কালীগঞ্জে ব্যাটারি পুড়িয়ে সীসা উৎপাদনের অবৈধ কারখানা, অভিযোগ করেও প্রতিকার নেই!

গাজীপুর কণ্ঠ ডেস্ক : কালীগঞ্জ পৌরসভার বালীগাঁও গ্রামে শীতলক্ষ্যা নদীর তীরবর্তী এলাকায় একটি কারখানায় অবৈধভাবে ব্যাটারি পুড়িয়ে সীসা উৎপাদনের কাজ করা হয়। কারখানা থেকে নির্গত হয় বিষাক্ত কালো ধোঁয়া। তাতে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন স্থানীয়রা। কারখানার অপসারিত বর্জে শীতলক্ষ্যা নদীর পানি বিষাক্ত হয়ে মাছসহ বিভিন্ন জলজ প্রাণী মারা যাচ্ছে।

এছাড়াও এলাকাবাসী ও গবাদী পশু চর্মরোগ, শ্বাসকষ্ট, ক্যান্সারসহ বিভিন্ন রোগে ভোগছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

কারখানা থেকে নির্গত ক্ষতিকর ও বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ ওই এলাকার পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলছে।

এ বিষয়ে গত ২৬ নভেম্বর জেলা প্রশাসন ও জেলা পরিবেশ অধিদপ্তরে লিখিত অভিযোগ করেও কোন প্রতিকার পায়নি বলে জানিয়েছে এলাকাবাসী।

লিখিত অভিযোগ সূত্রে জানা যায়, কালীগঞ্জ পৌরসভার বালীগাঁও গ্রামে গত দুই বছর পূর্বে দড়িসোম গ্রামের রফিকুল ইসলাম সিজুর মালিকানাধীন জমি ভাড়া নিয়ে ‘এইচ কিউ লিড ফ্যাক্টরী লিমিটেড’ নামে একটি অবৈধ কারখানা গড়ে তুলেছে কতিপয় স্বার্থান্বেষী মানুষ। ওই কারখানায় পুরাতন ব্যাটারি আগুনে পুড়িয়ে ব্যাটারির সিসা গলে বিষাক্ত ধোঁয়ার সৃষ্টি করছে। এতে প্রতিদিন পুরো এলাকায় এসিডের প্রকট গন্ধ ও সিসার বিষাক্ত ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে মানুষ, গবাদি পশু-পাখি ও ফসল নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। কারখানা থেকে নির্গত ক্ষতিকর ও বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থে এলাকায় পাখি, ফল ও ফলজ গাছ এবং কৃষকের ক্ষেতের ফসল মরে যেতে দেখা গেছে। এ ব্যাপারে বিভিন্ন সময় প্রশাসনের কাছে অভিযোগ করেও স্থায়ী কোন প্রতিকার মিলেনি। ইতিপূর্বে স্থানীয় প্রশাসনকে বিষয়টি অবহিত করলে প্রশাসন মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে কারখানাটি বন্ধ করে বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়। কিন্তু অদৃশ্য ক্ষমতাবলে তা পুনরায় পরিচালিত হচ্ছে। বর্তমানে অবৈধ এ কারখানাটির কারণে এলাকাবাসীর মধ্যে চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে। অচিরেই অবৈধ এ কারখানাটি বন্ধ না হলে মারাত্বক পরিবেশ বিপর্যয় ঘটবে। এমতাবস্থায়, জনস্বার্থে ও প্রাকৃতিক পরিবেশ রক্ষার্থে জরুরী ভিত্তিতে তদন্তপূর্বক ‘এইচ কিউ লিড ফ্যাক্টরী লিমিটেড’ নামে অবৈধ প্রতিষ্ঠানটি চিরস্থায়ী ভাবে বন্ধের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের দাবী জানায় স্থায়ীয়রা।

এসকল বিষয় উল্লেখ করে গত ২৬ নভেম্বর ১২৩ জন ভুক্তভোগী স্বাক্ষরিত লিখিত একটি অভিযোগ গাজীপুর জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের অভিযোগ শাখায় এবং জেলা পরিবেশ অধিদপ্তরে দাখিল করেন বালীগাঁও গ্রামের মোঃ মনির হোসেন, ইকবাল হোসেন, আবুল হোসেন, আসলাম মিয়া এবং ছানাউল্লাহ।

সরেজমিনে দেখা যায়, প্রাচীরবেষ্টিত একটি উঁচু টিনের ঘর। এর মধ্যে দুইটি উঁচু চিমনি। কোনো সাইনবোর্ড না থাকলেও কাছে গেলেই বোঝা যায়, ভেতরে রয়েছে একটি কারখানা। এখানে পুরনো ব্যাটারি পুড়িয়ে সীসা উৎপদনের কাজ চলছে রাতদিন। কারখানা থেকে বের হচ্ছে বিষাক্ত কালো ধোঁয়া। তা ছড়িয়ে পড়ছে চারদিকে। এই ধোঁয়ার কারণে আশপাশের এলাকায় নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হয়। বিভিন্ন রোগে আক্রান্তও হচ্ছে মানুষ। বিশেষ করে শিশুরা অসুস্থ হয়ে পড়ছে। ওই কারখানার কারণে ব্যাটারির এসিডের প্রকট গন্ধে স্থানীয় লোকজন অতিষ্ঠ।

স্থানীয়রা জানান, ব্যাটারির ধোঁয়া ঘাসের ওপর পড়ে। আর সেই ঘাস গবাদী পশু খেলেই বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়। এছাড়া আম, কাঁঠাল ও বিভিন্ন ফলমূলেরও ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে বলে অভিযোগ তাদের। এছাড়াও ফ্যাক্টরীর অপসারিত বর্জে শীতলক্ষ্যা নদীর পানি বিষাক্ত হয়ে মাছসহ বিভিন্ন জলজ প্রাণী মারা যায়। এলাকাবাসী ও গবাদী পশু চর্মরোগ, শ্বাসকষ্ট, ক্যান্সারসহ বিভিন্ন রোগে ভোগছে বলে অভিযোগ তাদের। তারা কারখানাটি দ্রুত বন্ধ করতে প্রশাসনের প্রতি আহ্বান জানান।

সিসা তৈরির সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা জানান, কারখানার ভেতরে গর্ত করে মাটির চুলার মতো চুল্লি বানানো হয়েছে। পরিত্যক্ত ব্যাটারির কোষগুলো সিমেন্টের মতো জমাট বেঁধে যায়। চুল্লির মধ্যে কাঠ ও কয়লা দিয়ে পরতে পরতে এসিড মিশ্রিত জমাট বাঁধা বর্জ্য সাজানো হয়। এরপর আগুন ধরিয়ে দিয়ে একটি পাম্পের মাধ্যমে বৈদ্যুতিক পাখা দিয়ে প্রচণ্ড বেগে বাতাস দেওয়া হয়। কাঠ ও কয়লা পুড়ে একটি আগুনের কুণ্ডলী সৃষ্টি হয়। সিসা পুড়ে তরল হয়। এরপর একটি লম্বা চামচ দিয়ে বর্জ্য সরিয়ে সিসা লোহার তৈরি কড়াইতে রাখা হয়। ঘন ধূসর ধোঁয়া চিমনি দিয়ে বের হয়ে যায়।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কারখানার এক শ্রমিক বলেন, দিনে দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে সংগৃহীত ব্যাটারি থেকে প্লেট খোলা ও এসিড সংরক্ষণের কাজ করা হয়। আর রাতে প্লেটসহ আনুষঙ্গিক জিনিস পুড়িয়ে সিসা তৈরি করা হয়। বাস ও ট্রাকের একটি পরিত্যক্ত ব্যাটারি থেকে গড়ে ২২-২৩ কেজি এবং ইজিবাইকের পরিত্যক্ত ব্যাটারি থেকে ৬-২৩ কেজি পর্যন্ত সিসা পাওয়া যায়। ব্যাটারির ওপরের অংশ প্লাস্টিক দ্রব্য তৈরিতে কাজে লাগে, যা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছে বিক্রি করেন তারা। উৎপাদিত সিসা তারা বাংলাদেশের বিভিন্ন চায়না ফ্যাক্টরিতে বিক্রি করে।

২০১৯ সালের ১৭ জানুয়ারি নদী দখলের অভিযোগে উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করে ফ্যাক্টরিটি বন্ধ করা হয়েছিল।

ভুক্তভোগী মনির হোসেন, ইকবাল হোসেন ও আসলাম মিয়া বলেন, ‘এইচ কিউ লিড ফ্যাক্টরী লিমিটেড’ কারখানায় প্রতিদিন সন্ধ্যার পর থেকে ভোর পর্যন্ত ব্যাটারির প্লেটসহ আনুষঙ্গিক জিনিস পুড়িয়ে সিসা তৈরি করা হয়। কারখানা থেকে নির্গত বিষাক্ত কালো ধোঁয়ায় বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে আমাদের এলাকাবাসী। এমনকি আক্রান্ত হচ্ছে জমির ফসলও। কারখানার অপসারিত বর্জে শীতলক্ষ্যা নদীর পানি বিষাক্ত হয়ে মাছসহ বিভিন্ন জলজ প্রাণী মারা যাচ্ছে। এলাকাবাসী ও গবাদী পশু চর্মরোগ, শ্বাসকষ্ট, ক্যান্সারসহ বিভিন্ন রোগে ভোগছে। এ বিষয়ে গত ২৬ নভেম্বর জেলা প্রশাসন ও জেলা পরিবেশ অধিদপ্তরে লিখিত অভিযোগ করেও স্থায়ী কোন প্রতিকার পাইনি’।

তারা আরো বলেন, ‘মঙ্গলবার (৮ ডিসেম্বর) বিকেলে কালীগঞ্জে উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) শিবলী সাদিক এসে অবৈধভাবে ব্যাটারি পুড়িয়ে সীসা উৎপাদনের কাজ বন্ধ করে কারখানাটি বন্ধের নির্দেশ দেন। কিন্তু রাত থেকেই পূনরায় কাজ শুরু করে কারখানা কর্তৃপক্ষ’।

কারখানাটি স্থায়ীভাবে দ্রুত বন্ধ করতে প্রশাসনের প্রতি আহ্বান জানান তার।

চিকিৎসকেরা বলছেন, এ ধরনের পদার্থ মানুষের শ্বাসকষ্ট, হৃদ্রোগ ও ক্যানসারের মতো রোগের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। আর কোনো পশু কারখানার আশপাশের ঘাস খেলে অসুস্থ কিংবা মারাও যেতে পারে।

এসকল অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে ‘এইচ কিউ লিড ফ্যাক্টরী লিমিটেড’র ব্যবস্থাপক আরিফ চৌধুরীর মুঠোফোনে একাধিক বার কল করলেও তার সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।

গাজীপুর জেলা প্রশাসনের সহকারী কমিশনার (তথ্য ও অভিযোগ শাখা) আশিক উর রহমান বলেন, ‘অভিযোগের কপি এখনো হাতে পাইনি। খোঁজ নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে’।

গাজীপুর পরিবেশ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. আব্দুস সালাম সরকার বলেন, ‘অভিযোগ পেয়েছি। এ ব্যাপারে শীঘ্রই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে’।

কালীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) শিবলী সাদিক বলেন, ‘স্থানীয়দের অভিযোগের ভিত্তিতে মঙ্গলবার বিকেলে কারখানাটি পরিদর্শন করে তাদের সকল কার্যক্রম বন্ধের নির্দেশ দেয়া হয়েছে’।

উল্লেখ্য: ২০১৯ সালের ১৭ জানুয়ারি নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মোস্তাফিজুর রহমানের নেতৃত্বে বিআইডব্লিউটিএ উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করে নদীর জমি দখলের অভিযোগে ফ্যাক্টরিটি বন্ধ করে দিয়েছিল।

এছাড়াও অবৈধভাবে পরিচালিত ‘এইচকিউ লিড’ নামের ওই ব্যাটারি ফ্যাক্টরিতে বিভিন্ন সময় মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করে পরিবেশ দূষণের দায়ে ফ্যাক্টরিটি বন্ধ করেছিল উপজেলা প্রশাসন।

এরপরও অবৈধভাবে পরিচালনা করে আসছে কারখানাটি। এতে চরমভাবে ওই এলাকার পরিবেশ দূষিত এবং কারখানার দূষিত বর্জ্যের কারণে শীতলক্ষ্যা নদী দূষিত হচ্ছে।

 

 

এ সংক্রান্ত আরো জানতে……..

কালীগঞ্জে অবৈধ ব্যাটারি ফ্যাক্টরিতে ডাকাতদের হামলা, শর্টগান লুট, গানম্যান আহত

অবৈধ ব্যাটারি ফ্যাক্টরিতে মোবাইল কোর্টের অভিযান: ১ লক্ষ ৫০ হাজার টাকা জরিমানা

প্রশাসনের হস্তক্ষেপে অবশেষে “সাময়িকভাবে বন্ধ” অবৈধ ব্যাটারি ফ্যাক্টরি

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button