কালীগঞ্জে মোমেনের নেতৃত্বে কোটি টাকার মালামাল চুরি, আদালতে স্বীকারোক্তি

গাজীপুর কণ্ঠ ডেস্ক : ৩০ লাখ টাকা চাঁদার দাবিতে কালীগঞ্জের পাড়াবর্তা এলাকায় জে আর কে কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ নামে এক ফ্যাক্টরিতে হামলা ও চুরির ঘটনা ঘটেছে।
ঘটনার নেতৃত্বে থাকা নাগরীর সমালোচিত মোমেন মিয়াকে প্রধান আসামি করে ১২ জনের নাম উল্লেখ এবং অজ্ঞাত আরো ৮০ জনের বিরুদ্ধে চাঁদা দাবি, চুরি এবং হুমকির অভিযোগে ১৪৩, ৪৪৭, ৩৮৫, ৩৭৯, ৪২৭ ও ৫০৬ ধারায় কালীগঞ্জ থানায় মামলা দায়ের করেছে ফ্যাক্টরির মালিক কামাল হোসেন।
মামলা দায়েরের পর এজাহার নামীয় ৪ আসামি এবং সন্দিগ্ধ আরো এক আসামিকে গ্রেপ্তার করে আদালতে পাঠিয়েছে পুলিশ। এরমধ্যে একজন ঘটনার দায় স্বীকার করে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে।
থানা, আদালত এবং মামলার বাদী সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
অভিযুক্ত প্রধান আসামি মোমেন মিয়া (৪৫) কালীগঞ্জের নাগরী এলাকার রয়ান গ্রামের মোস্তফা মিয়ার ছেলে। অন্যরা হলো দাহিন্দী এলাকার হাফিজুল্লাহর ছেলে নাইম (৩৫), পাড়াবর্তা এলাকার ইমান আলীর ছেলে রুহুল (৩৩), আলমাছের ছেলে আলাউদ্দিন (৩০), আহম্মদের ছেলে রাকিব (২৮), আনিসুল (৩০), রহিসুল (২৮), আরিফ (২৪), মৃত আব্দুল গাফুরের ছেলে সবুজ মিয়া (৩৮), কেটুন এলাকার সত্যরঞ্জনের ছেলে রামু (৩৫), কেটুনের লিংকন (৪০) এবং পাড়াবর্তা এলাকার আলমাছের ছেলে ইসলাম উদ্দিন (২৮)।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় একাধিক ব্যক্তি জানিয়েছে, এই মোমেন মিয়া ১০-১২ বছর আগেও এলাকায় দিনমজুর হিসেবে মানুষের বাড়িতে কাজ করতো। পরবর্তীতে স্থানীয় এক ব্যক্তির সহায়তায় গাজীপুর জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে উমেদার (এমএলএসএস) হিসেবে চাকরি পায়। এরপর সে বিভিন্ন লোকের জমির পর্চা সংগ্রহ করে দিন। বিগত কয়েক বছর পূর্বে সে জমির ব্যবসার সঙ্গে জড়িত হয়। সে সময় প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নাম করে স্থানীয় একাধিক ব্যক্তির জমি জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে বিভিন্ন ব্যক্তির কাছে বিক্রি করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়। এছাড়াও চাকরি দেয়ার কথা বলে অনেকের কাছ থেকে টাকা নিয়ে আর ফিরিয়ে দেয়নি। সে পূর্বে একাধিকবার নাগরী বাজার এবং এলাকার বিভিন্ন স্থানে মানুষের হাতে লাঞ্চিত হয়েছে এবং মারধর খেয়েছে। সে এলাকায় ব্যাপক সমালোচিত ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত।
এজাহার ও বাদী সূত্রে জানা গেছে, কালীগঞ্জের পাড়াবর্তা এলাকায় জে আর কে কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ গত দুই বছর যাবত তৈরি পোশাক কারখানায় ব্যবহৃত কেমিক্যাল উৎপাদন করে আসছে। অভিযুক্ত আসামিরা বিগত ছয় মাস যাবত ৩০ লাখ টাকা চাঁদার দাবিতে কোম্পানির বিভিন্ন ক্ষয়ক্ষতি ও কোম্পানির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের খুন-জখম করার হুমকি দিয়ে আসছিল। দাবিকৃত চাঁদা দিতে বাদী অপারগতা প্রকাশ করলে অভিযুক্তরা সুযোগ মতো কোম্পানির বড় ক্ষতি করবে বলে হুমকি দিচ্ছিল। এরই ধারাবাহিকতায় গত ৩১ মার্চ সকাল আটটার দিকে কোম্পানি বন্ধ থাকা অবস্থায় অভিযুক্ত আসামিরা আরো ৭০-৮০ জন অজ্ঞাত আসামিকে নিয়ে দেশীয় অস্ত্র দা, ছেন, লোহার বড় চাপাতি, শাবল ও কোম্পানির মেশিনারিজ কাটার যন্ত্রপাতি এবং ৮-১০টি নাম্বার বিহীন ড্রামট্রাক নিয়ে জোরপূর্বক কোম্পানিতে প্রবেশ করে। সে সময় নিরাপত্তা প্রহরীর মোবাইল ফোন ছিনিয়ে নিয়ে তাকে বেঁধে রেখে কোম্পানিতে থাকা কেমিক্যালের কাঁচামাল ফেলে দেয় এবং হামলা চালিয়ে প্রায় ২০ লাখ টাকার ক্ষতিসাধন করে। পরে আসামিরা কোম্পানির চারদিকের থাকা বাউন্ডারির ইন্ডাস্ট্রিয়াল টিন এক লাখ স্কয়ার ফিট (আনুমানিক মূল্য ৭০ লাখ টাকা), ২০০ পিচ ইন্ডাস্ট্রিয়াল লোহার পিলার (আনুমানিক মূল্য ২০ লাখ টাকা), লোহার অ্যাঙ্গেল ১০ টন (আনুমানিক মূল্য ৮ লাখ টাকা), ছাগল (খাসি) ৮টিসহ (আনুমানিক মূল্য ১ লাখ ২০ হাজার টাকা) মোট ৯৯ লাখ ২০ হাজার টাকা মূল্যমানের মালামাল তাদের ড্রাম ট্রাকে উঠিয়ে দুপুর দুইটার দিকে চুরি করে পালিয়ে যায়।
আদলত সূত্রে জানা গেছে, এজাহারনামীয় আসামিদের মধ্যে মধ্যে রহিসুল, আনিসুল, সবুজ মিয়া ও আরিফকে মামলা দায়েরের পর গত ৮ এপ্রিল গ্রেপ্তার করে আদালতে পাঠায় পুলিশ। পরে ১০ এপ্রিল তাদের ৫ দিনের রিমান্ড চেয়ে আদালতে আবেদন করে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা উপপরিদর্শক (এসআই) মশিউর রহমান খান। এরপর ১৩ এপ্রিল গাজীপুর আমলি আদালতের বিচারক সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ইসরাত জেনিফার জেরিন তাদের দুই দিন করে জেলগেটে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নির্দেশ দেন। বর্তমানে তারা সকলে জামিনে ছাড়া পেয়ে এলাকায় ফিরেছে।
এছাড়াও মামলায় সন্ধিগ্ধ আসামি হিসেবে ভাঙ্গারি মালামাল ব্যবসায়ী মুন্সীগঞ্জ জেলার টঙ্গীবাড়ী থানা বানারী গ্রামের সামসুল হকের ছেলে নাছির শেখকে (৩৫) নাগরীর বরইতলা এলাকা থেকে গত ১৬ এপ্রিল গ্রেপ্তার করে আদালতে পাঠালে ঘটনার দায় স্বীকার করে সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ইসরাত জেনিফার জেরিনের আদালতে জবানবন্দিমূলক স্বীকারোক্তি দিয়েছে। সেও জামিনে ছাড়া পেয়েছে।
মামলার বাদী জে আর কে কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজের মালিক কামাল হোসেন বলেন, ফ্যাক্টরিতে হামলা, লুটপাট ও চুরির ঘটনায় থানায় মামলা দায়ের করা হয়েছে। পরবর্তীতে পুলিশ পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করে আদালতে পাঠায়। সম্প্রতি মামলা উঠিয়ে নেয়ার দাবিতে মোমেনসহ অন্য আসামিরা আবারো হামলার ঘটনা ঘটিয়েছে। এ বিষয়ে থানায় লিখিত অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে।
এসব বিষয়ে জানতে অভিযুক্ত মোমেন মিয়ার ব্যবহৃত ব্যক্তিগত মোবাইল নাম্বারে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা কালীগঞ্জ থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মশিউর রহমান খান বলেন, মামলা দায়েরের পর এজাহারনামীয় ৪ আসামি এবং সন্ধিগ্ধ আসামি চোরাই মালামাল ক্রেতা ভাঙ্গারী ব্যবসায়ী নাছির শেখকে গ্রেপ্তার করে আদালতে পাঠানো হয়। পরে নাছির শেখ ঘটনার দায় স্বীকার করে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। অন্য আসামিরা উচ্চ আদালত থেকে জামিনে রয়েছে। মামলার তদন্ত কার্যক্রম অব্যাহত আছে।