রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বাড়ছে সহিংসতা, বাড়ছে উদ্বেগ

গাজীপুর কণ্ঠ ডেস্ক : রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সাম্প্রতিক সহিংসতা ও অস্ত্রের ব্যবহার আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর জন্য উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহকে হত্যার রেশ না কাটতেই খুন হয়েছেন আরো ৬ জন৷

গত ২৯ অগাস্ট কক্সবাজারের উখিয়ায় লম্বাশিয়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পে গুলি চালিয়ে আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটসের চেয়ারম্যান মুহিবুল্লাহকে হত্যা করা হয়৷ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দাবি তারা এই হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদ্ঘাটন করেছে৷ শনিবার খুনের সঙ্গে সরাসরি জড়িত একজনকে গ্রেপ্তারের কথা জানিয়েছে আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ান- এবিপিএন৷ তবে পরিকল্পনাকারী পর্যন্ত এখনও পৌঁছাতে পারেনি পুলিশ৷ তাদের তথ্য অনুযায়ী, এই হত্যা মিশনে অংশ নেয় ১৯ জন৷ এদের মধ্যে পাঁচজন ছিলেন অস্ত্রধারী৷ পূর্বপরিকল্পনা অনুসারে কয়েক মিনিটেই কিলিং মিশন শেষ করে ঘটনাস্থল ত্যাগ করে খুনিরা৷

১৪ আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক এসপি নাইমুল হক বলেন, হত্যায় সরাসরি অংশ নেওয়া আজিজুল হককে অস্ত্রসহ গ্রেপ্তার করা হয়েছে৷ আজিজুল হক প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করেছেন, তিনি কিলিং মিশনে ছিলেন৷ তার সঙ্গে আরও তিনজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে৷ তারা হলেন, কুতুপালং ক্যাম্প-১ এর ডি-৮ ব্লকের আব্দুল মাবুদের ছেলে মোহাম্মদ রশিদ ওরফে মুরশিদ আমিন ও একই ক্যাম্পের বি ব্লকের ফজল হকের ছেলে মোহাম্মদ আনাস ও নুর ইসলামের ছেলে নুর মোহাম্মদ৷

মুহিবুল্লাহকে হত্যা যেভাবে

এসপি নাইমুল হক বলেন, ‘‘জিজ্ঞাসাবাদে আজিজুল বলেছেন, মুহিবুল্লার হত্যার দুদিন আগে মরকাজ পাহাড়ে কিলিং মিশনের জন্য বৈঠক করে দূর্বৃত্তরা৷ সেখান থেকে ১৯ জনকে মিশনে অংশ নেওয়ার নির্দেশনা দিয়ে পাঁচজনকে সশস্ত্র অবস্থায় পাঠানো হয়৷ মুহিবুল্লাহ রোহিঙ্গাদের নেতা হিসেবে পরিচিত৷ তার উত্থান ও প্রত্যাবাসন ঠেকাতে যেকোনো মূল্যে তাকে হত্যা করার নির্দেশ দেওয়া হয়৷ সেই নির্দেশনা মতো ২৯ সেপ্টেম্বর মুহিবুল্লাহকে বাসা থেকে অফিসে ডাকা হয়৷ প্রত্যাবাসন বিষয়ে কয়েকজন কথা বলতে ডাকছে বলে বাসা থেকে বের করে আনে গ্রেপ্তার মুরশিদ৷ এরপর বাকিদের সংকেত দিয়ে সে অফিস থেকে চলে যায়৷’’

নাইমুল হক আরও বলেন, ‘‘সশস্ত্র টিম অফিসে ঢুকে একজন মুহিবুল্লাহকে বলে ‘ওঠ’ তোর সঙ্গে কথা আছে৷ বসা থেকে উঠতেই প্রথমজনের একটি, তার পরেরজনের দুটিসহ মোট চারটি গুলি করা হয় মুহিবুল্লাহকে৷ এরপর মুহিবুল্লার বাড়ির পেছন দিয়ে পালিয়ে যায় স্কোয়াডের পাঁচজন৷ পরে সবাই সতর্ক হয়ে যায়৷’’ এই ঘটনায় এখন পর্যন্ত ১০ জন গ্রেপ্তার হয়েছে৷

বাড়ছে অস্ত্রের ব্যবহার

শুধু মুহিবুল্লাহর হত্যাকাণ্ডই নয়, এর আগেও রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে৷ বিভিন্ন সময় সেখান থেকে অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে৷ কক্সবাজার জেলা পুলিশের হিসেব অনুযায়ী ২০১৮ সালে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে টেকনাফ ও উখিয়া থানায় অস্ত্র মামলা হয়েছিল ১৩টি৷ পরের বছর তা বেড়ে হয় ১৭টি৷ ২০২০ সালে ২৭টি অস্ত্র মামলা হয়৷ চলতি বছরের নয় মাস ২৩ দিনে ১৫টি অস্ত্র মামলা হয়েছে৷ ওই সময়ের মধ্যে রোহিঙ্গাদের কাছ থেকে ১৪টি দেশীয় পিস্তল, ৪৪টি এলজি, তিনটি বিদেশি পিস্তল, ৩০টি একনলা বন্দুক, ২৫টি দেশি বন্দুক, চারটি পাইপগানসহ প্রচুর পরিমাণ ধারালো অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে৷ সব মিলিয়ে এই সময়ের মধ্যে ১২৩টি অস্ত্র পুলিশ উদ্ধার করেছে৷

সর্বশেষ শুক্রবার ভোর রাত সোয়া ৪টার দিকে উখিয়া উপজেলার পালংখালী ইউনিয়নের ১৮ নম্বর ময়নারঘোনা রোহিঙ্গা ক্যাম্পে গোলাগুলি হয়৷ এই ঘটনায় যে ছয়জন খুন হয়েছেন তারা ১৮ নম্বর ক্যাম্পের মসজিদে ছিলেন৷ পাশেই ১৯ নম্বর ক্যাম্পে বসবাস করেন শাহ আলম৷ তিনি বলেন, ‘‘মুহিবুল্লাহ হত্যার পর থেকে আমরা আতঙ্কেই ছিলাম৷ এরপর আবার পাশের ক্যাম্পে ৬ জন খুনের পর আমরা আসলে পরিবার নিয়ে শঙ্কার মধ্যেই আছি৷ পুলিশ পাহারা দিচ্ছে, কিন্তু সাধারণ রোহিঙ্গারা খুব আতঙ্কে আছেন৷’’

অভ্যন্তরীণ কোন্দলে ৮৯ রোহিঙ্গা খুন

পুলিশের পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৭ সালের ২৫ অগাস্ট থেকে চলতি বছরের ২৩ অক্টোবর পর্যন্ত টেকনাফ ও উখিয়া থানায় ৮৯ জন রোহিঙ্গা খুন হয়েছেন৷ এসব ঘটনায় ৮০টি মামলা হয়েছে৷ এর বাইরে ২৪ জন রোহিঙ্গা বিভিন্ন বাহিনীর সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হন৷ সর্বশেষ শনিবার মারা গেছেন ৬ জন৷

২০১৮ সালের মে মাসে দেশব্যাপী শুরু হওয়া মাদকবিরোধী অভিযানে কক্সবাজারে বিভিন্ন বাহিনীর সঙ্গে কথিত ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয়েছেন ২৭৯ জন৷ এদের মধ্যে রোহিঙ্গা ১০৯ জন৷ নিহত রোহিঙ্গাদের মধ্যে তিনজন ছিলেন নারী৷

মানবাধিকারকর্মী নূর খান লিটন বলেন, ‘‘রোহিঙ্গাদের মধ্যে যেসব তরুণ আছে, তাদের কোন না কোন কাজে লাগাতে হবে৷ তা না হলে এই ধরনের পরিস্থিতি বন্ধ করা যাবে না৷ দেখেন তরুণরা সারাদিন ঘরে বসে থাকে৷ কী করবে তারা? কোন না কোন সন্ত্রাসী গ্রুপ তাদের কাজে লাগাতে চাইবে? একসময় হয়ত তারা এসব গ্রুপে যোগ দিয়ে ফেলবে৷ পাশাপাশি ক্যাম্পে যে গ্রুপগুলো আছে তাদেরও নিয়ন্ত্রণ করতে হবে৷’’

রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে ১,৩৬৮টি মামলা

কক্সবাজারের ৩৪টি রোহিঙ্গা শিবিরের মধ্যে টেকনাফ থানা এলাকায় ১১টি ও উখিয়া থানা এলাকায় ২৩টি শিবিরের অবস্থান৷ ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট থেকে এ পর্যন্ত চার বছরে এ দু’টি থানায় রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে এক হাজার ৩৬৮টি মামলা হয়েছে৷ এগুলোতে আসামি করা হয় ২ হাজার ৩৭৮ জনকে৷ যাদের মধ্যে এক হাজার ৭৫৫ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ৷ পুলিশের হিসাব অনুযায়ী, মূলত ১০ ধরনের অপরাধে এসব মামলা হয়েছে৷ এগুলো হচ্ছে- অস্ত্র, মাদক, ধর্ষণ ও ধর্ষণ চেষ্টার অভিযোগ, অবৈধ অনুপ্রবেশ, অপহরণ, পুলিশের উপর হামলা, ডাকাতি ও ডাকাতির প্রস্তুতি, হত্যা এবং মানবপাচার৷ এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি হয়েছে মাদক মামলা ৭০৬টি৷ ২০১৭ সালের পর থেকে ক্যাম্পগুলোতে মাদক অপরাধ বেড়েই চলেছে৷

পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক এ কে এম শহীদুল হক বলেন, ‘‘এত অল্প জায়গায় ১১-১২ লাখ রোহিঙ্গা থাকে৷ তাদের কোন কাজ নেই৷ ফলে তারা অপরাধ প্রবণ হয়ে উঠাই স্বাভাবিক৷ বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে এই ধরনের অপরাধ প্রবণ হয়ে উঠার সম্ভাবনা বেশি৷ এখানে আমাদের আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর জন্য দু’টি চ্যালেঞ্জ৷ একটি হল, এদের নিরাপত্তা দেওয়া৷ খুনোখুনির ঘটনা বাড়তে থাকলে আন্তর্জাতিক মহল থেকে বলা হবে, আমরা তাদের নিরাপত্তা দিচ্ছি না, শৈথিল্য দেখাচ্ছি৷ আরেকটা চ্যালেঞ্জ হল, এতগুলো মানুষকে মনিটর করা খুব কঠিন৷ এত ছোট ছোট ঘর, সেখানে কী হচ্ছে, তা ঘরে ঘরে গিয়ে মনিটর করা সম্ভব না৷ তারপরও আইন শৃঙ্খলা বাহিনী সাধ্যমত চেষ্টা করে যাচ্ছে৷ কিছু ফোর্স এখন বাড়াতে হবে৷’’

সীমান্ত পেরিয়ে আসে অস্ত্র, আছে দেশীয় অস্ত্রের কারখানাও

আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর নজরদারির মধ্যেও রোহিঙ্গা ক্যাম্পে কী করে অস্ত্র আসছে সেটি বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দিচ্ছে৷ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দাবি, ভারত ও মিয়ানমারের অরক্ষিত সীমান্ত দিয়ে আসা অস্ত্র যাচ্ছে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের কাছে৷ তবে এসব অস্ত্রের প্রধান উৎস মিয়ানমার৷ রোহিঙ্গাদের মধ্যে অস্ত্রের বিস্তার নিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল কয়েকদিন আগে বলেছেন, মিয়ানমার থেকে বিভিন্নভাবে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের পরিবেশ অস্থির করার জন্য এখানে অস্ত্র আসছে৷ অস্ত্র নিয়ে তাদের আধিপত্য বিস্তার করার জন্য বিভিন্ন গ্রুপ মারামারি করছে৷

এছাড়া কিছু স্থানীয় দুর্বৃত্তের সহায়তা নিয়েও পাহাড়ি এলাকায় অবৈধ অস্ত্রের কারখানা বানিয়ে তারা সংগ্রহ করছে নানা ধরনের দেশীয় অস্ত্র৷ রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সরবরাহের জন্য গহীন পাহাড়ে গড়ে তোলা হয়েছে অস্ত্র তৈরির অস্থায়ী কারখানাও৷ সেখানে চারপাশে পাহারা বসিয়ে লেদ মেশিন ও অন্যান্য যন্ত্রাংশের সহায়তায় দেশীয় প্রযুক্তিতে আগ্নেয়াস্ত্রসহ নানা ধরনের দেশীয় অস্ত্র তৈরি করা হয়৷ গত বছরের ৫ অক্টোবর এমন একটি অস্ত্র তৈরির কারখানা শনাক্ত করেছিল র‌্যাব৷ সেখান থেকে অস্ত্র তৈরির দুই কারিগরকে আটক করা হয়৷ পরে তাদের স্বীকারোক্তি মতে ৩টি দেশি অস্ত্র, ২ রাউন্ড গুলি ও অস্ত্র তৈরির সরঞ্জাম উদ্ধার করা হয়৷ আটক দু’জনই বাংলাদেশি নাগরিক৷

 

সূত্র: ডয়চে ভেলে

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button