কালীগঞ্জে প্রসূতির মৃত্যু: হাসপাতালের পরিচালক বন্যাসহ ৬ জনকে গ্রেপ্তার করেছে র‌্যাব

গাজীপুর কণ্ঠ ডেস্ক : কালীগঞ্জ জনসেবা জেনারেল হাসপাতাল অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টারে শিরিন বেগম (৩০) নামের এক প্রসূতির মৃত্যুর ঘটনায় হাসপাতালের পরিচালক বন্যা আক্তার ও তার ছয় সহযোগীকে গ্রেপ্তার করেছে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব)। ওই হাসপাতালের (অ্যানেস্থেসিয়া) চিকিৎসক মাসুদ গাইনোকোলোজিস্ট না হয়েও রোগীর সিজার করতেন। এছাড়া হাসপাতাল ও ডায়গনস্টিক সেন্টারের লাইসেন্সের মেয়াদ গত বছরের ৩০ জুন শেষ হয়েছে। ট্রেড লাইসেন্সের মেয়াদ চলতি বছরের ৩০ জুন শেষ হলেও তারা আর নবায়ন করেনি। ফায়ার সার্ভিসের লাইসেন্স ও শিল্প প্রতিষ্ঠান লাইসেন্সসহ পরিবেশগত কোনো ছাড়পত্রও ছিল না তাদের।

বুধবার (২৪ আগস্ট) দুপুরে রাজধানীর কারওয়ান বাজার র‌্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা জানান র‌্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।

গ্রেপ্তার আসামিরা হলো, হাসপাতালের অন্যতম অংশীদার ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক কালীগঞ্জের বালীগাঁও এলাকার ওসমান গণির স্ত্রী বন্যা আক্তার (৩১), হাসপাতালে ওটি বয় টাঙ্গাইলের দেলদুয়ার থানার চাঁন মিয়ার ছেলে আশিকুর রহমান (২৫), সিনিয়র নার্স কালীগঞ্জের অরুন কস্তার মেয়ে সংগিতা তেরেজা কস্তা (৩৩), জুনিয়র নার্স ক্লেমেন্ট ক্রশের স্ত্রী মেরী গমেজ (৪০), নার্স রুপগঞ্জের শরীফ মিয়ার স্ত্রী সীমা আক্তার (৩৪) এবং রিসেপশনিস্ট কালীগঞ্জের ইয়াসিন সুমনের স্ত্রী শামীমা আক্তারকে (৩২) গ্রেপ্তার করা হয়। এসময় আসামিদের কাছ থেকে চিকিৎসা সংক্রান্ত ও হাসপাতাল পরিচালনার মেয়াদউত্তীর্ণ নথিপত্র উদ্ধার করা হয়।

ঘটনার বিবরণে র‌্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক জানান, গত ২১ আগস্ট সকালে কালীগঞ্জের দক্ষিণ চুয়াড়িয়াখোলা এলাকার বাসিন্দা শিরিন বেগমের  প্রসব বেদনা উঠলে পূর্ব পরিচিত জনসেবা জেনারেল হাসপাতাল অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বন্যা আক্তারের মাধ্যমে ওই হাসপাতালে সিজারিয়ান অপারেশনের জন্য ভর্তি হয়। পরে ওটি বয় আশিকের তত্ত্বাবধানে রোগীর প্রাথমিক চিকিৎসা ও আল্টাসনোগ্রাম করে সিজারের জন্য রোগীকে ওটিতে নেওয়া হয়। চিকিৎসক মাসুদ গাইনোকোলোজিস্ট না হয়েও রোগীর সিজার করেন। অপারেশন শেষে ব্লিডিং হওয়ায় চিকিৎসক মাসুদের পরামর্শে আশিক ও বন্যা রোগীর পরিবারকে ‘এবি’ পজিটিভ রক্ত সংগ্রহের কথা বলেন। ভিকটিমের ভাই ও ননদের ছেলের ‘এবি’ পজিটিভ গ্রুপের রক্ত হওয়ায় তাদের কাছে রক্ত সংগ্রহ করার ব্যবস্থা হয়। প্রথমে ভিকটিমের ভাইয়ের শরীর থেকে এক ব্যাগ রক্ত নিয়ে রোগীর শরীরে পুশ করা হয়। আরও এক ব্যাগ রক্ত নিতে ননদের ছেলেকে বেডে শোয়ানো হয়। এরমধ্যেই হাসপাতালের কর্তব্যরত নার্সরা ভিকটিমের শরীরে ‘বি’ পজিটিভ গ্রুপের রক্ত পুশ করেন। ভিকটিমের ‘এবি’ পজিটিভ গ্রুপের রক্তের পরিবর্তে ‘বি’ পজিটিভ রক্ত পুশ করায় রোগীর খিঁচুনি ওঠে। এ সময় বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক না থাকায় আশিকের তত্ত্বাবধানে রোগীর চিকিৎসা চলতে থাকে। এক পর্যায়ে রোগীর শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে সন্ধ্যার দিকে তাকে ঢাকায় পাঠানোর পরামর্শ দেওয়া হয়। ভিকটিমের পরিবার রোগীকে নিয়ে অ্যাম্বুলেন্সে ঢাকায় আসার পথে অবস্থার আরও অবনতি হওয়ায় উত্তরার একটি হাসপাতালে নিয়ে যান। সে সময় কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

গ্রেপ্তারদের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের ভিত্তিতে র‌্যাব জানায়, জনসেবা জেনারেল হাসপাতাল এন্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টারে নিয়মিত কোন ডাক্তার ছিলো না। মেয়াদোত্তীর্ণ কাগজে চিকিৎসা সেবা চালিয়ে যাচ্ছিল হাসপাতালটি। হাসপাতালটিতে গড়ে প্রতি মাসে ২৫ থেকে ৩০টি সিজারিয়ান অপারেশনসহ প্রায় ৫০টির অধিক বিভিন্ন অপারেশন সম্পন্ন করা হতো বলে গ্রেপ্তার আসামিরা জানায়। এক্ষেত্রে হাসপাতালে কোন রোগী আসলে অন কলে থাকা বিভিন্ন ডাক্তারদেরকে ডাকতেন। সিজারিয়ান অপারেশনের ক্ষেত্রে একজন গাইনোকোলজিষ্টের ওটি চার্জ ছিলো তিন হাজার টাকা এবং অ্যানেস্থেসিয়ার দেড় হাজার টাকা। সর্বমোট সাড়ে চার হাজার টাকা ডাক্তারদের দিত হাসপাতাল কৃর্তৃপক্ষ। আর রোগী ভেদে বিভিন্ন প্যাকেজে ১০-১৫ হাজার টাকা নেয়া হতো। হাসপাতালে কর্মরত সকল নার্স এবং স্টাফদের প্রতিমাসে গড় মোট বেতন ছিলো এক লাখ ৫০ হাজার টাকা। এছাড়াও হাসপাতালটিতে অন্যান্য কিছু টেস্ট করা হতো যেমন-আল্ট্রাসনোগ্রাম, রক্তের (সিবিসি) টেস্ট ইত্যাদি।

gazipurkontho
নিহত প্রসূতির শিরিন বেগম।

গ্রেপ্তার বন্যা আক্তার ডিগ্রি পাস। তিনি হাসপাতালের অন্যতম অংশীদার ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক। তার কোন নার্সিং ডিগ্রী নেই। তবে সে স্থানীয় একটি হাসপাতালে ৭ বছর নার্সিং ও ২.৫ বছর ম্যানেজার হিসেবে কাজ করেছিল। পরবর্তীতে সে ২০১৮ সালে ০৮ জনের যৌথ মালিকানায় “জনসেবা জেনারেল হাসপাতাল এন্ড ডায়গনস্টিক সেন্টার” চালু করে।

গ্রেপ্তার আশিকুর রহমান এসএসসি পাস করে ২০১৬ সালে টাঙ্গাইল ম্যাটস থেকে ৩ বছরের ডিএমএফ (ডিপ্লোমা ইন মেডিকেল ফ্যাকাল্টি) কোর্স পাস করে। পরিচয়ের সূত্রে হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার পর থেকে বিশ হাজার টাকা মাসিক বেতনে জনসেবা হাসপাতালে ওটি বয় ও ডক্টরের সহকারী হিসেবে চাকরি করে। ঘটনার দিন আশিক ডাঃ মাসুদের সহকারী হিসেবে ওটিতে উপস্থিত ছিল। ওটির পূর্বে সে রোগীর আল্ট্রাসনোগ্রাম করে। রোগীর ভর্তি ও ডিসচার্জ পেপারে নিজেই স্বাক্ষর করে। তবে সেখানের নার্স ও ভিকটিম পরিবার তাকে ডাক্তার হিসেবে জানত। রোগী তদারকি, ডাক্তারদের সাথে সার্বক্ষণিক সমন্বয় রাখা, বিভিন্ন ধরণের টেস্ট করা ও ডাক্তারদের পক্ষে কাগজপত্রে ভুয়া স্বাক্ষর করার সাথে জড়িত ছিল সে।

gazipurkontho

গ্রেপ্তার সংগিতা তেরেজা কস্তা এসএসসি পাশ করে ডায়াগনেস্টিক সেন্টারে একজন সিনিয়র নার্স হিসেবে কর্মরত। সে ৩ বছর মেয়াদী জুনিয়র নার্সিং কোর্স পাশ করে পনের হাজার টাকা বেতনে ৭ মাস ধরে চাকরি করেছে।

গ্রেপ্তার মেরী গমেজ এসএসসি পাশ করে একজন জুনিয়র নার্স হিসেবে কর্মরত ছিলো। সে ২ বছর মেয়াদী জুনিয়র নার্সিং কোর্স পাস করে সাত হাজার টাকা বেতনে ২ বছর ধরে চাকরি করছে।

গ্রেপ্তার সীমা আক্তার ওএসএসসি পাশ করে ডায়াগনেস্টিক সেন্টারে নার্স হিসেবে কর্মরত ছিল। তার কোন নাসিং কোর্স বা ডিপ্লোমা ডিগ্রী নেই। সে ছয় টাকা বেতনে ৪ বছর ধরে চাকরি করছে।

এছাড়াও গ্রেপ্তার শামীমা আক্তার এসএসসি পাশ করে  রিসেপশনিস্ট এবং রোগী দেখার সিরিয়াল দেয়ার কাজ করতেন। তার কোন নার্স কোর্স বা ডিপ্লোমা নেই। সে সাত হাজার পাঁচশত টাকা বেতনে ২ সপ্তাহ ধরে চাকরি করছে।

 

আরো জানতে……..

কালীগঞ্জে ‘অ্যানেস্থেসিয়া’ চিকিৎসক দিয়ে সিজারিয়ান, প্রসূতির মৃত্যু: ৬ জন গ্রেপ্তার

কালীগঞ্জে ‘অ্যানেস্থেসিয়া’ চিকিৎসক দিয়ে সিজারিয়ান, প্রসূতির মৃত্যু: ছাড়পত্রে জালিয়াতি!

কালীগঞ্জে ভুল চিকিৎসায় প্রসূতির মৃত্যু, লাখ টাকায় রফাদফা!

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button