মফস্বলের খোকার বঙ্গবন্ধু হয়ে ওঠা: পারিপার্শ্বিক প্রভাব
গাজীপুর কণ্ঠ ডেস্ক : বাইগার নদীর কোল ঘেঁষে গড়ে ওঠা এক অখ্যাত শান্ত জনপদ টুঙ্গিপাড়া। তাল-তমাল, জারুল-হিজল, শিমুল-বকুল আর আম-কাঁঠালের ছায়াঘেরা এ গ্রাম। এ গ্রামেই জন্ম হয় বাঙালির ভবিষ্যৎ নির্ধারণের এক রূপকারের। ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ শেখ লুত্ফর রহমান ও সায়রা খাতুন দম্পতির কোল আলো করে জন্ম নেয় যে শিশু, বাবা-মা তাকে ডাকেন খোকা বলে। পোশাকি নাম শেখ মুজিবুর রহমান। এই খোকা ভাইবোন ও পাড়া-প্রতিবেশীর মিয়াভাই, বাংলার মানুষের বঙ্গবন্ধু, ধ্রুপদী কাব্যের নির্মাতা—৭ মার্চের অবিনাশী বক্তা—রাজনীতির কবি। মফস্বলের খোকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হয়ে ওঠার গল্পটা খুব সরল ছিল না। তার জীবনবোধ ব্যক্তিত্ব-বিকাশ এবং নেতৃত্বের স্বাতন্ত্র্য বৈশিষ্ট্য গঠনে পরিবার, সমকালীন সময়, পরিবেশ-পরিস্থিতি এবং ব্যক্তির প্রভাব কতটুকু তা সমাজ ইতিহাসের আগ্রহের বিষয়। তত্কালীন সমাজ, রাজনীতি ও বিশ্বব্যবস্থার প্রভাবই বা কতটুকু ছিল তা জানা দরকার। খোকার বঙ্গবন্ধু হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে পারিবারিক ঐতিহ্য, রীতিনীতিরই বা কী প্রভাব ছিল তা নতুন প্রজন্মের জানা প্রয়োজন।
খোকার পারিবারিক পরিমণ্ডল ছিল মানবতাবাদী জীবনদর্শন গঠনের অনন্য পাঠশালা, তা তার আত্মজীবনী থেকে জানা যায়। পূর্বপুরুষদের সামাজিক অবস্থান তার মর্যাদাবোধসম্পন্ন মানস গঠনে প্রভাব রেখেছিল। শৈশবে গ্রামীণ সাদামাটা আটপৌরে সহজ-সরল মানুষের জীবন সংগ্রাম তাকে মানুষের প্রতি কর্তৃব্যবোধসম্পন্ন করে। পল্লী মায়ের অপরূপ সৌন্দর্য, দেশজ কৃষ্টি ও সংস্কৃতি তাকে খাঁটি বাঙালিরূপে গড়ে তোলে। এ থেকে তৈরি হয় স্বাতন্ত্র্য জাতীয় চেতনা, যা বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রাথমিক উপাদান। এর ভিত্তিতেই গড়ে ওঠে বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলন।
মফস্বলের এক নিভৃত গায়ে জন্ম নেয়া খোকার ছেলেবেলাও আর দশটা বালকের মতো গাছের ডালে ডালে ঝুলে, নদীতে ঝাঁপিয়ে, ঘাস ফড়িংয়ের পেছনে ছুটে, বনবাদাড়ে ঘুরে ঘুরে কেটেছে। পাখির কলরব, নদীর কলতান, রাখালের বাঁশির সুর, মাঝির কণ্ঠে ভাটিয়ালি সুর, ফসলের মাঠে ভেসে আসা কৃষকের ফসল তোলার গান তার শৈশবকে আনন্দমুখর করে, যা তাকে একাত্ম করে সাধারণ মানুষের সঙ্গে। গৃহপালিত প্রাণী, কবুতর, ময়না, টিয়া ইত্যাদি পোষ মানানো ছিল তার শখ। গ্রামের মানুষের সরলতা, স্নিগ্ধ নির্মল প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেশ ও মানুষের প্রতি আত্মিক যোগসূত্র তৈরি করে। ছোটবেলা থেকেই আত্মস্বার্থের প্রতি উদাসীনতা, অসহায় মানুষের প্রতি মমত্ববোধ আর সম্প্রদায় নির্বিশেষে আপন করে নেয়ার প্রবণতা এক মানবিক মুজিবের সন্ধান দেয়। দুষ্টামি আর দুরন্তপনায়ও কমতি ছিল না। প্রাথমিক শিক্ষার সূচনায় মুজিবকে অধ্যবসয়ী শিক্ষার্থী হিসেবে যতটা না তার চেয়ে বেশি বহির্মুখী একজন বালক হিসেবে, যিনি মানুষের সঙ্গে কথা বলতে, সবার সঙ্গে মিশতে এবং খেলাধুলা আর সমাজসেবামূলক কাজেই আগ্রহী ছিলেন বেশি। এসব কারণে তিনি বাল্যকাল থেকেই এলাকার মানুষের প্রিয়জন হয়ে ওঠেন। ছোটবেলায় পরিবারের কাছে পরাধীন দেশে বিদেশী শাসকগোষ্ঠী ও তার এ দেশীয় সহযোগীদের অত্যাচার-নিপীড়নের কাহিনী শুনে তার মধ্যে জন্ম নেয় প্রতিবাদী মানবসত্তা। কৃষকদের সঙ্গে ইংরেজ নীলকর-কুঠিয়ালদের প্রতারণা, জোরপূর্বক মাঝিদের নৌকা মাসের পর মাস আটকে রাখা, ব্রিটিশদের এ দেশীয় সহযোগী বেনিয়া এবং জমিদারদের অত্যাচারের কাহিনী খোকার শিশুমনে বিদ্রোহের বীজ বপন করে। নিজের প্রতি উদাসীনতা আর বালকসুলভ অবাধ্যতার প্রতি বাবার প্রচ্ছন্ন সায় তাকে স্বাধীনচেতা হতে সহায়ক হয়েছে।
শৈশবের যে বয়সে শিশুদের আত্মকেন্দ্রিকতা দোষণীয় হিসেবে গণ্য হয় না, সে বয়সে খোকা সমবয়সী দরিদ্র ছাত্রদের নিজের করণীয় কাজ করে বিরল দৃষ্টান্ত তৈরি করেন। যে বয়সের শিশুরা নিজস্ব জগতে বিচরণ করতেই পছন্দ করে, সে বয়সে শেখ মুজিবুর রহমান দরিদ্র ছাত্রদের সহায়তা করতে নিজ শিক্ষকের সঙ্গে ‘মুসলিম সেবা সমিতি’ গঠন করে দ্বারে দ্বারে মুষ্টি ভিক্ষা করে বেড়িয়েছেন। কেউ চাল না দিলে তিনি তার ওপর চড়াও হওয়ার ঘটনা প্রতিবাদী এক বালকের সন্ধান দেয়, যে কিনা সামাজিক সাম্য প্রতিষ্ঠা করতে চায়। নিজের বই, খাতা, ছাতা এমনকি পরনের জামাকাপড় পর্যন্ত গরিব অসহায় ছাত্রদের দান করে খররৌদ্রের প্রখর উত্তাপ মাথায় নিয়ে অথবা বৃষ্টিতে ভিজে খালি গায়ে স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার দৃষ্টান্ত সমাজের আর দশজন বালক থেকে তাকে আলাদা করে। পারিবারিক পরিবেশ তাকে অন্যের প্রতি কর্তব্যপরায়ণ ও অধিকারসচেতন মানুষ হিসেবে গড়ে উঠতে সহায়তা করেছে। সুযোগ পেলেই বাবার সঙ্গে রাজনৈতিক আলোচনা এবং দেশের ইতিহাস-ঐতিহ্যের গল্প শুনতে বসে যেতেন। সে সময়ে প্রকাশিত প্রধান প্রধান পত্রিকা বাসায় আসত বলে দৈনন্দিন খবরাখবর পড়ার অভ্যাস তার ছোটবেলায়ই গড়ে ওঠে। শেখ মুজিবুর রহমান অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র থাকাবস্থায় প্রথম পাদপ্রদীপের আলোয় আসেন। তত্কালীন শ্রমমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও মুখ্যমন্ত্রী শেরেবাংলা গোপালঞ্জ সফরে এলে তিনি ছাত্রদের পক্ষে দাবিদাওয়া উত্থাপন করেন। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী সেই বালকের মধ্যে বিশেষ কিছু লক্ষ করে কলকাতায় ফিরে গিয়ে বালক শেখ মুজিবুর রহমানকে চিঠি লিখলেন। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী প্রথম দেখাতেই বালক শেখ মুজিবুর রহমানের মধ্যে ভবিতব্যের সম্ভাবনাময় নেতৃত্বের সন্ধান পেয়েছিলেন নিশ্চয়। শুরু হলো গুরু-শিষ্যের এক অসাধারণ সম্পর্কের। যে সম্পর্কের সূচনা হলো তা ছিল আশা-ভরসার, মান-অভিমানের, একে অন্যের প্রতি নির্ভরতার, কোনো টানাপড়েন এ সম্পর্ককে বিচ্ছিন্ন করতে পারেনি। এ পথেই তিনি খুঁজে নিলেন আপন পথের ঠিকানা, যে পথ তিনি নিজেই রচনা করেন, সহযাত্রী করেন সেসব সাধারণ মানুষকে, যাদের জীবন সংগ্রাম তিনি প্রত্যক্ষ করেছেন শৈশবকাল থেকে।
দুই
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অব্যবহিত পরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম। শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মের পূর্বাপর বৈশ্বিক রাজনীতিতে চলছিল নানা উত্থান-পতন। এ সময় পৃথিবীর রাজনৈতিক ভূগোলে চলছিল ভাঙাগড়ার খেলা। তার জন্মের দুই বছর আগে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়, তিন বছর আগে সংঘটিত হয় রুশ বিপ্লব এবং জন্মের ২৯ বছর পরে সংঘটিত হয় চীনা কমিউনিস্ট বিপ্লব। ১৯৩৯-৪৫ সাল অবধি চলে সর্বাধুনিক মারণাস্ত্রের ব্যবহারসংবলিত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর অটোমান সম্রাজ্যের পতন বৈশ্বিক রাজনীতিতে ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টি করে। ১৯২৯ সালে শুরু হওয়া বিশ্বমন্দা বিশ্ব অর্থনৈতিক পরিস্থিতিকে শোচনীয় করে তোলে। ১৯৫৯ সালে কিউবায় বিপ্লব সংঘটিত হয়। ভারতে সংঘটিত খিলাফত আন্দোলন ও স্বদেশী আন্দোলন রাজনৈতিক মঞ্চে নতুন গতি সঞ্চার করে। ভোটাধিকারের ভিত্তিতে ভারতবর্ষের প্রথম সাধারণ নির্বাচন ও প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনও এ সময়ের মধ্যে অনুষ্ঠিত হয়। এ সময় ভারতবর্ষে শাসনতান্ত্রিক ক্ষেত্রে রাজতন্ত্র বা স্বৈরতন্ত্র থেকে গণতন্ত্রে উত্তরণের কালপর্ব চলছিল। ভারতের প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থাও ভাঙাগড়ার মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল। তার যুবা বয়সে সংঘটিত একাধিক সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা তার মনে গভীর রেখাপাত করে। তিনি শুধু দাঙ্গা প্রত্যক্ষই করেননি, নিজের জীবন বাজি রেখে মানুষের জীবন রক্ষায় কাজ করে গেছেন। নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসুর নেতৃত্বে স্বদেশী আন্দোলনও তার রাজনৈতিক চিন্তাকে প্রভাবিত করে। আবার পাকিস্তান আন্দোলনে তিনি ছিলেন এক নিবেদিতপ্রাণ কর্মী। ব্রিটিশ ভারতের নাগরিক হিসেবে ১৯৪৭ সালে ভারতভাগ এবং বাংলা ও পাঞ্জাব বিভক্তির মতো ঘটনা তার মনে গভীর রেখাপাত করে। ব্যক্তির আত্মস্বার্থে মানচিত্রের কাটাছেঁড়া তাকে ব্যথিত করে। ‘মুসলিমদের আবাসভূমি’ হলো, কিন্তু বাঙালির মুক্তি এল না, দেশ গিয়ে পড়ল এক শকুনির হাত থেকে আরেক শকুনির হাতে। রাজনৈতিক ঘটনাবহুল এ সময়কে প্রত্যক্ষ করেন তিনি। ঘটনাবহুল সময়ের অভিযাত্রী মুজিব সময় ও ঘটনা থেকে শিক্ষা নেন। এসব ঘটনার কোনোটির ইতিহাস থেকে জেনে, কোনোটির প্রত্যক্ষদর্শী, কোনোটির অংশগ্রহণকারী। পাকিস্তান আন্দোলনে তার ভূমিকার কথা আমরা সবাই জানি। ১৯২০ সালে তার জন্ম থেকে ১৯৫৪ সালে তার প্রথম নির্বাচনে অংশগ্রহণ পর্যন্ত ৩৪ বছর বয়সে পৃথিবীর রাজনৈতিক ইতিহাসে এমন সব ঘটনা ঘটে গেছে, যা বিশ্ব ব্যবস্থার খোলনলচে পাল্টে দিয়েছে। এসবই তার রাজনৈতিক মনস্তত্ত্ব তৈরিতে ভূমিকা রেখেছে। তিনি ১৯৫২ সালে চীনা কমিউনিস্ট পার্টির আমন্ত্রণে চীন ভ্রমণকালে বিপ্লবোত্তর নয়া চীনের জেগে ওঠার বিষয়টি অত্যন্ত আগ্রহভরে প্রত্যক্ষ করেন। বিদেশে গেলে ভ্রমণকারীরা সাধারণত ঐতিহাসিক বা বিনোদনমূলক দর্শনীয় স্থান ঘুরে দেখেন, কিন্তু তিনি দেখলেন শিল্প-কলকারখানা, শ্রমিক ও কৃষকদের কর্মপরিবেশ— স্থানীয় জনজীবন ও সংস্কৃতি। বিপ্লবোত্তর একটি দেশের নবচেতনায় জেগে ওঠা, মানুষের চিন্তা-দর্শনকে প্রগতির চাকায় পাল্টে ফেলার প্রচেষ্টা পর্যবেক্ষণ করলেন তিনি। আধুনিক চীনকে গড়ে তোলার জন্য তাদের মানবসম্পদ তৈরির প্রস্তুতি পর্ব, চীনের শিক্ষা ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানোর কর্মযজ্ঞ প্রত্যক্ষ করেন তিনি। চীনের গড়ে ওঠার কর্মতত্পরতার মধ্যে কি তিনি তার মানসপটে অঙ্কিত স্বাধীন বাংলার চিত্র দেখতে পেয়েছিলেন? পরবর্তীকালে স্বাধীন বাংলাদেশ গড়ে তোলার ক্ষেত্রেও তিনি একই ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছিলেন, যা ছিল জীবন ঘনিষ্ঠ।
তিন
শেখ মুজিবুর রহমান আত্মমর্যাদাসম্পন্ন মানুষ ছিলেন। তিনি কখনো কোনো অন্যায়ের কাছে মাথা নত করেননি। পালিয়ে বেড়ানো তার স্বভাবে ছিল না। গোপন রাজনীতিতেও তিনি বিশ্বাসী ছিলেন না। সর্বদা মাথা উঁচু করে চলতে নিজে শিখেছেন, বাঙালিকেও শিখিয়েছেন। তিনি যখন প্রথম গ্রেফতার হন তখন তিনি স্কুল বালকমাত্র, আশপাশের লোকেরা তাকে সরে যেতে বলেন, পুলিশও চাচ্ছিল বাসা থেকে সরে পড়ুক, কিন্তু ওই বয়সের এক বালক আত্মমর্যাদা ভূলুণ্ঠিত হতে দিলেন না। পরবর্তী সময়েও আমরা দেখেছি, যখনই পুলিশ গ্রেফতার করবে বলে মনে হয়েছে, বাক্সপেটরা গুছিয়ে অপেক্ষা করেছেন, পালিয়ে যাননি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের অধিকার আদায়ের আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়ার কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাকে বহিষ্কার করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের শর্ত মেনে অনেকে মুচলেকা দিয়ে
ছাত্রত্ব ফিরিয়ে নেন। যাদের জন্য ছাত্রত্ব হারালেন তারাও মুচলেকা দিয়ে চাকরিতে ফিরে এলেন, এলেন না শুধু বঙ্গবন্ধু। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের অসম্মানজনক শর্ত মানেননি। মুচলেকা দিয়ে ছাত্রত্ব ফিরিয়েও নেননি। তিনি বলেছিলেন, ‘আমি ফিরে আসব, কিন্তু হয়তো ছাত্র হিসেবে নয়।’ তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে এসেছিলেন বটে, চ্যান্সেলর হয়ে। এ মর্যাদাবোধ তিনি বংশের কাছে শিখেছিলেন। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী শেখ মুজিবুর রহমানকেই তাদের প্রধান প্রতিবন্ধক ভেবেছে। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা ভেঙে দেয়ার পর মন্ত্রীদের মধ্যে একমাত্র শেখ মুজিবুর রহমানকেই গ্রেফতার করা হয়। তিনি গ্রেফতার এড়ানোর কোনো চেষ্টাও করেননি।
চার
ছোটবেলা থেকেই শেখ মুজিবুর রহমান রাজনীতিসচেতন হয়ে গড়ে উঠেছিলেন। পাঠ্যবইয়ের চেয়ে পত্রপত্রিকা, ইতিহাস-ঐতিহ্য ও রাজনীতি সম্পর্কে পড়তেই বেশি পছন্দ করতেন। পড়ার অভ্যাস পরবর্তীকালে তার জেলজীবনকে কিছুটা স্বস্তিদায়ক করেছিল। দেশী-বিদেশী লেখকদের প্রচুর বই পড়ে জ্ঞানার্জন করেন, কিন্তু তাত্ত্বিক জ্ঞানের গণ্ডিতে নিজেকে আটকে রাখেননি। মুসলিম লীগের রাজনৈতিক প্রশিক্ষণ কর্মসূচিতে ইসলামের মৌলিক তত্ত্বগুলো, রাজনৈতিক সংগ্রাম ও পার্টি, সংগঠন, দর্শন ও সমাজবিজ্ঞান ইত্যাদি আলোচনা হতো। শেখ মুজিবুর রহমান ক্লাসে উপস্থিত থাকলেও তাত্ত্বিক আলোচনায় আগ্রহী ছিলেন না। বিখ্যাত দার্শনিক মাওলানা
আজাদ সোবহানীকে দিয়ে রাজনৈতিক কর্মীদের ক্লাস নেয়ার জন্য আমন্ত্রণ করা হয়। শেখ মুজিবুর রহমান ক্লাসে কিছু সময় অবস্থান করেই বের হয়ে যেতেন। তিনি বন্ধুদের বলতেন, ‘তোমরা পণ্ডিত হও, আমার অনেক কাজ আছে।’
পরাধীন জনগোষ্ঠীর মুক্তির চিন্তায় ব্যাকুল যিনি, তিনি কি আর তত্ত্বের বেড়াজালে আবদ্ধ থাকতে পারেন? অন্য দেশের মাটিতে তাদের প্রয়োজনে যে রাজনৈতিক ব্যাকরণ তৈরি হয়েছিল তা এ দেশের জন্য প্রযোজ্য নাও হতে পারে। অনেকে তত্ত্বজ্ঞান অন্বেষণ করে সারাটা জীবন পার করেছেন, না নিজে সফল হয়েছেন, না মানুষের জন্য কিছু করতে পেরেছেন। তিনি তত্ত্বজ্ঞানে নিজেকে সীমাবদ্ধ না রেখে নিজস্ব রাজনৈতিক দর্শন তৈরি করেছিলেন, যা এ দেশের মাটি, মানুষ আর ভূ-রাজনৈতিক বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে সম্পর্কিত। হেগেলের ব্যক্তিত্ব গঠনে ভূগোল ও জলবায়ুর উপাদানের প্রভাবসংক্রান্ত তত্ত্ব শেখ মুজিবের জীবনে প্রতিফলিত হয়। বাংলার নদী জল প্রকৃতি এসবই তার মেজাজ গঠনে সহায়তা করেছেন। এ জনপদের আবহমান সংস্কৃতি, কৃষ্টি ইত্যাদি তার জাতীয়তাবাদী ভাবনার মূল উপাদান, যা বাঙালির নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যের শেকড় থেকে উৎসারিত। তিনি বলেন, ‘আমাদের আদর্শ পরিষ্কার হয়ে রয়েছে। এ পরিষ্কার আদর্শের ভিত্তিতে দেশ স্বাধীন হয়েছে এবং সে আদর্শের ভিত্তিতে এ দেশ চলবে। জাতীয়তাবাদ-বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ—এই বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ চলবে বাংলাদেশে। বাংলার কৃষ্টি, বাংলার ঐতিহ্য, বাংলার আকাশ-বাতাস, বাঙ্গালীর রক্ত দিয়ে বাংলার জাতীয়তাবাদ।’ এভাবে বাঙালির জাতীয়তাবাদের সংজ্ঞা নির্ধারণ করেছিলেন নিজেই।
পাঁচ
শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনীতির মূল কৌশল ছিল জনগণকে সংযুক্ত করা, বিশেষত তরুণদের। তার সাংগঠনিক সফরে তিনি তরুণদের অনুপ্রাণিত করতেন। শওকত আলী তার স্মৃতিকথায় বলেছেন, ‘অল্প বয়সে শেখ মুজিবুর রহমান দিনাজপুর এলেই জ্বালাময়ী বক্তৃতা দিতেন। মিটিং শেষে তিনি আন্ডার এজ বা টিনএজ কর্মীদের নিয়ে বসতেন।’ তিনি ঠিকই বুঝেছিলেন, সংগঠন শক্তিশালী করতে হলে তরুণদের সংযুক্ত করতে হবে। তিনি নিজেই বলেছেন, ‘আমি চোঙ্গা মুখে দিয়ে রাজনীতি করেছি, রাস্তায় হেঁটেছি, ফুটপাতে ঘুমিয়েছি, বাংলাদেশের এমন কোনো মহকুমা নেই, এমন কোনো থানা নেই যেখানে আমি যাইনি।’ তার সাংগঠনিক দক্ষতা সমসাময়িক রাজনীতিবিদদের ছাড়িয়ে গিয়েছিল। আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠিত হওয়ার সময় তিনি জেলে ছিলেন। তবু তিনিই ছিলেন আওয়ামী লীগের প্রাণ ও মূল সংগঠক। সোহরাওয়ার্দী মুসলিম লীগকে অভিজাততন্ত্র থেকে মুক্ত করে সাধারণ মানুষের সংগঠনে পরিণত করেছিলেন। শেখ মুজিবুর রহমান আওয়ামী লীগকে নগর থেকে মফস্বলে নিয়ে গিয়েছিলেন।
ছোটবেলা থেকেই শেখ মুজিবুর রহমানের সাংগঠনিক নেতৃত্বের গুণাবলি বিকশিত হতে থাকে। স্কুলে ক্লাস প্রতিনিধি, ফুটবল টিমের ক্যাপ্টেন, কলেজ সংসদের নেতৃত্ব ইত্যাদি তার মধ্যে নেতৃত্ব প্রদানের সক্ষমতা তৈরি করে। তরুণ বয়স থেকেই তিনি নিজেকে মেলে ধরেন। সে কারণে অনেক সিনিয়র নেতা থাকা সত্ত্বেও ১৯৪৯ সালে আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠিত হওয়ার সময় জেলে বন্দি অবস্থায় তাকে পার্টির যুগ্ম সম্পাদক নিযুক্ত করা হয়। অসামান্য কর্মনিষ্ঠা, দক্ষতা, সাংগঠনিক ক্ষমতা ও সংগ্রামী জাতীয় চেতনা তাকে এগিয়ে রাখে এবং ১৯৫৩ সালের কাউন্সিলে দল তাকে পার্টির সাধারণ সম্পাদক নিযুক্ত করে। এখানে উল্লেখ্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন শুরু থেকেই
দলের প্রধান সংগঠক ও প্রাণশক্তি। তিনি তার অসামান্য দক্ষতা ও যোগ্যতার বলে অতিদ্রুত পার্টির সাংগঠনিক কার্যক্রম গ্রাম পর্যায়ে নিয়ে যেতে সক্ষম হন। ছয় দফা প্রচারে তিনি যে কৌশল গ্রহণ করেন, তাতে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক কাঠামো গ্রাম পর্যায়ে বিস্তৃত হয়।
তিনি তত্কালীন রাজনীতিকদের দৃষ্টির আড়ালে থাকা গ্রামীণ জীবনের বঞ্চনার বিষয়গুলোকে তার রাজনৈতিক কর্মসূচির অন্তর্ভুক্ত করেন ধাপে ধাপে। পূর্ব বাংলায় ঐতিহ্যগতভাবে ধান কাটা মৌসুমে শ্রমিকরা এক জেলা থেকে অন্য জেলায় ধান কাটতে যেতেন। এখনো যান। দক্ষিণাঞ্চলে এদের দাওয়াল বলা হয়। ফরিদপুর ও ঢাকা জেলার লোক, খুলনা ও বরিশালে ধান কাটার মৌসুমে দল বেঁধে দিনমজুর হিসেবে যেত। ধান কেটে তাদের অংশ নিয়ে বাড়ি ফেরার সময় স্থানীয় প্রশাসন শ্রমিকদের কর্ডন প্রথার নামে ধান নিয়ে যেতে বাধা দিলে শেখ মুজিবুর রহমান তার কঠোর প্রতিবাদ করেন। পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থার রিপোর্টে বিষয়টি দেখা যায়। এ ধরনের একটি বিষয়কে রাজনৈতিক ইস্যুতে পরিণত করার ঘটনা তার রাজনৈতিক দূরদর্শিতার পরিচায়ক। কেননা তখন পর্যন্ত ভারতীয় সমাজ সমান্ততান্ত্রিক মনোভাবমুক্ত হতে পারেনি।
১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনের প্রাক্কালে ১২ নভেম্বর দেশের দক্ষিণাঞ্চলের কয়েকটি জেলায় প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ে প্রায় ১০ লাখ লোকের প্রাণহানি ঘটে। এত বড় প্রাকৃতিক দুর্যোগেও পাকিস্তান সরকার চরম উদাসীনতা প্রদর্শন করে। তিনি নির্বাচনী প্রচারণা বন্ধ করে দুর্গত এলাকায় ছুটে যান এবং নয়দিন সেখানে অবস্থান করে উদ্ধারকাজ ও ত্রাণসামগ্রী বিতরণের কাজে অংশ নেন। এভাবে তিনি প্রমাণ করেন, মানুষের পাশে দাঁড়ানোর জন্য ক্ষমতায় থাকা না থাকা বড় কথা নয়।
অন্যদিকে তিনি সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে স্বয়ংসম্পূর্ণ গ্রাম ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য কৃষি বিপ্লবের কথা বলেছিলেন। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের এক ইঞ্চি জমিও অনাবাদি রাখা যাবে না।’ সংগ্রাম এখনো শেষ হয়নি, মূলত সংগ্রাম শুরু হয়েছে। এবারের সংগ্রাম সোনার বাংলা গড়ে তোলার সংগ্রাম। শিক্ষার্থীদেরও তিনি গ্রামীণ অর্থনীতি পুনর্গঠনে অবদান রাখতে বলেন। ১৯৭৩ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের উদ্দেশ্যে এক ভাষণে তিনি বলেন, প্যান্ট-কোট ছেড়ে মাঠে না নামলে বিপ্লব করা যাবে না। আপনাদের কোট-প্যান্ট খুলে একটু গ্রামে নামতে হবে। তার রাজনৈতিক ভাবনা সাধারণ মানুষকে ঘিরে আবর্তিত হয়েছে। সে কারণে তিনি আধুনিক শিক্ষার সুফল গ্রামের মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে চেয়েছিলেন।
ছয়
রাজনীতির পাঠ অবশ্যই গুরু-শিষ্যনির্ভর। শেখ মুজিবুর রহমান সারা জীবন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে রাজনৈতিক গুরু মেনেছেন। তার সঙ্গে মান-অভিমান হয়তো করেছেন, কিন্তু হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর জীবদ্দশায় বঙ্গবন্ধু তার নেতৃত্ব মেনেই রাজনীতি করেছেন। পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল গোলাম মোহম্মদ তাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘লোকে বলে আপনি নাকি কমিউনিস্ট, এ কথা সত্য কিনা’? জবাবে মুজিব বলেন, ‘যদি শহীদ সাহেব কমিউনিস্ট হন, তবে আমিও কমিউনিস্ট।’ এ থেকেই গুরুমান্যতার বিষয়টি বোঝা যায়। গুরুমারা বিদ্যা তিনি কখনই শেখেননি। নেতার প্রতি নিঃস্বার্থ ও নিখাদ ভালোবাসা তার চরিত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর অনেক সিদ্ধান্তের সমালোচনা তিনি করেছেন, কিন্তু পেছনে নয়, তার সামনেই করেছেন, প্রতিবাদ করেছেন, অনেক সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করতে অনেকটা বাধ্যও করেছেন। চোখের জল ফেলেছেন, অভিমান করেছেন, কিন্তু তাকে অসম্মান করেননি; তার অসম্মান মেনেও নেননি কখনো। রাজনীতিতে গুরু-শিষ্যের মধ্যে সম্পর্ক বোঝাপড়ার, তাঁবেদারি বা তোষামোদীর নয়, তা শেখ মুজিবুর রহমান ও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সম্পর্ক বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায়। মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর প্রতিও শেখ মুজিবের ছিল অগাধ শ্রদ্ধা। ভারতভাগের পর দুজন এলেন দুই জায়গা থেকে, একজন কলকাতা থেকে, অন্যজন আসাম থেকে, কিন্তু দ্রুতই দুজনের পথ মিলে গেল একই পথে। মওলানা ভাসানী তরুণ শেখ মুজিবের নেতৃত্বের প্রতি আস্থাশীল ছিলেন। অসামান্য সাহস ও সাংগঠনিক তত্পরতার কারণে দ্রুতই তরুণ মুজিব ভাসানীর প্রিয়ভাজনে পরিণত হন। বঙ্গবন্ধু তার সমসাময়িক রাজনীতিবিদ, শিক্ষক, সাংবাদিক, দার্শনিক, সাহিত্যিক, কবি, গায়ক, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব সবার সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা রাখতেন। তিনি তাদের অনেকের দ্বারাই অনুপ্রাণিত হন, অনেকের আবার সমালোচনা করেছেন। এভাবে তিনি তত্কালীন রাজনীতির শীর্ষ ব্যক্তিত্ব থেকে সাধারণ মানুষ সবার নির্ভরতার প্রতীকে পরিণত হন।
শেখ মুজিবের রাজনৈতিক দর্শনের শেকড় পল্লীর উর্বর মাটির গভীরে প্রোথিত। টুঙ্গিপাড়ার মফস্বলে জন্ম—কসমোপলিটন শহর কলকাতায় রাজনৈতিক শিক্ষার চূড়ান্ত পাঠ গ্রহণ—আর ঢাকায় ফিরে করণীয় নির্ধারণ। অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছতে রাজনীতি নিয়ে গেলেন একেবারে গ্রাম পর্যায়ে। উপমহাদেশের রাজনীতিতে সংগঠনকে এত মফস্বলে পৌঁছে দিতে শেখ মুজিবের চেয়ে আগে কেউ এত সফল হননি। তিনি পেরেছেন, কারণ তিনি মফস্বলের মানুষের জীবনের পাঠ ভালোভাবেই গ্রহণ করেছিলেন। সাধারণ মানুষের সার্বিক মুক্তিই ছিল তার মূল রাজনীতি। গ্রামে জন্ম ও বেড়ে ওঠা—গ্রামই ছিল তার রাজনীতির ভিত্তি—গ্রামকে ভালোবেসে তাই গ্রামেই পেতেছেন জীবনের শেষ শয্যা।
লেখক: ড. মো. আবদুর রহিম, সহযোগী অধ্যাপক, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়