ফাঁসির অপেক্ষায় কনডেম সেলে ১৬৫৪ আসামি
গাজীপুর কণ্ঠ ডেস্ক : দেশের কারাগারগুলোতে ৪৫ জন নারী আসামিসহ ১৬৫৪ আসামি কনডেম সেলে ফাঁসির প্রহর গুনছে। সর্বশেষ রবিবার রাতে (রাত ১০টায় ফাঁসির রায় কার্যকর হওয়ার কথা) কাশিমপুর হাইসিকিউরিটি কেন্দ্রীয় কারাগারে ফাঁসির রায় কার্যকর করা হয় সৌদি আরব দূতাবাসের কর্মকর্তা খালাফ আলি হত্যা মামলার আসামি সাইফুল ইসলামের।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিডিআর বিদ্রোহ ও সাত খুনের মামলার মতো বড় মামলার রায়ে কনডেম সেলে আসামি বেড়েছে। পাশাপাশি হাইকোর্টে ডেথ রেফারেন্স মামলার শুনানিতে সময় বেশি লাগার কারণেও কনডেম সেলে আসামির সংখ্যা বেড়েছে। কনডেম সেলে থাকা নারী আসামির সংখ্যাও বেড়েছে। তবে কারাগারের কোনো নারী আসামির ফাঁসি কার্যকর হওয়ার নজির নেই।
কারা অধিদপ্তরের সহকারী মহাপরিদর্শক আমিরুল ইসলাম জানান, রবিবার সকাল পর্যন্ত দেশের ১৩টি কেন্দ্রীয় কারাগার ও ৫৫টি জেলা কারাগারের কনডেম সেলে থাকা আসামির সংখ্যা ১৬৫৪ জন। তাদের মধ্যে ১৬০৯ জন পুরুষ ও ৪৫ জন নারী। আদালতের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী
প্রতিদিনই এই সংখ্যা কম বেশি হয়। আগামী এক বছরের মধ্যে কত আসামির ফাঁসির রায় কার্যকর হতে পারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটা সম্পূর্ণ আদালতের বিষয়। আদালত থেকে যখন মৃত্যু পরোয়ানা হাতে পায় তখনই কারা কর্র্তৃপক্ষ রায় কার্যকর করার পদক্ষেপ নেয়।
কারা অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা আলাপকালে জানান, ফাঁসির আসামিকে যে সেলে রাখা হয় তার নাম ‘কনডেম সেল’। প্রতিটি সেল কমবেশি ১০ হাত দৈর্ঘ্য ও ছয় হাত প্রস্থ। সেলে তিন-চারজন করে ফাঁসির আসামিকে রাখা হয়। প্রতিটি সেলে শক্ত গ্রিল ঘেরা বারান্দা রয়েছে। ওই বারান্দাতেই কনডেম সেলের বন্দিরা হাঁটার সুযোগ পায়। দিন-রাত ২৪ ঘণ্টা থাকতে হয় সেলের ভেতর ও বারান্দায়। প্রতিদিন দুপুরে গোসলের জন্য তাদের সেলের বাইরে আসার সুযোগ দেওয়া হয়। গোসলখানার আশপাশে প্রত্যেকে ১৫ থেকে ২০ মিনিট হাঁটার সুযোগ পায়। এভাবেই মাসের পর মাস বছরের পর বছর কেটে যায় কনডেম সেলের ফাঁসির আসামিদের।
ওই কর্মকর্তা আরও জানান, কনডেম সেলের আসামিরা মাসে এক দিন তাদের আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে দেখা করার সুযোগ পায়। ওই সময় কনডেম সেল থেকে বেরিয়ে কারাগারের গেটে স্বজনের সঙ্গে দেখা করে। কনডেম সেলে থাকা আসামিরা একটি করে থালা, বাটি ও কম্বল পায়। এর বাইরে তাদের জন্য কোনো ধরনের সুযোগ-সুবিধা নেই। এমনকি তাদের সেলে কোনো টেলিভিশন বা রেডিও রাখার সুযোগ নেই।
কারা অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা জানান, ২০১০ সালে কারাগারের কনডেম সেলে আসামি ছিল এক হাজারের কম। ২০১৫ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১ হাজার ২০০। পরে ২০১৮ সালের শেষদিকে ফাঁসির আসামি ছিল ১ হাজার ৬৭১ জন। আর সর্বশেষ গতকাল ছিল ১ হাজার ৬৫৪ জন।
আইনজীবীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নিম্ন আদালতে মৃত্যুদণ্ড পাওয়া আসামির মৃত্যুদ- অনুমোদনের (ডেথ রেফারেন্স) জন্য হাইকোর্টে পাঠানো হয়। ডেথ রেফারেন্স মামলার নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত আসামিকে কারাগারের কনডেম সেলে রাখা হয়। হাইকোর্টে একটি ডেথ রেফারেন্স মামলা নিষ্পত্তি হলেও সেটি আপিল বিভাগে যায়। আপিল বিভাগে শুনানির অপেক্ষায় থাকায় কনডেম সেলে আসামি রাখার মেয়াদ বাড়তে থাকে।
সম্প্রতি কনডেম সেলে ফাঁসির আসামি বৃদ্ধির বিষয়ে কারাগারের এক কর্মকর্তা জানান, আলোচিত কিছু মামলার রায় হওয়ার কারণে কনডেম সেলে আসামির সংখ্যা কিছুটা বেড়েছে। এর মধ্যে পিলখানা হত্যা মামলায় ১৩৯ জন আসামিকে মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখা হয়েছে। যার মধ্যে ১৪ জন পলাতক। আর বর্তমানে কনডেম সেলে রয়েছে বিডিআর মামলার ১২৫ আসামি। একইভাবে নারায়ণগঞ্জের বহুল আলোচিত সাত খুনের মামলায় নারায়ণগঞ্জের সাবেক কাউন্সিলর নূর হোসেন এবং র্যাবের সাবেক তিন কর্মকর্তা তারেক সাঈদ, আরিফ হোসেন, এম মাসুদ রানাসহ মৃত্যুদণ্ড পাওয়া ১৫ আসামি কনডেম সেলে আছে।
উচ্চ আদালতে ডেথ রেফারেন্স মামলা নিষ্পত্তিতে দীর্ঘসূত্রতার কারণেও কারাগারে আসামি সংখ্যা বাড়ছে। ২০১০ সালে হাইকোর্টে ৫৪২টি ডেথ রেফারেন্স মামলা বিচারাধীন ছিল। বর্তমানে এই সংখ্যা দাঁড়িয়েছে সাত শতাধিক। ২০১৫ সালে হাইকোর্টে ডেথ রেফারেন্স মামলা আসে ১১৪ এবং নিষ্পত্তি হয় ৫৮টি। ২০১৬ সালে ডেথ রেফারেন্স মামলা আসে ১৬১টি আর নিষ্পত্তি হয় ৪৫টি। ২০১৭ সালে ডেথ রেফারেন্স মামলা আসে ১৭১টি এবং নিষ্পত্তি হয়েছে মাত্র ৬৬। একইভাবে ২০১৮ সালে ডেথ রেফারেন্স মামলা এন্ট্রি হয়েছে ১৫৪টি এবং নিষ্পত্তি হয় মাত্র ৮৩টি। এভাবে দায়েরের তুলনায় নিষ্পত্তি কম হওয়ায় দিনে দিনে ডেথ রেফারেন্স মামলা বেড়েছে।
অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, ‘ডেথ রেফারেন্স মামলা শুনানির এখতিয়ারসম্পন্ন বেঞ্চ বাড়ানো দরকার। এজন্য প্রয়োজন দক্ষ ও ফাঁসির মামলা পরিচালনা করার অভিজ্ঞতাসম্পন্ন আরও বিচারক। যাতে এসব মামলা দ্রুততার সঙ্গে বিচার সম্পন্ন করা যায়।’
ফাঁসি হয়নি কোনো নারী আসামির : কারা অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, স্বাধীনতার পর থেকে দেশে শতাধিক নারীর ফাঁসির আদেশ হয়েছে। কিন্তু আজ পর্যন্ত কোনো নারীর ফাঁসি কার্যকর হয়নি। এদের কেউ কেউ দীর্ঘদিন কারাভোগ করার পর বেরিয়ে গেছে, কেউ কেউ মারা গেছে, কারও কারও আপিলে শাস্তি কমেছে। পারিবারিক কলহের জের ধরে নিজ পরিবারের কোনো সদস্যকে হত্যার দায়ে ফাঁসির দণ্ড পেয়েছে এদের বেশিরভাগই।
কারাগারের এক কর্মকর্তা জানান, ২০০৯ সালে সারা দেশের কারাগারগুলোতে ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত নারী আসামি ছিল ৩০ জন। গতকাল রবিবার (৩ মার্চ) ওই সংখ্যা ছিল ৪৫। এসব নারীর মামলা আদালতেই ঝুলে রয়েছে। নিয়মানুযায়ী ফাঁসির আসামিরা সর্বশেষ সুযোগ হিসেবে রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করতে পারে। আজ পর্যন্ত কোনো নারীর আবেদন রাষ্ট্রপতির কাছে গেছে বলে নজির নেই। ২০০৭ সালে কাশিমপুরে একমাত্র মহিলা কারাগার উদ্বোধন করা হয়। দেশের প্রতিটি কারাগারে ফাঁসির মঞ্চ থাকলেও সেখানে কোনো মঞ্চও নেই।