মামলার কত রঙ্গ!
গাজীপুর কণ্ঠ ডেস্ক : এক দেশে কত রকমের মামলা হয়! আইনের অপব্যবহার করে ব্যক্তিগত বা রাজনৈতিক স্বার্থে এসব মামলা করে হয়রানি করা হয়।
একজন কৃষক। রক্ত পানি করা পরিশ্রমে ফসল ফলান। সেই ফসল আমাদের খাদ্যের যোগান দেয়। অথচ সেই কৃষকের ঘরে হয়তো খাবার নেই। তার ওপর যদি এই গরিব মানুষটিকে ভুয়া মামলায় জড়িয়ে ফেলা হয়? যেমন হয়েছে গাজীপুরের কৃষক আবদুল আজিজের বেলায়। আটটি মামলায় তাঁকে ১০০ দিন জেলে থাকতে হয়।
প্রথম আলোর ১৮ মার্চের প্রতিবেদনে দেখা যায়, কাশিমপুর কারগারে থাকা অবস্থায় তাঁকে চট্টগ্রাম কোতোয়ালি থানার চারটি মামলায়, রাজধানীর মিরপুর থানার একটি মামলায়, জামালপুরের বক্সীগঞ্জ থানার একটি মামলায় ও মাদারীপুর সদর থানার একটি মামলায় পরোয়ানার মাধ্যমে গ্রেফতার দেখানো হয়। এসব মামলায় তাঁকে চট্টগ্রাম কারাগার, মাদারীপুর কারাগার ও জামালপুর কারাগারে থাকতে হয়। সবশেষ ছিলেন কেরানীগঞ্জে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে।
‘‘আজিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, কোনো একটি মহল ভুয়া পরোয়ানা তৈরি করে তাঁকে হয়রানি করেছেন। কিন্তু সব কটি গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ভুয়া বলে প্রমাণিত হলে আদালত ওই সব মামলা থেকে তাঁকে মুক্তি দিয়েছেন। আদালতের নির্দেশে ১০০ দিন হাজত খাটার পর গত বছরের ১২ জুন তিনি মুক্তি পান। ছাড়া পেয়ে হয়রানির প্রতিকার চেয়ে গত বছরের ৩ জুলাই পুলিশের মহাপরিদর্শকের (আইজিপি) কাছে লিখিত অভিযোগ করেছিলেন তিনি। এত দিন পেরিয়ে গেলেও কোনো জবাব পাননি। তিনি বলেন, আদালতের নির্দেশে সাতটি মামলা থেকে তিনি মুক্তি পেলেও গাজীপুরের জয়দেবপুর থানার মাদকের মামলায় তিনি এখনো হাজিরা দিয়ে যাচ্ছেন,” (প্রথম আলো, ১৮মার্চ)।
প্রায়ই এমন ভুয়া মামলায় হয়রানির খবর গণমাধ্যমে দেখা যায়।
ভুয়া মামলা যেমন হয়, তেমনি ভুল ব্যক্তিকে আটক করে দিনের পর দিন আটকে রেখে অন্যায় করা হয়। জাহালমের ঘটনাটি এর একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ। জজ মিয়া নাটকের কথাও কেউ ভোলেনি এখনও। এমনকি রসরাজের মতো অনেককে ফাঁসাতে সাম্প্রদায়িকতার ভুয়া অভিযোগ তুলেও মামলা ও হামলার ঘটনা ঘটে বাংলাদেশে।
স্থানীয় পর্যায়ে বৈষয়িক স্বার্থে এমন হয়রানির করার অভিযোগ আছে অসংখ্য। পুলিশের কোনো কোনো অসৎ কর্মকর্তাও মামলা দিয়ে অর্থ হাতিয়ে নেবার তৎপরতায় ব্যস্ত থাকেন। এমন অসংখ্য ঘটনার নজির পুলিশেই আছে। সেখানে এসবের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থারও অসংখ্য নজির আছে।
এই যে চারপাশে এত ভুয়া মামলা হচ্ছে হয়রানির উদ্দেশ্যে, ভুল করে অথবা আর্থিক লোভে, এমন ঘটনা যেহেতু হরহামেশাই হয়ে থাকে, তার মানে ধরা যেতে পারে এটি সমাজের একটি ব্যাধি। যেই ব্যাধিতে আক্রান্ত আমাদেরই চারপাশের অসংখ্য মানুষ। কারো গায়ে ইউনিফর্ম আছে, কারো নেই।
আরেকটি কারণ আছে, সবচেয়ে বড় কারণ। তা হলো রাজনৈতিক কারণে মামলা। অর্থাৎ একজন ব্যক্তি তিনি কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত, অথবা নন, কিন্তু কোনো রাজনৈতিক দল বা তার কোনো কর্মী সেই ব্যক্তিকে প্রতিপক্ষ মনে করছেন, এবং কোনো কারণে নিজের বা নিজেদের রাজনৈতিক ভবিষ্যতের জন্য তাঁকে ক্ষতিকর মনে করছেন, তখন মামলা করা হচ্ছে৷ নানান রকমের মামলা।
গত জাতীয় নির্বাচনের আগে সবচেয়ে আলোচিত হয়েছিল বিএনপি কর্মীদের বিরুদ্ধে করা মামলাগুলো। স্থানীয় গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে দেখা যায়, অনেক ঘটনা ঘটেইনি, তার জন্যও মামলা করা হয়। প্রথম আলোর ৭ অক্টোবরের রিপোর্টে বলা হয়, ‘‘বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের তৈরি করা এক হিসাবে দেখা যায়, ১ সেপ্টেম্বর থেকে ৪ অক্টোবর পর্যন্ত সারা দেশে তাদের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে ৪ হাজার ১৩৫টি মামলা হয়েছে। এতে মোট আসামি ৩ লাখ ৬০ হাজার ৩১৪। এর মধ্যে এজাহারনামীয় আসামি ৮৫ হাজার ৬০৪ জন। অজ্ঞাত আসামি ২ লাখ ৭৪ হাজার ৭১০ জন। এই সময়ে গ্রেপ্তার হয়েছেন ৪ হাজার ৬৫০ জন।”
বাংলা ট্রিবিউনকে ৮ অক্টোবর বিএনপি আইনজীবী মাসুদ রানা বলেছেন, ‘‘গত ১ সেপ্টেম্বর থেকে ২০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন জায়গায় রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে প্রায় চার হাজার মামলা হয়। ১০ বছর আগে মারা গেছেন এমন লোকদেরও এসব মামলায় আসামি করা হয়েছে।”
এসব মামলাকে ‘গায়েবি’, ‘কল্পিত’ ও ‘ভৌতিক’ নানা নামে আখ্যায়িত করেছেন বিএনপির কর্মী-সংগঠকরা। পুলিশ ও সরকারের পক্ষ থেকে অবশ্য এসব অভিযোগ বরাবরই অস্বীকার করা হয়েছে।
এছাড়া আরো এক ধরনের মামলা খুব বেশি দেখা যায়। তার একটি হলো মানহানির মামলা৷ একজন ব্যক্তির বিরুদ্ধে কথা বলা হয়েছে, তাই অনেকে সংক্ষুব্ধ হচ্ছেন৷ সংক্ষুব্ধ হয়ে সারাদেশ থেকে মামলা করা হচ্ছে। যেমন, ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনামেরবিরুদ্ধে ৬০ থেকে ৭০টি মামলা হয়েছিল।
লাখ থেকে কোটি, কোটি থেকে শতকোটি, শতকোটি থেকে হাজার হাজার কোটি টাকার ক্ষতিপূরণের মামলা করা হয় একেকজনের বিরুদ্ধে। এমন নজির আছে অনেক।
সম্প্রতি মাহফুজা আক্তার কিরণের ঘটনাটিও অদ্ভুত লেগেছে। তিনি একজন ফুটবল কর্মকর্তা, যিনি বলেছেন যে, প্রধানমন্ত্রী ফুটবলের চেয়ে ক্রিকেটকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। বিষয়টি বিচারাধীন, তাই মামলা নিয়ে তেমন কিছু বলছি না।
তবে একজন ফুটবল কর্মকর্তা হিসেবে যে কেউ চাইতে পারেন ফুটবলকে বেশি গুরুত্ব দেয়া হোক সরকারকে বা প্রধানমন্ত্রীকে তাঁর ভাবনা মেনে নিতে হবে এমন কোনো বিষয় নেই। ক্রিকেটকে ফুটবলের চেয়ে বেশি বা কম গুরুত্ব দিতে হবে, সেটা নীতিগত ব্যাপারই বটে, এবং এটা নিয়ে আলোচনা হতেই পারে। সব খেলাকে সমান গুরুত্ব দেয়া সম্ভবও নয়।
এটাকে একটি জাতীয় ইস্যুতে পরিণত করার কিছু নেই। প্রধানমন্ত্রীকে দেশের অসংখ্য বিষয় নিয়ে কাজ করতে হয়। সেখানে তাঁর সিদ্ধান্ত সবই জনপ্রিয় হবে এমন কোনো কথা নেই। সব সিদ্ধান্তের পক্ষে বিপক্ষে কথা থাকবেই। আর সব বিষয় আদালত পর্যন্ত নিতেই হবে এমন কোনো কথা নেই।
এছাড়া, আইসিটি আইনের ৫৭ ধারা ও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে সাংবাদিকসহ অনেকের বিরুদ্ধে এ পর্যন্ত মামলা হয়েছে। অনেক মামলা শুধু হয়রানি করার জন্যই করা হয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়। এমন পরিস্থিতি গণতন্ত্রের জন্য অত্যন্ত অশুভ। আইন রাষ্ট্রের জনগণের অধিকার নিশ্চিত করার জন্য। রাষ্ট্রের জনগণের অধিকারকে ক্ষতিগ্রস্ত করার জন্য নয়। নিয়ন্ত্রণ কোনো অর্থেই কোনো সমাধান নয়।
সূত্র: ডয়চে ভেলে