বীর মুক্তিযোদ্ধাদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রকাশ হয়নি এখনও!

গাজীপুর কণ্ঠ ডেস্ক : গত এক সপ্তাহ ধরে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলে আসছিলেন ২৬ মার্চ বীর মুক্তিযোদ্ধাদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রকাশ করা হবে। তবে এখন তিনি বলছেন তালিকা আগে থেকেই ওয়েবসাইটে রয়েছে।

শনিবার (২৬ মার্চ) এই বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘‘আমরা তালিকা আগেই প্রকাশ করে দিয়েছি। আমাদের ওয়েবসাইটে যে তালিকাটি আছে সেটাই আমাদের সমন্বিত তালিকা।’’

একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির মন্ত্রীর এই বক্তব্য সঠিক বলে মনে করেন না। তিনি বলেন, ‘‘ওয়েবসাইটে যেটা আছে সেটা পূর্ণাঙ্গ তালিকা না। গত পাঁচ বছর ধরে যাচাই বাছাই করে পূর্ণাঙ্গ তালিকাটি প্রকাশ করার কথা ছিল।’’ শাহরিয়ার কবির বলেন, ‘‘নির্ভুল তালিকা প্রণয়নের দাবি দীর্ঘদিন ধরেই আমরা করে আসছি, কিন্তু আজও হয়নি। যদিও স্বাধীনতার পর বেশিরভাগ সময় স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি ক্ষমতায় ছিল না। পাশাপাশি সরকারি আমলাদের দায়িত্ব দেওয়ার কারণেই এটা বিলম্ব হচ্ছে। তাদের তো এর বাইরেও অনেক কাজ থাকে। আমলানির্ভর হওয়ার কারণে অতীতেও নানা বিতর্ক তৈরি হয়েছে। আমরা চাই, আর বিলম্ব না করে প্রকৃত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা দ্রুত প্রকাশ হোক।” যদিও এই কাজটি খুব সহজ নয় বলেও জানান তিনি।

২০২১ সালের ২৫ মার্চ মন্ত্রণালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতাসহ এক লাখ ৪৭ হাজার ৫৩৭ জন বীর মুক্তিযোদ্ধার প্রথম তালিকা প্রকাশ করেন, যেটিকে খসড়া তালিকা বলা হচ্ছে। তারপর যাচাই বাছাই শেষে মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে এক লাখ ৭৭ হাজার ২০০ জন মুক্তিযোদ্ধার তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে। আরও ৪০ হাজার আবেদন যাচাই বাছাই চলছে। এই যাচাই বাছাই ২৬ মার্চের মধ্যে শেষ করার কথা ছিল।

জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের (জামুকা) একজন সদস্য শনিবার বলেন, ‘‘২৬ মার্চ যে পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রকাশ করা যাবে না, সেটা আমরা আগেই বলেছি। কারণ অনেক জেলা থেকে ডিসিরা যাচাই বাছাইয়ের কাজ শেষ করে তালিকা আমাদের কাছে পাঠাননি। ফলে গত ৫ মার্চ জামুকার বর্তমান কমিটির মেয়াদ শেষের আগে এই চূড়ান্ত করা যায়নি।”

মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে আগে ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল, তালিকা চূড়ান্ত হলে এবার বীর মুক্তিযোদ্ধাদের মাসিক ভাতাসহ অন্যান্য সুযোগ সুবিধার জন্য স্মার্ট কার্ডও দেবে মন্ত্রণালয়। তালিকার পাশাপাশি প্রত্যেক মুক্তিযোদ্ধার প্রোফাইল একটি সফটওয়্যারে সংরক্ষণ করা থাকবে। ২০১৭ সালের ২২ জানুয়ারি সপ্তমবারের মতো সারাদেশে মুক্তিযোদ্ধাদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রণয়নের জন্য যাচাই বাছাই শুরু হয়। এরপর পাঁচ বছর কেটে গেলেও কাজ শেষ করা যায়নি।

ছয়বার তালিকা তৈরি

জানা গেছে, স্বাধীনতার পর বিভিন্ন সরকারের আমলে এ পর্যন্ত ছয়বার তালিকা প্রণয়ন করা হয়েছে। প্রথম তালিকা করা হয় ১৯৮৬ সালে। তখন জাতীয় কমিটির তৈরি এক লাখ দুই হাজার ৪৫৮জন বীর মুক্তিযোদ্ধার নাম পাঁচটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশ করা হয়। তবে ওই তালিকা গেজেট আকারে প্রকাশ করা হয়নি। ১৯৮৮ সালে মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাষ্ট্রের করা তালিকায় সংখ্যা ছিল ৭০ হাজার ৮৯২। এর মধ্যে বেসামরিক বীর মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ৫১ হাজার ৫২৬ এবং বিশেষ তালিকায় ছিলেন ১৯ হাজার ৩৬৬ জন। পরে ১৯৯৪ সালে বিএনপি সরকারের সময় ৮৬ হাজার বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তালিকাভুক্ত হন। এরপর ১৯৯৮ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ এক লাখ ৮৬ হাজার ৭৯০ জনের নামের তালিকা প্রকাশ করে। ২০০১ থেকে ২০০৬ সালে বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট সরকার দুই লাখ ১০ হাজার ৫৮১ জনকে তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে এবং পরে এক লাখ ৯৮ হাজার ৮৮৯ জনের নাম গেজেট আকারে প্রকাশ করে। ২০১১ সালে ওই তালিকা সংশোধনসহ নতুন করে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের স্বীকৃতি দিতে আবেদন গ্রহণ করে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার। এর আলোকে ২০১৪ সালের ৩১ অক্টোবরের মধ্যে অনলাইন ও সরাসরি প্রায় এক লাখ ৩৯ হাজার আবেদন জমা নেওয়া হয়। এরপর ২০১৭ সালে জানুয়ারিতে পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রকাশের উদ্যোগ নেওয়া হয়। যেটা ২৬ মার্চ প্রকাশ করার কথা ছিল।

৪০ সরকারি চাকরিজীবীর সনদ বাতিল

গেজেটভুক্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাইয়ের কার্যক্রমের মধ্যে পাঁচটি ক্যাটাগরিতে শহীদ, যুদ্ধাহত, সামরিক ও বেসামরিক, বীরঙ্গানা, শব্দসৈনিক, মুজিবনগর কর্মচারীসহ ৩২ শ্রেণির স্বীকৃতিপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধার তথ্য যাচাই বাছাই করার কাজ চলছে। ‘অ-মুক্তিযোদ্ধা’ চিহ্নিত করার কার্যক্রমও চলছে। বিএনপির আমল থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত গেজেটভুক্ত ১০ হাজার ‘অ-মুক্তিযোদ্ধার’ সনদ বাতিল হয়েছে।

মিথ্যা তথ্য দিয়ে মুক্তিযোদ্ধা সনদ নেওয়ায় ২০১৪ সালে সাবেক স্বাস্থ্য সচিব নিয়াজ উদ্দিন মিয়া, সরকারি কর্মকমিশনের (পিএসসি) সাবেক সচিব এ কে এম আমির হোসেন, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সাবেক সচিব মোল্লা ওয়াহিদুজ্জামানসহ ৪০ সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর সনদ বাতিল করে মন্ত্রণালয়। আলোচিত এ ঘটনা প্রকাশ্যে এলে স্বাস্থ্য সচিব নিয়াজ উদ্দিন মিয়া, সাবেক সচিব এ কে এম আমির হোসেন ও মোল্লা ওয়াহিদুজ্জামানকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠায় সরকার। সম্প্রতি একজন মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের দুই জন সংসদ সদস্যের আবেদন পরীক্ষার পর বাতিল করেছে জামুকা।

উল্লেখ্য, মুক্তিযোদ্ধারা বর্তমানে ২০ হাজার টাকা মাসিক সম্মানী ভাতা, দুই ঈদে ১০ হাজার টাকা করে ২০ হাজার টাকা উৎসব ভাতা, পাঁচ হাজার টাকা বিজয় দিবসের ভাতা এবং দুই হাজার টাকা বাংলা নববর্ষ ভাতা এবং চিকিৎসাসহ সন্তানদের জন্য নির্ধারিত অন্যান্য আর্থিক সুবিধা পেয়ে থাকেন।

 

সূত্র: ডয়চে ভেলে

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button