দ্বিতীয় স্ত্রীর পরিকল্পনায় নামাজের জন্য ডেকে নিয়ে ছেলেকে হত্যা করে পিতা: পিবিআই
গাজীপুর কণ্ঠ ডেস্ক : দ্বিতীয় স্ত্রীর পরিকল্পনায় তিন মাস আগে এশার নামাজ পড়ার জন্য বিপ্লব আকন্দকে (১৪) বাসা থেকে সঙ্গে নিয়ে বের হয় পিতা। পরে নেশা জাতীয় ঔষধ খায়িয়ে অচেতন করে কোদাল দিয়ে তার শরীরের বিভিন্নস্থানে আঘাত করে বিপ্লব আকন্দকে হত্যা করে পিতা বাবুল হোসেন আকন্দ।
দ্বিতীয় স্ত্রীর প্রতি দুর্বলতা থেকেই নিজের প্রথম সংসারের ছেলেকে হত্যা করে বাবুল হোসেন আকন্দ।
সম্প্রতি এ ঘটনায় জড়িত ঘাতক বাবুল হোসেন আকন্দ(৪২ ও তার সহযোগী এমদাদুলকে(৩৫) গ্রেপ্তারের মাধ্যমে আলোচিত এই হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদঘাটন করেছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)।
শুক্রবার (১১ জুন) এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানিয়েছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) গাজীপুর জেলা ইউনিটের প্রধান পুলিশ সুপার মোহাম্মদ মাকছুদের রহমান।
গ্রেপ্তাররা হলো, নিহত বিপ্লব আকন্দের পিতা বাবুল হোসেন আকন্দ। তিনি গাজীপুর সদর উপজেলার পিরুজালী আকন্দপাড়া গ্রামের মৃত আমজাদ হোসেন আকন্দের ছেলে এবং একই গ্রামের হাবিবুর রহমানের ছেলে সহযোগী মো. এমদাদুল। সে বাবুল হোসেন আকন্দের ভাগ্নী জামাই।
নিহত বিপ্লব আকন্দ নারায়ণগঞ্জে একটি মাদ্রাসায় লেখাপড়া করতো।

সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে পিবিআই জানায়, তিন মাস আগে গত ৮ মার্চ রাত সোয়া ৮টার দিকে নিহত বিপ্লব আকন্দ মসজিদে নামাজ পড়ার কথা বলে ঘর থেকে বের হয়ে নিখোঁজ হয়। সে বাড়িতে ফিরে না আসায় তার মা ছেলেকে বিভিন্ন জায়গায় খোঁজাখুজি করে। পরে ৯ মার্চ সকাল ৬টার সময় সদর উপজেলার পিরুজালী বকচরপাড়া এলার জনৈক সানাউল্লাহ মুন্সির বাঁশ ঝাড়ের পাশে ফাঁকা জায়গায় বিপ্লব আকন্দের শরীরের বিভিন্ন স্থানে ধারালো অস্ত্রের আঘাতসহ লাশ পাওয়া যায়। পরবর্তীতে তার মা খাদিজা আক্তার জয়দেবপুর থানায় অজ্ঞাতনামা আসামীদের বিরুদ্ধে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন {নং-১২(০৩)২১}।
মামলাটি জয়দেবপুর থানা পুলিশ ১ মাস তদন্ত করেও রহস্য উদঘাটনে ব্যর্থ হলে পুলিশ সদর দপ্তরের নির্দেশে মামলাটি তদন্তের দায়িত্ব পায় পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) গাজীপুর জেলা ইউনিট।
দায়িত্ব পেয়ে পিবিআই প্রধান ডিআইজি বনজ কুমার মজুমদারের তত্ত্বাবধানে গাজীপুর ইউনিটের ইনচার্জ পুলিশ সুপার মোহাম্মদ মাকছুদের রহমানের সার্বিক সহযোগিতায় মামলাটি তদন্ত শুরু করেন পুলিশ পরিদর্শক মাহমুদুল হাসান।
তদন্তের এক পর্যায়ে পুলিশ পরিদর্শক মাহমুদুল হাসান গত ৯ জনু রাত সাড়ে ৩টার দিকে অভিযান পরিচালনা করে পিরুজালী আকন্দপাড়া এলাকা থেকে বাবুল হোসেন আকন্দকে এবং ১০ জুন ভোর সাড়ে ৫টার দিকে পিরুজালী এলাকা থেকে সহযোগী এমদাদুলকে গ্রেপ্তার করেন।
পিবিআই আরো জানায়, গ্রেপ্তারের পর জিজ্ঞাসাবাদে আসামীরা জানায়, বাবুল ১১/১২ বছর আগে তার আপন ছোট ভাইয়ের স্ত্রী জুলিয়াকে বিয়ে করে এবং পৈত্রিক ২ কাঠা জমি বিক্রি করে টাঙ্গাইলে জুলিয়ার বাবার বাড়িতে ঘর তৈরী করে দেয়। জুলিয়া সেখানে বিভিন্ন ছেলেদের সাথে চলাফেরা করায় বাবুল তাকে নিয়ে পিরুজালী গ্রামে বাসা ভাড়া নিয়ে বসবাস করতে থাকে। জুলিয়া প্রায়ই বাবুলের বড় স্ত্রী খাদিজারকে মারধর করত। ফলে বাবুলের প্রথম স্ত্রী খাদিজার সাথে দ্বিতীয় স্ত্রী জুলিয়ার ঝগড়া বিবাদ লেগে থাকতো। হত্যাকাণ্ডের ৩ মাস আগে বাবুলের সাথে তার দ্বিতীয় স্ত্রী ঝগড়া করে তার ছোট মেয়েকে নিয়ে বাবার বাড়ি টাঙ্গাইল চলে যায় জুলিয়া।
পরে মোবাইলে বাবুলকে তার প্রথম স্ত্রীকে তালাক দিতে বলে জুলিয়া। তালাক না দিলে সে তার ছোট মেয়েকে খুন করে বাবুল এবং তার পরিবারের সকলকে ফাঁসিয়ে দেওয়ার হুমকী দেয় জুলিয়া। বাবুল তার জুলিয়ার কথাবার্তায় সব সময় অতিষ্ঠ থাকতো।
গ্রেপ্তার এমদাদ সম্পর্কে বাবুলের ভাগ্নী জামাই। এমদাদের সাথে বাবুলের ২য় স্ত্রীর জুলিয়ার গোপন সম্পর্ক ছিল। যা এমদাদ প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করে। এই সম্পর্কের সুযোগে বাবুলের দ্বিতীয় স্ত্রী জুলিয়া এমদাদকে বিভিন্ন পরামর্শ দিত যাতে করে বাবুলে প্রথম স্ত্রীকে ঘর ছাড়া করা যায়।
হত্যাকাণ্ডের ১০ দিন আগে জুলিয়া পিরুজালী এসে এমদাদের সাথে দেখা করে বাবুলের প্রথম সংসারের ছেলে বিপ্লবকে হত্যা করার জন্য বাবুলকে রাজী করাতে বলে। ঘটনার কয়েকদিন আগে বাবুল এমদাদকে জানায় তার ছোট ছেলে বিপ্লবকে হত্যা করতে হবে এবং বাবুলকে তার কথা শুনতে বলে। পরবর্তীতে বাবুল এমদাদুলের পরামর্শে তার ছোট ছেলে বিপ্লব আকন্দকে খুন করার পরিকল্পনা করে। কারণ আসামী বাবুল তার দ্বিতীয় স্ত্রীর প্রতি খুবই দুর্বল ছিল।
পিবিআই জানায়, নিহত বিপ্লব আকন্দ নারায়নগঞ্জের মাদ্রাসা থেকে বাসায় ছুটিতে আসাে। এর কয়েকদিন পরে গত ৮ মার্চ রাতে বাবুল তার ছেলে বিপ্লবকে নিয়ে এশার নামাজ পড়ার জন্য বাসা থেকে বের হয়। সে সময় বাবুল তার ছোট স্ত্রীকে তাবিজ করার কথা বলে ছেলে বিপ্লবকে প্রতিবেশী খালেকের বাসা থেকে একটি কোদাল আনার জন্য বলে। বিপ্লবের শরীরিক গঠন ভালো থাকায় এমদাদ পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী সেভেন আপের সাথে নেশা জাতীয় ঔষধ মিশিয়ে তাকে খাওয়ায়। পরে বাবুল তার ছেলে বিপ্লবকে নিয়ে পিরুজালী বকচরপাড়া সানাউল্লাহ মুন্সির বাঁশ ঝাড়ের পাশে ফাঁকা জায়গায় নিয়ে যায়। এর কিছুক্ষণ পর বিপ্লব ঝিমিয়ে পড়তে থাকে এবং বাড়ি যাওয়ার কথা বলে মাটিতে শুয়ে পড়ে। ওই সময় বাবুল তার হাতে থাকা কোদাল দিয়ে বিপ্লবের গলায় কোপ দেয়। বিপ্লব লাফিয়ে উঠার চেষ্টা করলে বাবুল পূনরায় কোদাল দিয়ে তার শরীরের বিভিন্নস্থানে আঘাত করে মৃত্যু নিশ্চিত করে এবং কোদালটি পাশে ঢাকাইয়ার ধানের জমিতে ফেলে বাসায় চলে যায়। পরে এমদাদ বাবুলের কথামত কোদালটি সেখান থেকে নিয়ে তার বাসায় লুকিয়ে রাখে।
পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) গাজীপুর জেলা ইউনিটের প্রধান পুলিশ সুপার মোহাম্মদ মাকছুদের রহমান বলেন, ”বাদী খাদিজা আক্তার তার স্বামীর প্রথম স্ত্রী। আনুমানিক ১১/১২ বছর আগে বাবুল তার আপন ছোট ভাইয়ের স্ত্রীকে ফুসলিয়ে দ্বিতীয় বিয়ে করে এবং ছোট স্ত্রীর ২ মেয়েকে নিয়ে নিজের গ্রামে আলাদা বাসা ভাড়া নিয়ে বসবাস করত। মূলত পারিবারিক কলহের জের ধরে ঘটনার দিন বাবুল কোদাল দিয়ে বিপ্লব আকন্দের গলা ও শরীরের বিভিন্ন স্থানে আঘাত করে নিজের ঔরসজাত সন্তানকে নির্মমভাবে হত্যা করে। গ্রেপ্তার এমদাদের বাড়ী থেকে হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত কোদালটি উদ্ধার করা হয়।”
”গ্রেপ্তার বাবুল এবং এমদাদুলকে আদালতে পাঠানো হলে তারা ঘটনার দায় স্বীকার করে স্বেচ্ছায় ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে।”