পুলিশ নিয়ে মানুষের প্রশ্নের শেষ নেই: অতিরিক্ত আইজিপি মোখলেসুর রহমান

মো. মোখলেসুর রহমান ১৯৬০ সালে জামালপুরের পশ্চিম নয়াপাড়া  গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ময়মনসিংহের বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স সম্পন্ন করেন। ১৯৮৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে সহকারী পুলিশ সুপার (সপ্তম বিসিএস) হিসেবে পুলিশ বাহিনীতে যোগ দেন। দীর্ঘ কর্মজীবনে তিনি বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০১৫ সাল থেকে তিনি পুলিশ সদর দপ্তরে অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক (এঅ্যান্ডও) হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছেন। আগামী ৪ মে তিনি চলে যাবেন অবসরে। চাকরি জীবনের সুখ-দুঃখ ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে খোলামেলা কথা বলেছেন তিনি। 

চাকরি জীবন তো প্রায় শেষের দিকে। এই সময়ে আপনার সফলতা ও ব্যর্থতা নিয়ে ভাবনা কী?

মোখলেসুর রহমান : হ্যাঁ, চাকরির জীবন একদমই শেষ। এই সময়ে সফলতা বলতে গেলে বলব, ব্যক্তিগতভাবে অন্যায় কাজ থেকে অনেক প্রলোভনের মধ্যেও নিজেকে দূরে রাখতে সক্ষম হয়েছি। অনেক বিপন্ন মানুষের পাশে দাঁড়াতে পেরেছি। অনেক গরিব মানুষের কিছু উপকার করতে পেরেছি। তাদের আইনি সহায়তা দেওয়া বা পাশে গিয়ে তাদের শক্তি-সাহস জোগানোর কাজগুলো অনেক সময় করতে পেরেছি। পুলিশের কাজকর্মের পাশাপাশি নারীর প্রতি সহিংসতা রোধ ও বাল্যবিয়ে নিয়ে কাজ করেছি। ব্যক্তিগত উদ্যোগ নিয়ে কাজ করায় হঠাৎ করেই স্বীকৃতি পেয়েছি। জাতিসংঘের একটি সংস্থা ইউএনপিএ আমাকে গ্লোবাল চ্যাম্পিয়ন হিসেবে

স্বীকৃতি দিয়েছে। আর ব্যর্থতার কথা যদি বলতে হয় সংগঠনটায় আমি চাকরি করি সেই পুলিশ নিয়ে মানুষের প্রশ্নের শেষ নেই। অনেক প্রশ্ন, অনেক অপ্রাপ্তি বা অতৃপ্তি মানুষের ভেতরে আছে। যেগুলো দূর করতে অনেক সময় সর্বাত্মক প্রচেষ্টা আন্তরিকভাবে নিয়েছি। কিন্তু সেগুলোর হয়তো সুরাহা হয়নি। যে অবস্থায় এসে চাকরিতে শুরু করেছিলাম এই জায়গাতেই আমার আক্ষেপটা থেকে গেল সাধারণ মানুষ যেভাবে আমাদের দেখতে চায় সেইভাবে এটার একটা পরিবর্তন সাধন করে দেওয়া সম্ভব হলো না।

পুলিশ নিয়ে আপনার স্বপ্ন কি আসলেই পূরণ হয়েছে?

মোখলেসুর রহমান : চাকরি করতে এসেছি নিজের ক্ষুন্নিবৃত্তি নিবারণের জন্য। স্বপ্ন নিয়ে চাকরিতে আসিনি। তবে চাকরিতে আসার পর যেটা মনে হয়েছে সাধারণ মানুষের জন্য যদি এই বিভাগটিকে নিবেদিত করা যেত, মানুষ যেভাবে চায় আমাদের সেভাবে যদি সেবাটা প্রদান করতে পারতাম এবং এটা বাস্তবায়িত হলেই স্বপ্নসাধগুলো পূরণ হতো।

বড়লোকদের জন্য পুলিশ আর গরিবের জন্য পুলিশ নয় এই ধরনের অভিযোগ প্রায়ই শোনা যায় আসলেই কি তা সত্য?

মোখলেসুর রহমান : হ্যাঁ, আমি সবসময়ই চেয়েছি গরিব মানুষের জন্য একটা পুলিশি ব্যবস্থা থাকুক। আমাদের ঐতিহ্যগত ট্র্যাডিশনাল পুলিশিংটা আছে তার পাশাাপশি হবে গরিব মানুষের একটু স্বস্তি দিতে পারে, প্রান্তিক মানুষের দুঃখের সময় পাশে গিয়ে একটু দাঁড়াতে পারে। যারা নির্যাতিত হয়েছে, ক্ষোভ সঞ্চার হয়েছে বহুদিন ধরে, তারা যেটাকে লিবারেল করতে পারে না সেই ধরনের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর পাশে পুলিশ সহায়ক শক্তি হিসেবে দাঁড়াক এটা তো আমি মনেপ্রাণে চেয়েছি এবং সর্বাত্মক চেষ্টা করেছি বাস্তবতার প্রতিফলন করতে। কিন্তু পুলিশকে যেভাবে গঠিত হয়েছে এর কাঠামো হলো ঔপনিবেশিক কাঠামো। যেটা সাধারণ গরিব মানুষকে সেবা দেওয়ার জন্য ব্রিটিশরা তৈরি করেনি। তারা শাসন ও শোষণ করার জন্য তৈরি করেছে। এবং সেই কাঠামোটি আমরা অবলীলাক্রমে স্বাধীন দেশে চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছি। এটি একটা মিস ম্যাসেজ। এটা খাপ খায় না। এ জন্যই পুলিশের কাছে যে সেবাটি পাওয়ার কথা আমাদের সেই সেবাটি এই কাঠামোগত অবস্থানের কারণে সেটা সম্ভব হয় না। পুলিশকে দোষারোপ করে হয়তো তৃপ্তি পাওয়া যেতে পারে কিন্তু পুলিশ নিজেরা এই পরিবর্তন কখনোই আনতে পারবে না যতক্ষণ পর্যন্ত সমাজ ও রাষ্ট্র তাদের মতো করে পুলিশ না করবে।

আপনার বিদায় বেলায় পুলিশের জন্য কী উপদেশ থাকছে?

মোখলেসুর রহমান : আমি উপদেশ একেবারেই কাউকে দিতে চাই না। তারা এমন একটি পদ্ধতির মধ্যে এসে এখানে কাজ করে এই পদ্ধতিগত ত্রুটি বা ধুলোবালু লেগে থাকার কারণে অনেক ভালো পুলিশও যথাযথ তার দায়িত্বটা পালন করতে সক্ষম হয় না।

ফেনীর নুসরাত হত্যাকান্ডে পুলিশসহ প্রশাসনের গাফিলতির অভিযোগ উঠেছে। এ ব্যাপারে আপনার মতামত কী?

মোখলেসুর রহমান : শুনুন, সোনাগাজীতে যে ঘটনা ঘটেছে তা মর্মান্তিক এবং নারীর প্রতি সহিংসতার একটি চূড়ান্ত দৃষ্টান্ত বলে মনে করি। এটা পুরুষশাসিত সমাজ ব্যবস্থার দগদগে একটি ঘা। এখানে পুলিশ বলুন বা অন্য কেউ বলুন একটা পুরুষশাসিত সমাজ ব্যবস্থার প্রতিফলন বলে মনে করি। ভিকটিম পরিবারটি যে শুধু পুলিশের কাছে এসেছে তা কিন্তু নয়। এর আগে আরও শক্তিশালী কর্নারে কিন্তু তারা গেছে বিচারের জন্য। সেখানে কিন্তু একেবারে তাদের কথা শুনা হয়নি। শেষে এসেছে পুুলিশের কাছে। পুলিশ যেভাবে তাদের সময় দেওয়া অথবা তাদের কথা যেভাবে শোনা উচিত ছিল সেটা পুলিশ শুনেনি। ফলে জনমনে যেটা বললাম আমাদের নিয়ে যে প্রশ্নগুলো থাকে তা তৈরি হয়ে আছে। তার জন্য আমাদের জবাবদিহি করতে হচ্ছে এবং ভুল কাজের জন্য যে পুলিশ কর্মকর্তা এ কাজটি করেছে তার খেসারত দিতে হচ্ছে। এ কারণে তাকে শাস্তির আওতায় আসতে হবে।

‘পুলিশ জনগণের বন্ধু’ এই স্লোগান কতটুকু সত্য বলে আপনি মনে করেন?

মোখলেসুর রহমান : এটি পুুলিশের অন্যতম কাজ। জনগণের সঙ্গে যদি পুলিশের সুসম্পর্ক না থাকে, তাহলে পুলিশ তার সেবাটা দেবে কোথায়? মানুষ যদি পুলিশের কাছে আসতেই না পারে এবং বন্ধুর সম্পর্কই যদি না থাকে, তাহলে পুলিশের পক্ষে কাজ করাই তো সম্ভব নয়।

জঙ্গি নির্মূলে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে উঠছে না কেন?

মোখলেসুর রহমান : সামাজিকভাবে প্রতিরোধ হচ্ছে না এটা তো একেবারে বলা যাবে না। কারণ প্রথম দিকে যখন জঙ্গিরা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে তখন শুধু পুলিশকেই তাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হয়েছে। যখন তাদের এই সহিংসতা, হিংসাত্মক কর্মকাণ্ড মানুষের ভেতর ভয়ের সঞ্চার করেছে এবং মানুষ যখন নিজেকে অনিরাপদ ভাবতে শুরু করেছে, নাগরিক সমাজ যখন তাদের নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত হতে শুরু করেছে তখনই সাধারণ মানুষ এগিয়ে এসেছে। আমাদের শিক্ষকরা এগিয়ে এসেছেন, বুদ্ধিজীবীরা এগিয়ে এসেছেন, আমাদের মওলানা ও ইসলামি চিন্তাবিদ যারা আছেন, তাদের বেশির ভাগই সামাজিক প্রতিরোধে এগিয়ে এসেছেন। সাধারণ মানুষও জঙ্গিদের পছন্দ করছে না। সরকারের পক্ষ থেকে জঙ্গিবাদবিরোধী জনমতকে কাঠামোগত রূপ দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে। মসজিদ-মাদ্রাসায় জঙ্গিদের বিরুদ্ধে কথা বলা হচ্ছে। সামাজিক প্রতিরোধ যদি না হতো, তাহলে জঙ্গি তৎপরতা গ্রামে গ্রামে ছড়িয়ে পড়ত, শহরেও ছড়িয়ে পড়ত। জঙ্গিদের কঠোর নিয়ন্ত্রণের মধ্যে নিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছি। সাধারণ মানুষ খবর দিচ্ছে বা সতর্ক আছে বলেই জঙ্গি নির্মূল করা সহজতর হয়ে গেছে।

ঙ্গিদের অনেকেই সামরিক কায়দা বা যুদ্ধের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। পুলিশের বর্তমান প্রশিক্ষণ জঙ্গিদের মোকাবেলায় যথেষ্ট কি?

মোখলেসুর রহমান : এটা তো চলমান বাস্তবতা পর্যবেক্ষণ করলেই হয়। হলি আর্টিজানের ঘটনায় কিংবা শোলাকিয়া ঈদগাহে আক্রমণ করতে যাওয়ার পর আমরা যেভাবে রুখে দাঁড়িয়েছি, বাংলাদেশ পুলিশ তার সীমিত সাধ্যের মধ্যে, সীমিত জনবল কিংবা সীমিত সরঞ্জাম নিয়ে যেভাবে জঙ্গিদের মোকাবিলা করছে, তাতে সারা বিশ্বে প্রশংসিত ও দৃষ্টান্ত হয়ে উঠেছে বাংলাদেশ। জঙ্গি নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে অনেক উন্নত দেশ এখন বাংলাদেশের পুলিশের কাছে কৌশল জানতে চাচ্ছে।

খুন, ধর্ষণের মতো অপরাধও বেড়ে যাচ্ছে। এর কারণ কী? এখানেও কি সমাজের কিছু করার আছে?

মোখলেসুর রহমান : এসব ঘটনা প্রতিরোধে সমাজের ভূমিকাই তো আগে হওয়ার কথা। পুলিশের কাজ তো শুধু অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করা বা অপরাধ হলে অপরাধীদের ধরে বিচারের সম্মুখীন করা। ধর্ষণ একটি গুরুতর অপরাধ। নারীদের প্রতি সমাজ বা আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি কেমন, ধর্ষণের ঘটনার পেছনে তা-ও বড় ভূমিকা পালন করে। আমাদের দেশে নারী নির্যাতন, যৌতুক ও ইভটিজিং আছে। জঙ্গিবাদ যেমন জনরোষের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়, তেমনি নারীদের প্রতি সহিংসতা ও নির্যাতনও সামাজিক প্রতিরোধের মাধ্যমে অনেকটাই নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। এখানে মিডিয়ারও একটি বড় ভূমিকা আছে। তাদেরও সচেতনতা সৃষ্টির ক্ষেত্রে আরও বেশি করে এগিয়ে আসতে হবে।

পুলিশকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহারের অভিযোগও দীর্ঘদিনের। বিষয়টি কীভাবে দেখেন?

মোখলেসুর রহমান : এটি খুবই মুখরোচক কথা যে পুলিশকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করা হয়। পুলিশ আইন রক্ষায় কাজ করতে গেলে কারও কারও কাছে মনে হতে পারে, তারা রাজনৈতিক কাজে সম্পৃক্ত হয়ে গেছে। আজ রাস্তায় যদি একটি মিছিল বের হয়, আর সেই মিছিল থেকে যদি কেউ জানমালের ক্ষতি করার চেষ্টা করে আর সেই মিছিলের ওপর যদি আমি লাঠিচার্জ করি এবং সেটি ছত্রভঙ্গ করি, আপনার কাছে মনে হতে পারে পুলিশ রাজনৈতিক কারণে এটা করতে দেয়নি। এভাবেই কথাটা আসে। পুলিশ স্বাধীনভাবেই কাজ করছে।

 

সূত্র: দেশ রূপান্তর

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button