দক্ষিণ এশিয়ায় সিমেন্ট ব্যবসায় নেতৃত্ব দিতে চায় আদানি গ্রুপ

গাজীপুর কণ্ঠ ডেস্ক : ভারতের শীর্ষ ধনী গৌতম আদানির মালিকানাধীন আদানি গ্রুপের সিমেন্ট উৎপাদন ব্যবসায় বিনিয়োগের আগ্রহ প্রথম প্রকাশ পায় গত বছর। সুইস সিমেন্ট জায়ান্ট হোলসিমের দুটি কোম্পানি অধিগ্রহণের মাধ্যমে ২০২২ সালেই দেশটির দ্বিতীয় শীর্ষ উৎপাদনকারীতে পরিণত হয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। শুধু ভারত নয়, আদানি গ্রুপ এখন নামের পাশে গোটা দক্ষিণ এশিয়ারই শীর্ষ সিমেন্ট উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের তকমা লাগাতে চাইছে। এক্ষেত্রে বিনিয়োগ গন্তব্য হিসেবে কনগ্লোমারেটটির প্রথম পছন্দ বাংলাদেশ। দেশের সিমেন্ট খাতে বড় ধরনের অধিগ্রহণকেন্দ্রিক বিনিয়োগের পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছেন গৌতম আদানি। এক্ষেত্রে তার প্রতিষ্ঠানের সম্ভাব্য বিনিয়োগের পরিমাণ ৫০ কোটি ডলার ছাড়াতে পারে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গিয়েছে।

সুইজারল্যান্ডভিত্তিক হোলসিম লিমিটেডের কাছ থেকে গত মে মাসে আম্বুজা সিমেন্টস লিমিটেড ও এসিসি লিমিটেড কিনে নেয়ার পর রাতারাতি ভারতের দ্বিতীয় বৃহত্তম সিমেন্ট উৎপাদনকারীতে পরিণত হয় আদানি গ্রুপ। প্রতিষ্ঠানটির বর্তমান সিমেন্ট উৎপাদন সক্ষমতা বার্ষিক সাত কোটি টন। অধিগ্রহণকৃত সিমেন্ট ব্যবসায় অতিরিক্ত ২০ হাজার কোটি রুপি বিনিয়োগ করা হবে বলে জানিয়েছে গ্রুপটি।

বর্তমানে ভারতে সিমেন্টের বাজার দখলে আদিত্য বিড়লা গ্রুপের সঙ্গে আদানি গ্রুপের প্রতিযোগিতা বেশ জমে উঠেছে। যদিও আদিত্য বিড়লা গ্রুপকে হঠিয়ে ভারতের বাজারে শীর্ষস্থান দখলেই থেমে থাকতে চাইছেন না গৌতম আদানি। গোটা দক্ষিণ এশিয়ার সিমেন্টের বাজার দখলকেই লক্ষ্য হিসেবে নিয়েছেন তিনি। বাংলাদেশকে ঘিরে আগে থেকেই বড় ধরনের বিনিয়োগ পরিকল্পনা করছিল আদানি গ্রুপ। এ পরিকল্পনার ব্যাপ্তি বাড়িয়ে এখন অধিগ্রহণের মাধ্যমে দেশের সিমেন্ট উৎপাদন খাতেও বড় নাম হয়ে ওঠার পরিকল্পনা করছেন গৌতম আদানি।

ভারতীয় কনগ্লোমারেটগুলোর মধ্যে এ মুহূর্তে আদানি গ্রুপেরই বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ রয়েছে। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি, ভোজ্যতেল, বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলসহ নানা খাতে বিনিয়োগ রয়েছে প্রতিষ্ঠানটির। বিদ্যমান বিনিয়োগের পাশাপাশি নতুন নতুন সম্ভাবনাও অনুসন্ধান করছে গ্রুপটি। খাদ্য, বন্দর অবকাঠামো, সিমেন্টসহ আরো নানা খাতে বিনিয়োগ সম্প্রসারণে পরিকল্পনা রয়েছে তাদের।

পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত লাফার্জহোলসিম বাংলাদেশ লিমিটেডের শেয়ার ক্রয়ে আদানি গ্রুপের আগ্রহের বিষয়টি এখন দেশের শেয়ারবাজারের অন্যতম আলোচিত বিষয়। খবরটি কোম্পানিটির শেয়ারদরেও প্রভাব ফেলেছে। যদিও এ বিষয়ে এখন পর্যন্ত কোনো আনুষ্ঠানিক ঘোষণা আসেনি। তবে সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, ভারতের অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া শেষে বাংলাদেশের সিমেন্ট খাতে আদানির বিনিয়োগের বিষয়টি প্রকাশ্যে আসতে পারে। কিংবা এর আগেও হতে পারে। লাফার্জহোলসিম ছাড়াও দেশের সিমেন্ট খাতে অন্য যেকোনো কোম্পানিকেও কিনে নিতে পারে আদানি গ্রুপ।

সিমেন্ট খাতের ব্যবসা অধিগ্রহণের বিষয়টি আদানি নিজেই দেখছেন। আম্বুজা সিমেন্ট লিমিটেডের পর্ষদে চেয়ারম্যানের দায়িত্বে রয়েছেন গৌতম আদানি নিজে। তার ছেলে করণ আদানি রয়েছেন পরিচালক হিসেবে। করণ আদানি এখন এসিসি সিমেন্ট লিমিটেডের চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োজিত রয়েছেন। বাংলাদেশে গ্রুপের ব্যবসা দেখভালের দায়িত্বে রয়েছেন গৌতম আদানির ভ্রাতুষ্পুত্র প্রণব আদানি।

বাংলাদেশের সিমেন্ট খাতের ব্যবসা নিয়ে আদানি গ্রুপের মূল আগ্রহের জায়গাটি হচ্ছে ভারতে থাকা সিমেন্টের কাঁচামালের সহজলভ্যতা। এসব কাঁচামাল ব্যবহার করে তুলনামূলক কম খরচে বাংলাদেশে তারা সিমেন্ট তৈরি করতে পারবে। এছাড়া নিজেদের চাহিদা মিটিয়ে এসব কাঁচামাল তারা দেশের কোম্পানিগুলোর কাছেও বিক্রি করতে পারবে। বাংলাদেশে উৎপাদিত সিমেন্ট ভারতে সেভেন সিস্টারস অঞ্চলে রফতানি করারও সুযোগ রয়েছে। সব মিলিয়েই বাংলাদেশে সিমেন্ট ব্যবসা আদানি গ্রুপের জন্য সম্ভাবনাময়। এক্ষেত্রে গ্রুপটি ৫০ কোটি ডলারের বেশি বিনিয়োগের পরিকল্পনা করছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে।

ভারত-বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (আইবিসিসিআই) প্রেসিডেন্ট ও নিটল মোটরস লিমিটেডের চেয়ারম্যান আবদুল মাতলুব আহমাদ বলেন, কভিডের সময়ে এবং কভিড-পরবর্তী বাংলাদেশ অন্য অনেক দেশের চেয়ে ভালো করেছে। এ সময়ে বেশকিছু কোম্পানি স্বাভাবিক সময়ের চেয়েও ভালো মুনাফা করেছে। আদানিও এমন একটি গ্রুপ। এখন তারা এ মুনাফার অর্থ বিভিন্ন দেশে বিনিয়োগ করতে চাইছে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে তারা বাংলাদেশকে বেছে নিচ্ছে। কারণ হচ্ছে বাংলাদেশ যেকোনোভাবেই হোক তাল মিলিয়ে চলতে পারছে। তাছাড়া বাংলাদেশে বিনিয়োগ করা হলে সেটি স্থানীয় বাজারে বিক্রির পাশাপাশি ভারতেও রফতানির সুযোগ রয়েছে। দেশের সিমেন্ট খাতে বর্তমানে অতিরিক্ত সক্ষমতা বিরাজ করছে। এ অবস্থায় আদানি গ্রুপ বাংলাদেশের সিমেন্ট খাতে বিনিয়োগ করলে সেক্ষেত্রে তারা ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে সহজে রফতানি করতে পারবে। বাংলাদেশে আমরা যেকোনো বিদেশী বিনিয়োগকেই স্বাগত জানাই। তবে আমাদের প্রত্যাশা হচ্ছে এক্ষেত্রে যেন স্থানীয় কোনো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে বিনিয়োগ করা হয়। এককভাবে বিদেশী বিনিয়োগ এলে শুধু কর্মসংস্থান ছাড়া আমাদের কোনো লাভ হয় না। তারা এখানে ব্যবসা করে দেশের বাইরে মুনাফা নিয়ে যায়। অন্যদিকে যৌথ উদ্যোগে বিনিয়োগ করা হলে তাদের কাছ থেকে ব্যবসার অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের মাধ্যমে নিজেদের আমরা আরো সমৃদ্ধ করতে পারব।

সম্প্রতি ঋণের ভারে জর্জরিত ভারতের জয়প্রকাশ অ্যাসোসিয়েটস তাদের সিমেন্ট ব্যবসা বিক্রি করে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। ভারতীয় সংবাদমাধ্যমের তথ্যনুসারে জয়প্রকাশের সিমেন্ট ব্যবসা কিনে নেয়ার বিষয়ে আদানি গ্রুপ অনেকটাই এগিয়ে রয়েছে। এক্ষেত্রে আদানি গ্রুপ ৫ হাজার কোটি রুপি পরিশোধ করতে রাজি আছে বলেও খবর বেরিয়েছে। অন্যদিকে সিমেন্টের বাজারে শীর্ষস্থান ধরে রাখতে আদিত্য বিড়লা গ্রুপ তাদের উৎপাদন সক্ষমতা বাড়ানোর পাশাপাশি ১২ হাজার ৮৮৬ কোটি রুপি বিনিয়োগের পরিকল্পনা করছে। সব মিলিয়ে ভারতের শীর্ষস্থানীয় সিমেন্ট উৎপাদক আদিত্য বিড়লা গ্রুপের সঙ্গে আদানি গ্রুপের বাজার দখলের প্রতিযোগিতা বেশ জমে উঠেছে।

১৯৮৮ সালে প্রতিষ্ঠিত আদানি গ্রুপের ব্যবসা ভারত ছাড়াও অস্ট্রেলিয়া, চীন, সংযুক্ত আরব আমিরাত, দুবাই, ইন্দোনেশিয়া, মিয়ানমার, সিঙ্গাপুর ও যুক্তরাষ্ট্রেও বিস্তৃত রয়েছে। গ্রুপটির কর্ণধার গৌতম আদানি ব্লুমবার্গের বিলিয়নেয়ার র্যাংকিংয়ে স্পেসএক্সের ইলোন মাস্ক, লুইস ভুইটনের বার্নার্ড আরনল্ট ও অ্যামাজনের জেফ বেজোসের পরেই বিশ্বের শীর্ষ ধনীদের তালিকায় চতুর্থ স্থানে রয়েছেন। কিছুদিন আগেও তিনি এ তালিকায় তৃতীয় স্থানে ছিলেন। বর্তমানে তার সম্পদের পরিমাণ ১২২ বিলিয়ন ডলার।

নব্বইয়ের দশকের আগে দেশে সিমেন্ট কারখানা ছিল মাত্র দুটি। সে সময় আমদানির মাধ্যমে সিমেন্টের চাহিদা মেটানো হতো। নব্বইয়ের দশকে বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তারা সিমেন্ট খাতে বিনিয়োগ করতে শুরু করেন। একে একে গড়ে উঠতে থাকে অনেক কারখানা। সরকারের অবকাঠামো খাতের মেগা প্রকল্পগুলোর চাহিদা বিবেচনায় গত এক যুগে সিমেন্ট খাতের উদ্যোক্তারা নিজেদের উৎপাদন সক্ষমতাও বাড়িয়েছেন অনেক। তবে কাঁচামালের ঊর্ধ্বমুখী দাম, জাহাজীকরণ ব্যয় ও জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি, ডলারের বিনিময় হারে উল্লম্ফনের মতো বিষয়গুলো এ খাতের ব্যবসায় বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। এ অবস্থায় সিমেন্ট খাতের অতিরিক্ত সক্ষমতা দিন দিন খাতটির জন্য বোঝা হয়ে উঠছে।

বাংলাদেশ সিমেন্ট ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিসিএমএ) তথ্য বলছে, বর্তমানে দেশে ৩৪টি সিমেন্ট কোম্পানির কার্যক্রম চলমান রয়েছে। সব মিলিয়ে এসব কোম্পানির বার্ষিক উৎপাদন সক্ষমতা সাড়ে আট কোটি টন। এর মধ্যে ব্যবহার হচ্ছে চার কোটি টন। অর্থাৎ অর্ধেকের বেশি সক্ষমতাই অব্যবহূত থাকছে। ২০০৮-২০১৮ পর্যন্ত সময়ে সিমেন্ট খাতের প্রবৃদ্ধি হয়েছে তিন গুণের মতো। মূলত সরকারের অবকাঠামো খাতের প্রকল্পগুলোকে কেন্দ্র করেই এ খাতের উদ্যোক্তারা নিজেদের সক্ষমতা বাড়িয়েছেন।

দেশের শীর্ষস্থানীয় সিমেন্ট উৎপাদকদের মধ্যে আবুল খায়ের গ্রুপের শাহ সিমেন্টের বার্ষিক উৎপাদন সক্ষমতা এক কোটি, সেভেন রিংস সিমেন্টের ৮৪ লাখ, বসুন্ধরা গ্রুপের ৫০ লাখ ৫০ হাজার, লাফার্জহোলসিম বাংলাদেশের ৪২ লাখ ও হাইডেলবার্গ সিমেন্ট বাংলাদেশ লিমিটেডের ৩৫ লাখ ১০ হাজার টন। খাতসংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, তীব্র প্রতিযোগিতামূলক দেশের সিমেন্টের বাজারে আদানি গ্রুপের মতো বড় কোম্পানি এলে স্থানীয় কোম্পানিগুলো ব্যবসায়িকভাবে আরো চাপে পড়বে। মূলত আদানি গ্রুপের সক্ষমতা অনেক বেশি হওয়ায় তারা বাজার অংশীদারত্ব হারানোর শঙ্কায় রয়েছে।

 

সূত্র: বণিক বার্তা

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button