কালীগঞ্জে ‘অ্যানেস্থেসিয়া’ চিকিৎসক দিয়ে সিজারিয়ান, প্রসূতির মৃত্যু: ছাড়পত্রে জালিয়াতি!  

নিজস্ব সংবাদদাতা : লাইসেন্সের মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার পরও নির্বিঘ্নে চিকিৎসা সেবা দিয়ে যাচ্ছে কালীগঞ্জ জনসেবা জেনারেল হাসপাতাল এন্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টার। আর‌ একের পর এক ঘটছে মৃত্যুর ঘটনা। এবার অ্যানেস্থেসিয়া চিকিৎসক দিয়ে সিজারিয়ান অপারেশনের পর এক প্রসূতির মৃত্যু হয়েছে। পরবর্তীতে জালিয়াতির মাধ্যমে রোগীকে দেয়া হয়েছে সার্জারি চিকিৎসকের নাম সম্বলিত ছাড়পত্র।

রোববার (২১ আগষ্ট) সন্ধ্যায় ওই প্রসূতির মৃত্যু‌ হয়।

নিতহ প্রসূতির নাম শিরিন বেগম (৩০)। তিনি তুমুলিয়া ইউনিয়নের দক্ষিণ চুয়াড়িয়াখোলা গ্রামেরআব্দুল রাজ্জাকের স্ত্রী।

কালীগঞ্জ জনসেবা জেনারেল হাসপাতাল এন্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টার পৌর এলাকার বড়নগর রোডে অবস্থিত।

এর আগে ২০২০ সালের ১০ এপ্রিল কালীগঞ্জ জনসেবা জেনারেল হাসপাতাল এন্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টারে ভূল চিকিৎসায় বেতুয়া এলাকার মিশু বেগম নামে এক প্রসূতির মৃত্যু হয়েছিল। সে সময় এক লাখ টাকায় ওই ঘটনা সমোঝতা করেছিল। এরপূর্বে একই হাসপাতালে ভূল চিকিৎসায় ভাদগাতী এলাকার এক নবজাতক শিশুর মৃত্যু হয়েছিল।

নিহত শিরিন বেগমের পরিবার ও হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, প্রসূতি শিরিন বেগমকে রোববার সকাল সাড়ে ৮টার দিকে জনসেবা হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।‌ পরে শিরিন বেগমের শারীরিক পরীক্ষা করে বেলা সাড়ে ১১টার দিকে সিজারিয়ান করার জন্য অপারেশন থিয়েটারে প্রবেশ করানো হয়। দীর্ঘসময় সিজারিয়ানের ‌মাধ্যমে সফলভাবে সন্তান প্রসব করে শিরিন বেগম। সে সময় সন্তান ও মা দু’জনেই সুস্থ ছিল। পরে তার ভাই ফরহাদের দেয়া এক ব্যাগ এবি পজেটিভ রক্ত শিরিন বেগমের দেহে প্রবেশ করানো হয়। এরপর বিকেলে হাসপাতালের নার্স শামিমা আরো এক ব্যাগ রক্ত শিরিন বেগমের দেহে পূশ করে। এর ৪-৫ মিনিটের মধ্যে শিরিন বেগমের শারীরিক অবস্থার অবনতি হয়। সে সময় রক্তের ব্যাগ চেক করে দেখা যায় রক্তের গ্রুপ বি পজেটিভ। বিষয়টি নজরে আসার পর নার্সকে রক্ত পূশ করা বন্ধ করতে বলা হলে তিনি তা খুলে লুকিয়ে ফেলেন। এরপর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের লোকজন জানায় এ হাসপাতালে শিরিন বেগমের আর কোন চিকিৎসা করা সম্ভব হবে না। তাকে ঢাকায় নিয়ে যেতে হবে। সে সময় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ অ্যাম্বুলেন্স এনে একপ্রকার জোর করে শিরিন বেগমে ঢাকায় নিয়ে যেতে বাধ্য করা হয়। পরে ঢাকায় নিয়ে যাওয়ার পথে শিরিন বেগমের মৃত্যু হয়। হাসপাতাল থেকে শিরিন বেগমকে দেয়া ছাড়পত্রে চিকিৎসকের নাম উল্লেখ করা হয়েছে সার্জন নূপুর এবং অ্যানেস্থেসিয়া মাসুদ। কিন্তু সিজারিয়ানের সময় মাসুদ থাকলেও নূপুর নামে কোন চিকিৎসক ছিলেন না।

জানা গেছে, কোন‌ অ্যানেস্থেসিয়া চিকিৎসক দিয়ে অপারেশন করার নিয়ম নেই। অ্যানেস্থেসিয়া চিকিৎসকের কাজ হচ্ছে রোগীকে অপারেশনের পূর্বে অজ্ঞান করা। কিন্তু কোন সার্জন চিকিৎসক ছাড়াই কালীগঞ্জের বিভিন্ন হাসপাতালে অ্যানেস্থেসিয়া চিকিৎসক দিয়েই প্রতিনিয়ত চলছে সিজারিয়ান অপারেশন।

gazipurkontho

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কালীগঞ্জ জনসেবা জেনারেল হাসপাতাল এন্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টার‌ে কর্মরত একাধিক জন জানায়, অ্যানেস্থেসিয়া চিকিৎসক মাসুদ নরসিংদীতে একটি হাসপাতালে চাকরি করেন। এছাড়াও কালীগঞ্জের বিভিন্ন প্রাইভেট হাসপাতালে তিনি নিয়মিত অপারেশন করে থাকেন। নূপুর হলো তার স্ত্রী। তিনি নরসিংদী সরকারি হাসপাতালের সার্জারি চিকিৎসক। পুরো নাম শামীমা জাহান নূপুর। মাসুদ যে সকল সিজারিয়ান করে সেসব নথিপত্রে জালিয়াতির মাধ্যমে সার্জন চিকিৎসক হিসেবে নূপুর নাম‌ ব্যবহার করে থাকে।

নিহতের স্বামী আব্দুল রাজ্জাক অভিযোগ করে বলেন, আমার‌ স্ত্রীর সিজারিয়ান‌ করেছে মাসুদ নামে এক চিকিৎসক। পরে নার্স শামিমা হাসপাতাল থেকে বি পজেটিভ রক্ত পূশ করে। কিন্তু আমার স্ত্রীর রক্তের গ্রুপ এবি পজেটিভ। ডোনার উপস্থিত থাকার পরও ইচ্ছে করেই সে এ কাজ করেছে। সে সময় এ বিষয়ে জানতে চাইলে নার্স রক্তের ব্যাগ খুলে নিয়ে লুকিয়ে ফেলে। এরপর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানায় শিরিনের জরায়ুতে সমস্যা আছে। তাই ঢাকায় নিয়ে যেতে হবে। পরে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ একটি অ্যাম্বুলেন্স এনে জোরপূর্বক ঢাকায় নিয়ে যেতে বাধ্য করে। পথে তার‌ মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু ধারণা করা হচ্ছে মৃত‌ অবস্থাতেই আমার‌ স্ত্রীকে অ্যাম্বুলেন্সে উঠানো হয়েছিল।

নার্স শামিমা বলেন, প্রসূতি ওই রোগীকে কোন রক্ত পূশ করা হয়নি। তার জরায়ুতে সমস্যা ছিল। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হলে তাকে ঢাকায় পাঠানো হয়। নূপুর নামে কোন‌ চিকিৎসক আমাদের হাসপাতালে নেই। ওই প্রসূতির সিজারিয়ান করেছে ডাক্তার মাসুদ।

অভিযুক্ত অ্যানেস্থেসিয়া চিকিৎসক মাসুদ এবং কালীগঞ্জ জনসেবা জেনারেল হাসপাতাল এন্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টারের পরিচালক ডা. আসাদুজ্জামানের‌ মোবাইল নাম্বারে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তারা কল রিসিভ করেনি।

কালীগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডাঃ এস এম মনজুর-এ-এলাহী বলেন, প্রসূতি মৃত্যুর বিষয়টি বিভিন্ন সূত্রে জানতে পেরেছি। তবে এখানো পর্যন্ত কেউ কোন অভিযোগ করেনি। জনসেবা জেনারেল হাসপাতাল এন্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টারের লাইসেন্সের মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়ে গেছে।

তিনি আরো বলেন, অ্যানেস্থেসিয়া চিকিৎসক দিয়ে অপারেশন করার কোন নিয়ম নেই। সার্জারি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ব্যতীত কোন ধরনের অপারেশন করার সুযোগ নেই। সার্বিক বিষয়ে তদন্ত করে ওই হাসপাতালে বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।

 

আরো জানতে……..

কালীগঞ্জে ভুল চিকিৎসায় প্রসূতির মৃত্যু, লাখ টাকায় রফাদফা!

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button