ব্যাংকের নিয়মিত গ্রাহকরাও এখন ‘ভালো খেলাপি’ হতে চায়

গাজীপুর কণ্ঠ ডেস্ক : খেলাপি ঋণের সুদের হার ও ঋণ পুনঃতফসিল নিয়ে অর্থমন্ত্রীর ঘোষণার প্রভাব পড়তে শুরু করেছে ব্যাংকিং খাতে। এ ঘোষণার পর ব্যাংকের নিয়মিত গ্রাহকরাও এখন ‘ভালো খেলাপি’ হওয়ার চেষ্টা করছে। তারা ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট দিয়ে ১২ বছরের জন্য ঋণ পুনঃতফসিলের সুযোগ চাইছে। কিস্তির টাকা না দিয়ে সময় চাইছে অনেক গ্রাহক। এতে গত এক সপ্তাহে ব্যাংকগুলোর দৈনন্দিন জমার পরিমাণ কমেছে। কোনো কোনো ব্যাংকে ক্যাশ ফ্লো অর্ধেকে নেমে গেছে। ব্যাংকগুলোর প্রধান কার্যালয় ও শাখা পর্যায়ে খোঁজখবর নিয়ে এমন চিত্র পাওয়া গেছে।

ঋণখেলাপি সংস্কৃতি থেকে বের করে দেশের ব্যাংকিং খাতের ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধারে গত ২৫ মার্চ এক ঘোষণায় অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন, মোট ঋণের ২ শতাংশ এককালীন জমা দিয়ে ভালো ঋণখেলাপিরা নিয়মিত হতে পারবেন। ঋণের পুরো অর্থ পরিশোধে সময় পাবেন ১২ বছর। সুদহার ১০, ১২ বা ১৫ যা-ই থাকুক না কেন, ঋণের সুদ হবে ৭ শতাংশ। ১ মে থেকে এটি বাস্তবায়ন হবে। এরপর ২ এপ্রিল তিনি ঋণের সুদহার ৭-এর পরিবর্তে ৯ শতাংশ হবে বলে জানান।

অর্থমন্ত্রীর ঘোষণার প্রতিক্রিয়া নিয়ে কথা হয় দেশের অন্তত এক ডজন ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের (এমডি) সঙ্গে। তবে প্রতিষ্ঠানের ভাবমূর্তি ও সার্বিক পরিস্থিতির কথা উল্লেখ করে নাম উদ্ধৃত করে বক্তব্য দিতে অপারগতা প্রকাশ করেন তারা।

প্রথম প্রজন্মের একটি বেসরকারি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জানান, ‘অর্থমন্ত্রীর ঘোষণার পর প্রায় সব বড় গ্রাহকই যোগাযোগ করেছেন। নতুন ঘোষণার আলোকে তারা সুবিধা পাবেন কিনা জানতে চেয়েছেন। বড় ও মাঝারি আকারের বেশির ভাগ গ্রাহক ঋণের কিস্তি দেরিতে দেয়ার কথা বলেছেন। গত কয়েকদিন খুবই বিব্রতকর পরিস্থিতি পার করছি।’

নতুন প্রজন্মের কয়েকটি ব্যাংকের শীর্ষ কর্মকর্তারাও জানান, গত এক সপ্তাহে ব্যাংকের ক্যাশ ফ্লো অনেক কমে গেছে। পরিস্থিতি যে পর্যায়ে গিয়ে ঠেকেছে, তাতে ব্যাংকের দৈনন্দিন পরিচালন ব্যয় নির্বাহ করা সম্ভব হবে কিনা, সে ব্যাপারে শঙ্কা জেগেছে।

মতিঝিল এলাকায় একটি ব্যাংকের স্থানীয় কার্যালয়ের ব্যবস্থাপক বলেন, নিয়মিত ঋণের কিস্তি পরিশোধ করে এমন একটি বড় করপোরেট গ্রুপ গত সপ্তাহে টাকা জমা দেয়নি। শাখার পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হলে তারা অর্থমন্ত্রীর ঘোষণার বাস্তবায়নের বিষয়ে জানতে চেয়েছেন।

২ শতাংশ ডাউন পেমেন্টে ঋণখেলাপিদের ঢালাওভাবে ১২ বছরের পুনঃতফসিল সুবিধা দিলে পরিস্থিতি খারাপ হবে বলে মনে করছে বাংলাদেশ ব্যাংকও। এ প্রসঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, খেলাপিরা নিয়মিত গ্রাহকদের চেয়ে বেশি সুযোগ-সুবিধা পেলে ভালো গ্রাহকরা নিরুৎসাহিত হবেন, এটিই স্বাভাবিক। বাস্তব পরিস্থিতির শিকার হয়ে যেসব ব্যবসায়ী খেলাপি হয়েছেন, তাদের পৃথকভাবে চিহ্নিত করতে হবে। খেলাপিদের ঋণ পুনঃতফসিল করার সুযোগ দিলে ভালো গ্রাহকদের ইনসেনটিভ দেয়ার বিষয়টিও পর্যালোচনায় নিতে হবে। সামগ্রিকভাবে দেশের আর্থিক খাতের জন্য এটি অনেক বড় সিদ্ধান্ত।

ঘোষণা অনুযায়ী, এক মাসের মধ্যে ঋণখেলাপিদের বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রজ্ঞাপন জারি করার কথা। কবে নাগাদ ঋণ পুনঃতফসিলের প্রজ্ঞাপন জারি হবে, এমন প্রশ্নের জবাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপাত্র বলেন, অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে খেলাপি ঋণ কমানো ও ঋণখেলাপিদের বিষয়ে করণীয় সম্পর্কিত চিঠি এসেছিল। পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে বাংলাদেশ ব্যাংক এরই মধ্যে মতামত জানিয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে পরে আর কোনো নির্দেশনা আসেনি।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা জানান, অর্থমন্ত্রীর ঘোষণা অনুযায়ী ঋণের সুদহার ও পুনঃতফসিল সুবিধা রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতে বাস্তবায়ন হতে পারে। অর্থ মন্ত্রণালয় থেকেই এ-সম্পর্কিত নীতিমালা জারি হবে। পরবর্তী সময়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে কোনো নির্দেশনা দিলে আমরা তার আলোকে কাজ করব।

এদিকে ব্যাংকগুলোর দৈনন্দিন জমা কমে যাওয়ার প্রভাব পড়েছে আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজার (কলমানি), রেপো ও বিশেষ রেপোর সুদহার ও চাহিদায়। চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে কলমানির সুদহার ছিল ঊর্ধ্বমুখী। ব্যাংকের ক্ষেত্রে কলমানি সুদহার গড়ে প্রায় ৫ শতাংশ এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে ৬ শতাংশ পর্যন্ত উঠেছে। নগদ তারল্য সংকটের কারণে গত সপ্তাহে ৯ শতাংশ সুদ দিয়ে বিশেষ রেপোতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে অর্থ ধার করেছে কয়েকটি ব্যাংক। রেপোতে ধার নেয়ার পরিমাণও বেড়েছে এ সময়ে।

দৈনন্দিন জমা কমে যাওয়া যেকোনো ব্যাংকের জন্য অশনিসংকেত বলে মনে করেন ব্যাংক নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান ও ঢাকা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান। তিনি বলেন, বাজারে সিঙ্গেল ডিজিটে আমানতও পাওয়া যাচ্ছে না। এ অবস্থায় ঋণের সুদহার ৯ শতাংশে নামিয়ে আনা অনেক কঠিন। খারাপরা বেশি সুযোগ পেলে ভালো গ্রাহকরাও সুযোগ নেয়ার চেষ্টা করবে, এটিই স্বাভাবিক।

তিনি বলেন, অর্থমন্ত্রী মহোদয়ের ঘোষণা অনুযায়ী আমরা এখনো বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে প্রজ্ঞাপন পাইনি। সুবিধা পাওয়ার জন্য ভালো গ্রাহকরা কিস্তির টাকা দেয়া বন্ধ করে দিলে পরিস্থিতি আরো খারাপ হবে। এটি পুরো ব্যাংকিং খাতের জন্যই বড় সমস্যা তৈরি করবে। ব্যাংকিং খাতে তারল্য সংকট আরো বাড়বে।

রাষ্ট্রায়ত্ত অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. জায়েদ বখত বলেন, অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে আমরা ব্যাংকের কস্ট অব ফান্ডের ভিত্তিতে ঋণের সুদহার নির্ধারণের প্রস্তাব দিয়েছিলাম। কারণ রাষ্ট্রায়ত্ত অনেক ব্যাংকের পাশাপাশি দেশের বেসরকারি ব্যাংকগুলোর কস্ট অব ফান্ড অনেক বেশি। ওই ব্যাংকগুলোর পক্ষে ঋণে ৭ শতাংশ সুদ বাস্তবায়ন অসাধ্য হয়ে উঠত। এখন এটি ৯ শতাংশ ধরা হয়েছে। আশা করছি, ব্যাংকগুলো এ সুদহার বাস্তবায়ন করতে পারবে।

তবে রাষ্ট্রায়ত্ত একটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, অতীতে সুযোগ-সুবিধা নিতে ভালো গ্রাহকও ইচ্ছে করে খেলাপি হতে দেখেছি। বর্তমান পরিস্থিতিও ব্যতিক্রম নয়। ঋণখেলাপিরা বেশি সুযোগ পেলে পরিস্থিতি আরো খারাপ হতে পারে।

এর আগে ২০১৫ সালে ঋণখেলাপিদের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক ঋণ পুনর্গঠন নীতিমালা জারি করেছিল। ওই সময় ৫০০ কোটি টাকার বেশি ঋণ রয়েছে এমন ১১টি শিল্প গ্রুপের ১৫ হাজার কোটি টাকার ঋণ নিয়মিত করে বড় ধরনের সুবিধা দেয়া হয়। তবে বড় সুবিধা পাওয়ার পরও দুই-তিনটি ছাড়া বাকি সব গ্রুপ ঋণ পরিশোধ করতে ব্যর্থ হয়েছে।

 

সূত্র: বণিক বার্তা

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button