আবারো জঙ্গি টার্গেটে বাংলাদেশ?
গাজীপুর কণ্ঠ ডেস্ক : শ্রীলঙ্কার পর বাংলাদেশ কি আবারো জঙ্গিদের টার্গেটে পরিণত হচ্ছে। সম্প্রতি যেসব তথ্য পাওয়া যাচ্ছে তাতে এই আশঙ্কাকে একেবারে উড়িয়ে দেয়ার সুযোগ নেই। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীও আগের চেয়ে সতর্ক অবস্থানে রয়েছে। বেড়েছে গোয়েন্দা তৎপরতা।
গত সোমবার রাতে ঢাকার গুলিস্তানে পুলিশের ওপর হামলা হয়। ওই হামলায় তিন পুলিশ সদস্য গুরুতর আহত হন। প্রথমে এটাকে সাধারণ ককটেল হামলা মনে করা হলেও পরদিন ঢাকা মহানগর পুলিশ প্রধান আছাদুজ্জামান মিয়া হামলায় ব্যবহৃত বোমাগুলো শক্তিশালী বলে উল্লেখ করেন। হামলায় ইমপ্রোভাইজড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস (আইডি) ব্যবহার করা হয়েছে। আর হামলার পর মধ্যরাতে তথাকথিত আন্তর্জাতিক জঙ্গি গোষ্ঠী আইএস এর দায় স্বীকার করে। তাদের ‘আমাক ওয়বেসাইট’-এ দায় স্বীকার করে একটি বার্তা প্রচার করা হয়৷তবে আছাদুজ্জামান মিয়া বলেছেন, ‘‘এই হামলায় আইএস জড়িত কিনা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।”
এদিকে জঙ্গিদের মুখপত্র ‘আত-তামকীন’-এ মঙ্গলবার রাতে একটি বার্তা প্রচার করা হয়েছে। ওই বার্তায় বাংলাদশ ও ভারতের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর প্রতিশোধ নেয়ার হুমকি দেয়া হয়েছে। বার্তাটি বাংলা, ইংরেজি ও হিন্দি ভাষায় প্রকাশ করা হয়। বার্তার সাথে ২০১৬ সালে ঢাকার গুলশান হোলি আর্টিজানে হামলাকারী ৫ জঙ্গির ছবিও ব্যবহার করা হয়েছে।
বার্তাটি আবু মুহাম্মাদ আল বাঙালির নামে প্রচার করা হয়েছে। ওই ব্যক্তিই আইএস-এর বাংলাদেশ প্রধান হিসেবে মনোনীত হয়েছেন বলে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর বরাত দিয়ে এর আগে সংবাদ মাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়। তার নামে গত ১২ মার্চও ‘আত তামকিন’-এর একটি সংখ্যায় কিছু নির্দেশনা প্রকাশ করা হয়েছিল। গত বছরের অক্টোবরে নরসিংদীতে একটি অভিযান পরিচালনার সময় আবু মুহাম্মাদ আল বাঙালির নামটি প্রথম জানতে পারে ঢাকার কাউন্টার টেররিজম ইউনিট।
এদিকে জঙ্গিদের বাংলায় নতুন একটা পেস্টারের কথাও এখন আলোচিত হচ্ছে। ওই পোস্টারের সূত্র ধরে আইএস বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গে হামলা চালানোর পরিকল্পনা করছে বলে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম টাইমস অব ইন্ডিয়ার এক প্রতিবেদনে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে। তারা জানিয়েছে, আইএসপন্থি একটি টেলিগ্রাম চ্যানেলে প্রকাশিত পোস্টারে ‘শিগগির আসছি ইনশাল্লাহ’ লেখার পাশাপাশি আল মুসারাত নামে একটি গ্রুপের লোগো সংযুক্ত রয়েছে। এটিকে পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশে হামলার ইঙ্গিত বলে ধারণা করা হচ্ছে। প্রতিবেদনে অবশ্য ওই পোস্টারের কোনো ছবি যুক্ত করা হয়নি।
জঙ্গিদের আরেকটি প্রকাশনায় বাংলাদেশ ও ভারতে তাদের ‘লোন উলফ’ হামলার পরিকল্পনার কথা জানা গেছে। জঙ্গিদের প্রপাগান্ডা চ্যানেল বালাকোট মিডিয়া থেকে প্রকাশিত বাংলা ভাষায় লেখা একটি ম্যাগাজিনে এই হামলার হামলার কলা-কৌশল ও কাদের টার্গেট করা হতে পারে তা নিয়ে বলা হয়েছে। সেখানে বাংলাদেশ ও ভারতের বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান ছাড়াও একটি আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমকে হামলার টার্গেট হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
প্রায় ৩ বছর আগে ঢাকার গুলশানের হোলি আর্টিজানে হামলার পর তার দায় স্বীকার করে বার্তা প্রকাশ করেছিল আইএস। ২০১৬ সালের ১ জুলাই ওই হামলায় ২০ জন দেশি-বিদেশি নাগরিক নিহত হয়। অভিযান চালাতে গিয়ে নিহত হন পুলিশের দুই কর্মকর্তা। পরের দিন ভোরে সেনা কমান্ডোদের অভিযানে বাকি জিম্মিদের উদ্ধার করা হয়। অভিযানে হামলায় জড়িত পাঁচ জঙ্গি এবং ওই রোস্তোরার কর্মী সাইফুল ইসলাম চৌকিদার নিহত হয়।
হোলি আর্টিজানের পর বাংলাদেশে ব্যাপক জঙ্গিবিরোধী অভিযান পরিচালিত হয়। বেশ কিছু জঙ্গি আস্তানা গুড়িয়ে দেয়া হয়। নিহত হয় অনেক শীর্ষ জঙ্গি। কিন্তু তাদের নেতা সামরিক বাহিনী থেকে বরখাস্ত মেজর জিয়া এখনো বাইরে আছেন।
নিরাপত্তা বিশ্লেষক এয়ার কমোডর (অব.) ইশফাক ইলাহী চৌধুরী বলেন, ‘‘বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো বাংলাদেশেও জঙ্গি হামলার আশঙ্কা আছে। বাংলাদেশ তাদের নিশানার বাইরে নয়। হোলি আর্টিজানের পর ব্যাপক অভিযান চললেও দেশে জঙ্গি রিক্রুট বন্ধ হয়নি। হোমগ্রোন টেররিস্ট থেকেই যাবে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও রিক্রুটমেন্ট হচ্ছে। বাংলাদেশের আর্থ সামাজিক অবস্থা জঙ্গিবাদ ছড়ানোর সহায়ক হিসেবেই আছে। তাই বাংলাদেশ কোনোভাবেই আশঙ্কামুক্ত নয়।”
তিনি বলেন, ‘‘সিরিয়ায় আইএস-এর পতনের ফলে জঙ্গিরা নতুন হামালার পরিকল্পনা করছে। তারা তাদের শক্ত অবস্থানের জানান দিতে চায়। শ্রীলঙ্কায় হামলা তারই প্রকাশ। তাদের খলিফা বাগদাদী তো আগেই বলে দিয়েছে, কারুর সিরিয়া আসার দরকার নেই, যে যার অবস্থান, যে যার দেশ থেকে সংগ্রাম চালিয়ে যাও। আমাদের দেশেও জঙ্গিদের অনুকুল পরিবেশ আছে৷ তাই সবাইকে সর্বোচ্চ মাত্রায় সতর্ক থাকতে হবে। যে-কোনো সময় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।”
এদিকে গোয়েন্দাত্রগুলো জানায়, শ্রীলঙ্কায় হামলার পর বাংলাদেশের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী নানাভাবে সতর্ক অবস্থানে রয়েছে। বিশেষ করে কিছু ব্যক্তি ও স্থাপনার নিরাপত্তায় তারা বিশেষ ব্যবস্থা নিয়েছে। যেসব ব্যক্তি আশঙ্কার মধ্যে আছেন, তাঁদের সঙ্গে কথাও বলেছেন তাঁরা। আর সার্বিকভাবে ‘থ্রেট অ্যাসেস’ করে ঝুঁকির জায়গাগুলো নিবিড়ভাবে চিহ্নিত করা হচ্ছে। সক্রিয় জঙ্গিদের আরো নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে।
সর্বশেষ জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররম-এর মার্কেট এবং আশপাশে বোমা হামলার হুমকি দেয়া হয়েছে চিঠি পাঠিয়ে। জেএমবি’র পরিচয়ে ওই চিঠি দেয়া হয়। চিঠিতে মসজিদ মার্কেট ও আশপাশের হোটেলে অনৈসলামিক কাজের কথা বলা হয়েছে। ইসলামিক ফাউন্ডেশন ওই চিঠি পাওয়ার পর পুলিশকে জানিয়েছে। পুলিশ ওই এলাকার নিরাপত্তা জোরদার করেছে৷ তল্লাশি বাড়িয়ে দিয়েছে।
ঢাকা মহানগর পুলিশের উপ কমিশনার (মিডিয়া) মাসুদুর রহমান বলেন, ‘‘হোলি আর্টিজান হামলার পর আমরা আমাদের অভিযান ও গোয়েন্দা তৎপরতার মাধ্যমে জঙ্গিদের দুর্বল করে দিতে সক্ষম হয়েছি। অনেক জঙ্গি আস্তানা গুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। তাই আমরা মনে করি, তাদের বড় কোনো হামলা চালানোর শক্তি নেই। তারপরও যারা এখনো বাইরে আছে, তারা যাতে কোনো অপতৎপরতা চালাতে না পারে সে জন্য আমরা সতর্ক আছি।”
তিনি আরো বলেন, ‘‘নিউজিল্যান্ড, শ্রীলঙ্কায় হামলার পর আমাদের এখানে জঙ্গিরা যাতে কোনো সন্ত্রাসী হামলা বা তৎপরতা না চালাতে পারে সেজন্য আমরা বিশেষভাবে তৎপর আছি। আমরা বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করছি।”
সূত্র: ডয়চে ভেলে