স্বাধীনতায় অবদান নিয়ে আর কত বিতর্ক হবে?
গাজীপুর কণ্ঠ ডেস্ক : নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের বিনিময়ে অর্জিত আমাদের স্বাধীনতা৷ লাখো শহিদের প্রাণের বিনিময়ে পাওয়া এক স্বাধীন দেশে বসে সেই স্বাধীনতায় কার অবদান কী ছিল তা নিয়ে আজও অহেতুক বিতর্ক চালিয়ে যাওয়া লজ্জাজনক ব্যাপার বলে আমি মনে করি৷
বাংলাদেশ স্বাধীন করতে কার কী অবদান ছিল তা নিয়ে বিতর্কের যেন শেষ নেই৷ পচাত্তরে এক সামরিক অভ্যুত্থানে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে তাঁর পরিবারের অধিকাংশ সদস্যসহ হত্যা করে একদল সেনা সদস্য৷ সেই হত্যাকাণ্ডের পর থেকে যখন যে দল ক্ষমতায় এসেছে এবং সামরিক শাসকরা নানাভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসকে নিজেদের মতো করে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন, করছেন৷
আমার মনে হয় ইতিহাস বদলের এই চেষ্টায় ইতি টানা জরুরি৷ বরং কিছু বিষয়কে প্রয়োজনে আইন করে অপরবিতর্নীয় করে রেখে সামনে আগানো উচিত৷
প্রথমত, স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান৷ স্বাধীনতাপূর্ব পূর্বপাকিস্তানের মানুষদের স্বাধীনতার জন্য সংঘবদ্ধ করেছিলেন যে ব্যক্তি, তিনি মুজিবুর রহমান৷ তাঁর নেতৃত্বেই বাংলাদেশিরা স্বাধীনতার জন্য আন্দোলন করেছেন, চূড়ান্ত লড়াইয়েই জন্য প্রস্তুত হয়েছেন৷ বাংলাদেশের স্বাধীনতায় জাতির জনকের অবদান নিয়ে তাই কোনো বিতর্কের সুযোগ থাকার কথা নয়৷
দ্বিতীয়ত, ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী বাঙালি দোসরদের সহায়তায় নিরীহ মানুষদের নির্বিচারে হত্যা শুরু করার পর সৃষ্ট দিশেহারা পরিস্থিতির মধ্যে বেতারে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে সেসময় অসীম সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছিলেন মেজর জিয়াউর রহমান৷ তাঁর সেই ঘোষণা তখনকার পরিস্থিতিতে নিঃসন্দেহে সাধারণ মানুষের মধ্যে আশার সঞ্চার করেছিল, হানাদারদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধ যে গড়ে উঠছে সেই আভাস দিয়েছিল৷ একজন সেনা কর্মকর্তা হিসেবে জিয়াউর রহমানের এই সাহসিকতাও আমাদের ইতিহাসেরই অংশ৷
সমস্যা হচ্ছে, আমাদের দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের মধ্যে স্বাধীনতা সংগ্রামে কার অবদান বেশি ছিল এবং কম ছিল তা নিয়ে ইচ্ছাকৃত বিতর্ক সৃষ্টির একটি প্রবণতা রয়েছে৷ তবে আমি মুজিবুর রহমান কিংবা জিয়াউর রহমানকে একে অপরের সঙ্গে তুলনা করার কোনো সুযোগ দেখি না৷ বরং দু’জনকে দু’জনের অবস্থানে রেখে সম্মান জানানোকেই উচিত মনে করি৷ সবচেয়ে বড় কথা, মুজিবুর রহমান পুরো বাংলাদেশি জাতির জনক, শুধুমাত্র একটি রাজনৈতিক দলের নেতা নন৷ আর জিয়াউর রহমান যে সময় স্বাধীনতার ঘোষকের ভূমিকা পালন করেছিলেন, সেসময় কোনো রাজনৈতিক পরিচয়ে পরিচিত ছিলেন না৷ তিনি গোটা দেশের স্বাধীনতাকামী মানুষের পক্ষে কথা বলেছিলেন৷ ফলে তাঁদের নিয়ে রাজনীতি না করলে তা গোটা জাতির জন্যই উত্তম৷
তৃতীয়ত, যুদ্ধাপরাধের বিচার৷ ‘আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের’ বিচারের মান নিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রশ্ন থাকতে পারে, তবে যুদ্ধাপরাধের বিচার যে সকলেই সামগ্রিকভাবে মেনে নিয়েছেন সেটা বোঝাই যায়৷ এখনও যেসব যুদ্ধাপরাধী বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়ায় নিজেদের নিরাপদ করে রেখেছেন তাদের বিচারও জরুরি৷ পাশাপাশি দল হিসেবে যুদ্ধাপরাধের দায়ে জামায়াতে ইসলামীকে পুরোপুরি নিষিদ্ধ করা হবে কিনা সেটাও দ্রুত ফয়সালা করা উচিত৷
আমাদের স্বাধীনতার প্রসঙ্গে আসলে ঘুরেফিরে উপরে উল্লিখিত তিনটি বিষয় নিয়ে আজও বিতর্ক রয়ে যাওয়াটা দুঃখজনক৷ আমাদের মনে রাখা উচিত, লাখো শহিদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত আমাদের স্বাধীনতা৷ প্রতিটি মুক্তিযোদ্ধা, বীরাঙ্গনা এই স্বাধীনতায় অসামান্য অবদান রেখেছেন৷ বাংলাদেশিদের এই অর্জন তাই কোনো একক ব্যক্তি বা দলের নিজস্ব অর্জন নয়৷ এটা গোটা জাতির অর্জন৷
যে দেশে বসে এই লেখা লিখছি, সেদেশ কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কার কর্মকাণ্ডের বিচারআচার, ক্ষতিপূরণ দেয়ার কাজ সম্পন্ন করে অনেক দূর এগিয়ে এসেছে৷ এদেশে ক্ষমতার পালাবদলের সঙ্গে সঙ্গে অতীতের ইতিহাস বদলানোর চেষ্টা হয় না৷ আসুন আমরাও তাদের মতো ইতিহাস নিয়ে অযথা ঘাঁটাঘাটি, বিতর্ক বন্ধ করে সামনে দিকে আগাই৷ একটা বিজিত দেশ হয়েও জার্মানি যা পেরেছে, একটা বিজয়ী দেশ হিসেবে আমরা তা পারবো না কেন?
আরাফাতুল ইসলাম, ডয়চে ভেলে।