কাতারের প্রত্যন্ত মরুভূমির তাঁবুতে থাকছেন ফুটবলপ্রেমীরা

গাজীপুর কণ্ঠ, খেলাধুলা ডেস্ক : মরুভূমির মাঝে একটি শিবিরের মতো জায়গায় থেকে বিশ্বকাপ দেখছেন কোনো কোনো ফুটবল অনুরাগী। কলকাতা থেকে মেক্সিকোর ফুটবলপ্রেমীরা রয়েছেন সেখানে। কীভাবে বালির মাঝে শিবিরে, তাঁবুতে থাকছেন তারা? সেখানকার থাকার ব্যবস্থাই বা কেমন?
যে সমস্ত ফুটবলপ্রেমীরা সেন্ট্রাল দোহায় বাজেটের মধ্যে থাকতে চেয়েছেন। তারা আল খরের একটি ধুলিময় গ্রামের তাঁবুতে থাকছেন। তবে শিবিরের আশপাশে পানের জন্য কোনো বিয়ার নেই। তাঁবুতে তালা দেয়ার ব্যবস্থাও নেই।
কেউ কেউ শুধু এমন একটা অ্যাডভেঞ্চার চেয়েছিলেন বলেই এখানে থাকছেন। দোহা থেকে এক ঘণ্টা দূরে বুধবার একজন ডিজে আগুন জ্বালিয়ে তার চারপাশ ঘিরে ইলেকট্রনিক মিউজিক বাজিয়ে মজা করছিলেন। ফুটবল ভক্তরাবিনব্যাগে বসে সোডায় চুমুক দিচ্ছিলেন। বড় স্ক্রিনে তাদের চোখ কিন্তু ম্যাচের দিকে।
কুয়েতের ২৭ বছর বয়স আর্কিটেকচারাল ইঞ্জিনিয়ার হায়দার হাজি বলেন, “আমি এখানে আছি কারণ আমি অন্য কোথাও জায়গা পাইনি।” তিনি বলেন, তাঁবুর গ্রাম অর্থাৎ এই ফ্যান ভিলেজ থেকে প্রতিদিন সকালে দোহায় যাওয়া কষ্টকর হলেও তার কাছে অন্য কোনও উপায় ছিল না। তার মনে হয়, “হোটেলগুলি খুব ব্যয়বহুল। এটা রীতিমতো পাগলামি।”
তবুও, আল খোর ফ্যান গ্রামও কিন্তু সস্তা নয়। হাজি বলেন, তিনি এইঅস্থায়ী আশ্রয়ের জন্য প্রতি রাতে ৪৫০ ডলার দিচ্ছেন তিনি। তার অভিযোগ, এই অস্থায়ী শিবিরকে কর্তৃপক্ষ “সত্যিই উপভোগ্য, বিলাসবহুল, থাকার জন্য নিখুঁত গন্তব্য” হিসাবে বিজ্ঞাপন দিয়েছে। তাঁবুগুলিতে সাধারণ আসবাবপত্র দিয়ে সাজানো। তবে সাইটটিতে একটি সুইমিং পুল এবং জাঁকজমকপূর্ণ আরবি রেস্তোরাঁ রয়েছে।
কাতার বিশ্বকাপের আয়োজক জানার পরই ছোট দেশটি কীভাবে ১২ লাখ ফুটবল ভক্তের জন্য ঘর খুঁজে পাবে তা নিয়ে আশঙ্কা তৈরি হয়েছিল। কারণ এটি কাতারের জনসংখ্যার প্রায় এক-তৃতীয়াংশের সমান।একটি প্রোগ্রামের মাধ্যমে নতুন হোটেল, ভাড়া করা অ্যাপার্টমেন্ট এবং এমনকি তিনটি বিশাল ক্রুজ জাহাজের মাধ্যমে কয়েক হাজার রুম দিতে পেরেছে কাতার।
কিন্তু দামের ঊর্ধ্বগতি অনেক ফুটবল ভক্তকেপ্রত্যন্ত মরুভূমির শিবিরে এবং দোহার বাইরে বিশাল ফ্যান ভিলেজে থাকতে বাধ্য করেছে, যার মধ্যে একটি অবশ্য বিমানবন্দরের কাছে।
আল খর গ্রামে থাকা অনেক ফুটবলপ্রেমী একলা হয়ে পড়েছেন বলে অভিযোগ এনেছেন। অনেকেই বলেছেন, কোথাও কোনো মদের সন্ধান মেলেনি।
৪২ বছর বয়সি ইরানীয় তেলকর্মী পারিসা বলেন, “সত্যি বলতে, আপনি তেহরানে আরো বেশি মদের সন্ধান পেতে পারেন।” ইরানের রাজনৈতিক পরিস্থিতির উদ্ধৃতি দিয়ে তার পদবি জানাতে অস্বীকার করেন তিনি।
তাঁবুর পাশে বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে বলছিলেন কীভাবে সময় কাটানো যাবে, সে সম্পর্কে তার ধারণা কম। দোহার বিলাসবহুল হোটেলের পানশালাগুলি অনেকটাই দূরে ছিল। তার কথায়, “আমরা ভেবেছিলাম, বিদেশিদের মজা করার এগুলি বেশি করে খোলা হবে।”
দক্ষিণ মেক্সিকোর তাবাসকোর পাওলা বার্নাল মধ্যপ্রাচ্যের প্রথম বিশ্বকাপ থেকে কী আশা করবেন তা নিশ্চিত ছিলেন না। তবে তিনি বলেন, যে বিশ্বের ক্ষুদ্রতম আয়োজক দেশ গোটাটা ঘুরতে কত সময় লাগে তা দেখে তিনি অবাক হয়েছেন। তিনি বলেন, “তাঁবুর আশপাশের এলাকায় অর্থাৎ ক্যাম্পসাইটে বাসের পরিস্থিতি বিরক্তিকর। রাত ১০টায় বাস বন্ধ হয়ে যায়। উবারে বড় অঙ্কের বিল ওঠে।”
তার কথায়, “এত দীর্ঘ দূরত্ব, আমি জানি না কীভাবে এত ছোট দেশে এমনটা হয়”। যদিও কিছু স্টেডিয়াম দোহার ঝলমলে নতুন মেট্রো নেটওয়ার্কের সঙ্গে যুক্ত। তবে প্রায়ই স্টেশন থেকে আড়াই কিলোমিটারের মতো (দেড় মাইল) হাঁটার প্রয়োজন হয়। স্টেডিয়ামের গেট থেকে কয়েকটা ড্রপ-অফ পয়েন্টে হেঁটে শুধুমাত্র বাসে পৌঁছানো যায়। পছন্দের পানশালা এবং রেস্তোরাঁ তো আরো অনেক দূরে।
আল খোরের এই রুক্ষ-শুষ্ক মাঠ মোটেও সেলফি তোলার জন্য ভালো জায়গা নয়।সাইট ডিজাইনার নাথান থমাস বলেন তিনি “খাঁটি আরবি” বিষয় দেখে খুব খুশি। তার একমাত্র প্রধান উদ্বেগ নিরাপত্তা। কারণ সেখানে কোনো রক্ষী নেই। তাঁবুতে কোনো তালা নেই। সহজেই ফ্ল্যাপ খুলে ফেলা যায়।
তিনি বলেন, “এদিকে জনগণকে বলা হচ্ছে, এটি নিরাপদ দেশ, চিন্তা করবেন না।”
ফ্যান ভিলেজের ফ্রি জোন থেকে, দোহার দক্ষিণে মরুভূমিতে স্টেডিয়ামের আলোর ঝলকানিতে কৃত্রিম টার্ফের বিশাল এলাকা জুড়ে লাগেজ নিয়ে যাচ্ছিলেন একদল ফুটবলপ্রেমী। আসলে সেখানকার কেবিনগুলি হলো সবচেয়ে সস্তা আবাসন। এগুলির ভাড়া শুরু প্রতি রাত ২০০ ডলার থেকে।
কয়েক মিনিট অন্তর বিমানের শব্দ ভেসে আসে পুরানো বিমানবন্দরের কাচে। টুর্নামেন্টে প্রতিদিনের শাটল ফ্লাইটের জন্য এটি পুনরায় খোলা হয়েছে। ব্যানারগুলিতে অনুরাগীদের “উল্লাস” করার অনুরোধ ভেসে আসে।
টুর্নামেন্টের মাত্র কয়েকদিন আগে, সোশ্যাল মিডিয়া শৌচাগারের ছবিতে ভরে গিয়েছিল। এদিকে কাপ শুরু হলেও এগুলো এখনো বসানো হয়নি। তারগুলি এখনো জল এবং বিদ্যুৎ সংযোগের জন্য কুণ্ডলী পাকিয়ে রয়েছে। তারে ময়লাও জমেছে।
আল খর গ্রামে থাকা ফুটবলপ্রেমীরা নিজেদের মতো করে বিনোদন খুঁজছেন
অনেকেই চেক ইন করার জন্য দীর্ঘ অপেক্ষার অভিযোগ করেছেন৷ বুধবার রাতে লাইনে অপেক্ষারত অতিথিদের ভিড়ের সবাই জানিয়েছেন তারা ঘর পাননি কারণ অভ্যর্থনা ডেস্ক নিশ্চিত ছিল না কে চেক আউট করেছে৷
মরক্কো থেকে আসা মুমান অ্যালানি বলেন, “আমরা প্রাণশক্তি চাই। অন্য ফুটবলপ্রেমীদের চাই। এটি খুব অসংগঠিত।”
তাঁবুতে থাকা এক ফুটবলপ্রেমী টুইটারে এই সাইটটিকে “ফায়ার ফেস্টিভ্যাল ২.0” হিসাবে উল্লেখ করেছেন। ফায়ার ফেস্টিভ্যাল ২.0 একটি কুখ্যাত সংগীত উৎসব, যেই জাঁকজমকপূর্ণ উৎসবে অনুরাগীরা অন্ধকার সমুদ্রসৈকতে অস্থায়ী আশ্রয় নিয়ে বাধ্য হয়েছিলেন৷
ভারতের কলকাতার এক বাসিন্দা ২৩ বছর বয়সি আমান মোহাম্মদ একটি সাধারণ জায়গায় আছেন। তিনি বলেন, সাফাইকর্মীর জন্য প্রখর রোদে তাকে দুই ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয়েছিল। তিনি জানান, “ঘরের অবস্থা জঘন্য। শৌচাগারের মতো দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছিল ঘর থেকে। করুণ অবস্থা।”
তিনি অবশ্য মিথ্যা বিজ্ঞাপনের অভিযোগ আনেননি। তার কথায়, “ওয়েবসাইটে একটি বিশাল ধুলোময় জায়গায় পাশাপাশি রঙিন ধাতব বাক্সর ছবি দেখছিলাম।” তিনি হতাশ ছিলেন, তবে “শেষপর্যন্ত বিশ্বকাপ ফুটবল তো। সেটাই আসল।”
তিনি জানান, “(ক্রিস্টিয়ানো) রোনাল্ডো শেষ বিশ্বকাপ খেলছেন। আমি এখানে শুধু তাকে দেখতে এসেছি। ছোটবেলা থেকে এখানে আসা আমার স্বপ্ন।”