়ালেখায় ক্ষতির বিষয়টি উঠে এসেছে নায়েমের প্রতিবেদনেও। জরিপে অংশ নেয়া ৬৩ শতাংশ শিক্ষার্থীই বলেছে, সোস্যাল মিডিয়ার ব্যবহার তাদের পড়ালেখার ওপর নেতিবাচক প্রভাবে ফেলছে। তাদের ভাষ্য, যে সময়টুকু এখন তারা ফেসবুক কিংবা অন্যান্য সাইটে ব্যয় করছে, আগে এ সময়ে তারা পড়ালেখা করত। এমনকি সোস্যাল মিডিয়া ব্যবহার তাদের বাড়ির কাজেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে বলে জানিয়েছে ৩১ শতাংশ শিক্ষার্থী। এ কারণে সময়মতো অ্যাসাইনমেন্টও জমা দিতে পারছে না তারা।

ফেসবুকে দৈনিক কমপক্ষে ৫ ঘণ্টা সময় ব্যয় করে রাজধানীর একটি বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণীর শিক্ষার্থী আফরাজুল ইসলাম অনিক। এক বছর পর এসএসসি পরীক্ষায় বসতে হবে তাকে। যদিও পরীক্ষার প্রস্তুতির চেয়ে সোস্যাল মিডিয়া নিয়েই বেশি ব্যস্ততা তার। এ নিয়ে উদ্বিগ্ন তার পরিবারের সদস্যরা।

অনিকের বড় ভাই আফসারুল ইসলাম বলেন, ‘ও সোস্যাল মিডিয়া, বিশেষ করে ফেসবুকে এত বেশি আসক্ত হয়ে পড়েছে যে আমরা সবাই ওকে নিয়ে উদ্বিগ্ন। বোঝালে কিছুদিন কম ব্যবহার করে। কয়েক দিন পরই আবার একই কাজ করে। ইদানীং ক্লাস পরীক্ষাগুলোয় খারাপ করছে।’

শিক্ষার্থীরা সোস্যাল মিডিয়ায় কী পরিমাণ সময় ব্যয় করে, সে তথ্যও সংগ্রহ করেছে নায়েম। এ বিষয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১৪ শতাংশ শিক্ষার্থী দৈনিক ৩ ঘণ্টার বেশি সময় সোস্যাল মিডিয়ায় ব্যয় করে। এছাড়া দৈনিক ১-২ ঘণ্টা ব্যবহার করে ২১ শতাংশ ও ন্যূনতম ১ ঘণ্টা সময় সোস্যাল মিডিয়ায় কাটায় মাধ্যমিক পর্যায়ের ৬৫ শতাংশ শিক্ষার্থী।

এক্ষেত্রে অভিভাবকদেরও দায় আছে বলে মনে করেন গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী। তিনি বলেন, শ্রেণীকক্ষের পাঠদান, বন্ধুদের সঙ্গে খেলাধুলা, গ্রুপ স্টাডির মধ্য দিয়েই বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের সময় কাটত আগে। সময়ের পরিবর্তনে বদলে যাচ্ছে শিক্ষার্থীদের সময় কাটানোর ধরন। শিক্ষার্থীরা এখন সোস্যাল মিডিয়ায় আসক্ত হয়ে পড়ছে। এক্ষেত্রে অভিভাবকরা দায় এড়াতে পারে না। কারণ শিক্ষার্থীরা যে ডিভাইসটির মাধ্যমে এ জগতের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে, সেটি সরবরাহ করা হচ্ছে পরিবার থেকেই। ছেলেমেয়ের আবদার রাখতে গিয়ে মা-বাবা তাদের মোবাইল ফোন কিনে দিচ্ছে। এ সমস্যা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে সচেতনতার মাধ্যমে। শিক্ষার্থীদের বোঝাতে হবে, এখন পড়ালেখার সময়। যখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অংশগ্রহণের প্রয়োজন হবে, তখন তারাও সেটি করতে পারবে।

মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা কোন ধরনের সোস্যাল মিডিয়া ব্যবহার করছে, সে তথ্যও উঠে এসেছে নায়েমের জরিপে। শিক্ষার্থীরা সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করছে ফেসবুক। অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলেও একই তথ্য পাওয়া গেছে। আগারগাঁও তালতলা সরকারি কলোনি উচ্চ বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণীর এক শিক্ষার্থীর অভিভাবক নজরুল ইসলাম তার মেয়ের শিক্ষা নিয়ে বেশ চিন্তিত। তিনি বলেন, ‘আমার মেয়ে মাত্র নবম শ্রেণীতে পড়ছে। জেএসসি পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করায় একটি স্মার্টফোন আবদার করে আমার শ্বশুরের কাছে। নাতনির আবদার রাখতে তিনি সেটা কিনেও দেন। অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত আমার মেয়ে পড়ালেখায় বেশ মনোযোগী ছিল। কিন্তু গত দুই মাসে সে অনেক বদলে গেছে। এখন পড়ালেখার চেয়ে বেশি সময় যাচ্ছে মোবাইলে।

শুধু পড়ালেখা নয়, অধিক সময় ধরে মোবাইল ফোন ব্যবহারের ফলে শারীরিক ও মানসিক সমস্যার ঝুঁকিতেও পড়ছে শিক্ষার্থীরা।

এ প্রসঙ্গে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মেখলা সরকার বলেন, ‘সোস্যাল মিডিয়ায় অধিক সময় ব্যয়ের ফলে পড়ালেখার বাইরেও নানাভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে শিক্ষার্থীরা। কীভাবে মানুষের সঙ্গে মিশতে হয়, একজন শিক্ষার্থী সেটি স্কুল থেকেই শেখে। যদিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অধিক সময় ব্যয়ের কারণে শিক্ষার্থীরা এ সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এতে সামাজিকীকরণ ব্যাহত হচ্ছে। বাস্তব জগত থেকে তারা একটি ভার্চুয়াল জগতে জড়িয়ে পড়ছে। এটি একজন শিক্ষার্থীর জন্য ঝুঁকিও। সোস্যাল মিডিয়ায় তারা যেসব সম্পর্কে জড়ায়, এর বেশির ভাগই ফেক।

তিনি আরো বলেন, অনেক সময় ধরে মোবাইল ব্যবহারের কারণে তাদের ফিজিক্যাল মুভমেন্টও কম হয়। অনেকক্ষণ ধরে স্থির হয়ে বসে কিংবা শুয়ে থাকে। দীর্ঘক্ষণ ঘাড় বাঁকা করে রাখে। এতে তারা শারীরিকভাবেও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

শিশু-কিশোরদের মধ্যে সোস্যাল মিডিয়া ব্যবহারের কুফল নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে বিশ্বব্যাপী। গত বছর একদল মার্কিন শিশুকল্যাণ বিশেষজ্ঞ ফেসবুকের প্রতিষ্ঠাতা মার্ক জাকারবার্গের কাছে একটি চিঠি লেখেন। এতে তারা ‘মেসেঞ্জার কিডস’ নামে শিশুদের মেসেজিং অ্যাপটি বন্ধ করে দেয়ার আহ্বান জানান। ফান্স সরকার কয়েক মাস আগে সে দেশের বিদ্যালয়ে স্মার্টফোন ব্যবহার বন্ধে আইন পাস করেছে। ফ্রান্সের পার্লামেন্টে অনুমোদন দেয়া এ আইন অনুযায়ী, ১৫ বছরের নিচে কোনো শিশু বিদ্যালয়ে স্মার্টফোন, ট্যাবলেট কিংবা ইন্টারনেট সংযুক্ত ডিভাইস আনতে পারবে না।

শিখন-শেখানো কার্যক্রম ব্যাহত হওয়ায় ২০১৭ সালে শ্রেণীকক্ষে মোবাইল ফোন ব্যবহার নিষিদ্ধ করে বাংলাদেশও। যদিও স্কুলপর্যায়ে এর বাস্তবায়ন হচ্ছে খুবই কম।

নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও বিদ্যালয়ে মোবাইল ফোন ব্যবহার, এমনকি সোস্যাল মিডিয়া ব্যবহার বিষয়ে জানতে চাইলে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের মাধ্যমিক শাখার পরিচালক অধ্যাপক ড. মো. আবদুল মান্নান বলেন, স্কুলে মোবাইল ফোন নিষিদ্ধ করে মাউশির যে আদেশ, সেটি বাস্তবায়নের দায়িত্ব শিক্ষকদের। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করতে তরুণ শিক্ষার্থীদের ভালো লাগবে, এটাই স্বাভাবিক। এটি তাদের খুব সহজেই আকৃষ্ট করে। তবে শিক্ষকদের দায়িত্ব হচ্ছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারে শিক্ষার্থীদের নিরুৎসাহিত করা। এটি ব্যবহারের ফলে তাদের সময় অপচয়সহ মানসিক বিকাশের ক্ষেত্রে যেসব প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে, শিক্ষার্থীদের তা ভালো ব্যবহারের মাধ্যমে বোঝাতে হবে। জোরজবরদস্তি করে এটি বন্ধ করা যাবে না। এছাড়া শিক্ষকদের উচিত অংশগ্রহণমূলক পাঠদানের মাধ্যমে শ্রেণীকক্ষকে আনন্দদায়ক করে গড়ে তোলা, যাতে শিক্ষার্থীরা অন্যদিকে মনোযোগের সুযোগ না পায়। পাশাপাশি কম বয়সী ছেলেমেয়েদের হাতে মোবাইল ফোন তুলে দেয়ার ক্ষেত্রে মা-বাবাদেরও আরো বেশি সচেতন হওয়ার প্রয়োজন রয়েছে।

শিক্ষার্থীদের সোস্যাল মিডিয়া ব্যবহার বিষয়ে কয়েকটি সুপারিশ করা হয়েছে নায়েমের ওই প্রতিবেদনে। এর মধ্যে রয়েছে বিদ্যালয়গুলোর গ্রন্থাগারগুলোয় জনপ্রিয় বই, জার্নাল ও ভ্রমণকাহিনী সংগ্রহ রাখা, যাতে শিক্ষার্থীরা গ্রন্থাগারমুখী হয়; সরকারকে সোস্যাল মিডিয়ায় অংশগ্রহণের বয়সসীমা নির্ধারণ করে দেয়া এবং অভিভাবকদের পক্ষ থেকে শিক্ষার্থীদের সচেতন করে তোলা।

 

সূত্র: বণিক বার্তা

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button