ঢাকা পড়ে যাচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের প্রথম ভাস্কর্য ‘জাগ্রত চৌরঙ্গী’

গাজীপুর কণ্ঠ ডেস্ক : যুদ্ধের আগেই যুদ্ধ শুরু হয়েছিল যেখানটায়, মুক্তিযুদ্ধ-উত্তরকালে সেখানে নির্মিত হলো মুক্তিযুদ্ধের প্রথম ভাস্কর্য ‘জাগ্রত চৌরঙ্গী’। বাংলাদেশে ভাস্কর্য চর্চার পথিকৃৎ আবদুর রাজ্জাক নির্মিত সেই ইতিহাসটি ঢাকা পড়ে যাচ্ছে ইটপাথরের স্থাপনায়। একটু উনিশ-বিশ করে ভাস্কর্যটি স্থানান্তরের পরিকল্পনাও চলছে।

১৯৭১ সালের ১৯ মার্চ গাজীপুরে হয়েছিল প্রথম প্রতিরোধ যুদ্ধ। তারই স্মৃতিবিজড়িত চান্দনা চৌরাস্তায় তৈরি করা হয় ভাস্কর্য। ‘জাগ্রত চৌরঙ্গী’ নামে পরিচিত এই ভাস্কর্যের প্রকৃত নাম ‘মুক্তিযোদ্ধা’। চত্বরটির নাম রাখা হয়েছিল ‘জাগ্রত চৌরঙ্গী’।

ওই স্থান ঘিরে চলছে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের বাস র‌্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) প্রকল্পের কাজ। তাতেই মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিময় স্থান ও ভাস্কর্যটি চলে যাচ্ছে দৃষ্টির আড়ালে।

বিআরটির কাজ করার জন্য এরই মধ্যে ‘জাগ্রত চৌরঙ্গী’র সীমানাপ্রাচীর অপসারণ করা হয়েছে। নির্মাণসামগ্রীর স্তূপ জমানো হয়েছে ভাস্কর্যের বেদিতে। ঢাকা পড়ে যাওয়া ভাস্কর্যটি চৌরাস্তা থেকে স্থানান্তরের আলোচনা চলছে।

গাজীপুরের জেলা প্রশাসক আনিসুর রহমান বলেন, ‘ভাস্কর্যটি স্থানান্তরের কথা বলছেন কেউ কেউ। কিন্তু এটি আমাদের ইতিহাস-ঐতিহ্যের সঙ্গে জড়িয়ে আছে। তাই চট করে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ নেই। তবে সবার মত পর্যালোচনা করে দেখা হচ্ছে।’

ভাওয়াল বদরে আলম সরকারি কলেজের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক অসীম বিভাকর বলেন, ‘ভাস্কর্যটি যে স্থানে স্থাপন করা হয়েছে, তার একটি ঐতিহাসিক গুরুত্ব রয়েছে। ১৯৭১ সালের ১৯ মার্চের প্রথম প্রতিরোধ যুদ্ধের শহীদ হুরমত ও মনু খলিফাদের স্মৃতিতে ভাস্কর্যটি নির্মাণ করা হয়েছিল।’

তিনি জানান, গাজীপুরে দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের তৎকালীন অধিনায়ক আমীন আহম্মেদ চৌধুরী বীরবিক্রম ঐতিহাসিক ও স্থানিক গুরুত্ব বিবেচনা করেই ভাস্কর্যটি এখানে নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। ভাস্কর্যটির বেদিতে ১৬ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ৩ নম্বর সেক্টরের ১০০ জন এবং ১১ নম্বর সেক্টরের ১০৭ জন শহীদ সেনা ও মুক্তিযোদ্ধার নাম খোদাই করা হয়েছিল, যা এখন পড়াই যায় না।

১৯ মার্চের যুদ্ধের আগে গঠিত প্রতিরোধ কমিটির আহ্বায়ক ছিলেন বর্তমান মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক। ‘জাগ্রত চৌরঙ্গী’র ঢাকা পড়ে যাওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ফ্লাইওভারটা হয়ে গেলে এটা একই আদলে নতুনভাবে করা হবে। প্রয়োজনে ভাস্কর্যের বেদি আরও উঁচু করা যাবে।’ একই জায়গায় তা করা হবে কিনা জিজ্ঞেস করা হলে মন্ত্রী বলেন, ‘স্থানান্তরের কোনো সুযোগই নেই। ১০-২০ গজ এদিক-ওদিক হতে পারে; একটু উনিশ-বিশ আর কী।’

জয়দেবপুর চৌরাস্তায় স্থাপিত সুউচ্চ ভাস্কর্যটির উত্তরে ময়মনসিংহ মহাসড়ক, পশ্চিমে টাঙ্গাইল মহাসড়ক, দক্ষিণে ঢাকা আর পূর্বে গাজীপুর শহর। বিআরটি প্রকল্প শুরুর আগে বহুদূর থেকে দেখা মিলত ‘জাগ্রত চৌরঙ্গী’র।

বিআরটি নির্মাণ কর্তৃপক্ষ ঢাকা বাস র‌্যাপিড ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সফিকুল ইসলাম বলেন, ‘বিআরটি প্রকল্পের জন্য ভাস্কর্য ভাঙা বা স্থানান্তর করার প্রয়োজন নেই। তবে এর ফলে অনেক দূর থেকে আর ভাস্কর্যটি দেখতে পাওয়া যাবে না। তাই প্রয়োজনে এটিকে চান্দনা স্কুল মাঠে স্থানান্তর করে দেওয়ার পরিকল্পনা রাখা হয়েছে। তবে গাজীপুর সিটি করপোরেশন জমি দিলেই এটি সম্ভব হবে। কারণ, চৌরাস্তাটির মালিকানা গাজীপুর সিটি করপোরেশনের এবং রাস্তাটি সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের।

ভাস্কর আবদুর রাজ্জাকের ছেলে আসিফ আহমেদ অণু বলেন, ‘ভাস্কর্যটি নতুন করে নির্মাণ তো দূরের কথা, উনিশ-বিশ করারও কোনো সুযোগ নেই বলে আমি মনে করি। শুরুতে শুনেছিলাম, এটি ভেঙে ফেলা হবে। মাস ছয়েক আগে দেখে এলাম, ভাস্কর্যের বেদিতে বটের চারা গজিয়েছে। পরিবারের সদস্য হিসেবে এগুলো আমাদের ব্যথিত করছে। কিন্তু এটি তো আমাদের পারিবারিক সম্পদ নয়; জাতির আবেগের বিষয়। নতুন করে নির্মাণ করা হলে এটি আর আবদুর রাজ্জাকের ভাস্কর্য থাকবে না, হয়ে যাবে ওই ভাস্কর্যের রেপ্লিকা।’

‘জাগ্রত চৌরঙ্গী’ নির্মাণের মূল উদ্যোক্তা আমীন আহম্মেদ চৌধুরীর ‘১৯৭১ ও আমার সামরিক জীবন’ বই থেকে জানা যায়, হামিদুজ্জামান খান ভাস্কর্যটি নির্মাণে ভাস্করের প্রধান সহযোগী হিসেবে কাজ করেছিলেন। পরে হামিদুজ্জামান খান বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান ভাস্কর্যশিল্পী হিসেবে প্রতিষ্ঠা পান। তার সঙ্গে গত ১৪ মার্চ দেখা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের ভাস্কর্য বিভাগের চেয়ারম্যানের কক্ষে। তার দিন তিনেক আগে তিনি ভাস্কর্যটি দেখতে গিয়েছিলেন জানিয়ে বলেন, ‘ভয়াবহ অবস্থা করে রাখা হয়েছে এটাকে, বেদির নিচটা আবর্জনার স্তূপ।’

হামিদুজ্জামান খান জানান, টনকে টন লোহা ব্যবহার করা হয়েছে ভাস্কর্যটি নির্মাণের সময়। ওপরে যতটা, নিচেও ততটা ফাউন্ডেশন রয়েছে। এটি আর্ট কলেজ, যা বর্তমানে চারুকলা অনুষদ, প্রথমে সেখানে নির্মাণ করা হয়। ঢাকায় সে সময় এত বড় একটা ভাস্কর্য বহন করার মতো একটাই ক্রেন ছিল। সেই ক্রেন দিয়ে উঠিয়ে জয়দেবপুরে নিয়ে যাওয়ার পর দেখা যায়, হাঁটুর কাছে একটু ফাটলের মতো দেখা দিয়েছে। ওই ভাস্কর্যটির এক হাতে মশাল, আরেক হাতে বন্দুক ছিল। ওটাই ছিল ‘জাগ্রত চৌরঙ্গী’র প্রথম সংস্করণ, যা জয়দেবপুরের রাজবাড়িতে রাখা আছে।

ভাস্কর্যটির দ্বিতীয় সংস্করণ নির্মাণের গল্প বলতে গিয়ে হামিদুজ্জামান বলেন, ‘ভাস্কর্যস্থলে তাঁবু করে কাজ করেছি আমরা এবং মশালের জায়গায় চৌরাস্তায় স্থাপিত ভাস্কর্যের হাতে গ্রেনেড দেওয়া হয়েছে। আমরা এই ভাস্কর্যটাকে প্রকৌশলী আবদুর রশিদের সহযোগিতায় এমন শক্ত ফাউন্ডেশনের ওপর স্থাপন করেছি, এটার ক্ষতি না করে স্থানান্তর করা অসম্ভব।’

২৪ ফুট পাঁচ ইঞ্চি বেদিসহ ‘জাগ্রত চৌরঙ্গী’র উচ্চতা ৪২ ফুট ২ ইঞ্চি। কংক্রিট, ধূসর ও সাদা সিমেন্টের ঢালাইয়ে ভাস্কর্যটি নির্মাণ করা হয়েছিল। এটি শুধু মুক্তিযুদ্ধের নয়, মুক্তিযুদ্ধ-উত্তর বাংলাদেশের প্রথম উন্মুক্ত ভাস্কর্য।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের ভাস্কর্য বিভাগের চেয়ারম্যান নাসিমা হক মিতু বলেন, ‘এই ভাস্কর্যটির ওপর দিয়ে একটি ফ্লাইওভার নিয়ে যাওয়ার আগে ভাবা উচিত ছিল। উন্নয়ন দরকার; ইতিহাস-ঐতিহ্যকেও রক্ষা করতে হবে। শিল্পসংস্কৃতিতে উন্নত দেশগুলোয় এমন নজির খুব দুর্লভ নয় যে একটি শিল্পকর্মকে রক্ষা করার জন্য উন্নয়ন পরিকল্পনায় পরিবর্তন আনা হয়েছে, বিপুল অর্থ ব্যয় করা হয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক বাংলাদেশে ভাস্কর্য বিষয়ে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সূত্রপাত করেছেন, তার এই ভাস্কর্যটির ঐতিহাসিক গুরুত্ব অপরিসীম। যদি এটি স্থানান্তর করতে হয়, তাহলে সেখানে উন্নয়নকাজ শুরু করার আগে করা হলো না কেন? ফ্লাইওভারের কাজ করার ফলে রাস্তায় যে কম্পন হয়েছে, তাতেই ভাস্কর্যটির অনেক ক্ষতি হয়ে গেছে।’

ভাস্কর্য বিভাগের আরেক শিক্ষক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ভাস্কর্য প্রাক্তনি সংঘর সদস্যপদ সম্পাদক নাসিমুল খবির ডিউক বলেন, ‘আমাকে বিআরটি প্রকল্পের কোনো একজন ইঞ্জিনিয়ার হঠাৎ ফোন করে জানালেন, ভাস্কর্যটি স্থানান্তর করতে হবে। আমি তাকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে যোগাযোগ করার পরামর্শ দিয়েছি। স্পষ্ট করে বলে দিয়েছি, এটি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে প্রথম ভাস্কর্য। এর সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি জড়িয়ে আছে। উচ্চতর শিক্ষায় উন্মুক্ত এ ভাস্কর্যটি বিষয়ে পাঠ করা হয়।’

বাংলাদেশে যত উন্মুক্ত ভাস্কর্য নির্মিত হয়েছে, তার অধিকাংশই মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক। ‘অপরাজেয় বাংলা’ থেকে ‘সাবাস বাংলাদেশ’ পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক ভাস্কর্যগুলো ‘জাগ্রত চৌরঙ্গী’র মতো বিপন্নদশা না হলেও রক্ষণাবেক্ষণে রয়েছে চরম ঔদাসীন্য।

সংরক্ষণের প্রয়োজন হয়ে পড়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে একাকার হয়ে যাওয়া ‘অপরাজেয় বাংলা’রও। এই ভাস্কর্যের গায়ে ঝরে পড়ছে ইউক্যালিপটাস গাছের কষ। গাছপালার তলায় আছে বলে ভাস্কর্যটির গায়ে পড়ে পাখির বিষ্টা। ক্ষয় ধরেছে ভাস্কর্যে। তুলনামূলকভাবে ভালো অবস্থায় রয়েছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘সাবাস বাংলাদেশ’ এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘সংশপ্তক’, কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘বিজয় ৭১’ এবং ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘মুক্তবাংলা’। এগুলো অবশ্য ‘অপরাজেয় বাংলা’র অনেক পরে নির্মাণ করা হয়েছে।

 

সূত্র: সমকাল

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button