প্রতিবন্ধকতায় ‘পথ হারিয়েছে’ গাজীপুর মডার্ন ফায়ার স্টেশন!

গাজীপুর কণ্ঠ ডেস্ক : শিল্প অধ্যুষিত গাজীপুরের পেয়ারাবাগান এলাকায় নির্মাণ করা হয়েছে মডার্ন ফায়ার স্টেশন। প্রাথমিক নকশায় স্টেশনটির সামনে প্রধান সড়কে ওঠার রাস্তা দেখানো হলেও পরবর্তী সময়ে দেখা যায় সামনের ওই জমিটি ব্যক্তিমালিকানাধীন। সেখানে মার্কেট নির্মাণ করায় অবরুদ্ধ হয়ে পড়েছে অত্যাধুনিক সরঞ্জামে সজ্জিত চারতলাবিশিষ্ট স্টেশনটি। বৈদ্যুতিক খুঁটির কারণে শাখা সড়কেও তৈরি হয়েছে প্রতিবন্ধকতা। শুধু বের হওয়ার পথ না থাকায় ৬৮ মিটার বা ২৪ তলা পর্যন্ত বহুতল ভবনে আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ করার সক্ষমতাসম্পন্ন স্টেশনটি সাড়া দিতে পারছে না কোনো দুর্ঘটনায়। সব মিলিয়ে ত্রুটিপূর্ণ পরিকল্পনার কারণে গাজীপুর চৌরাস্তা মডার্ন ফায়ার স্টেশনটি একপ্রকার অবরুদ্ধ হয়ে পড়েছে।

শিল্প অধ্যুষিত অঞ্চলে ১১টি মডার্ন ফায়ার স্টেশন প্রকল্পের চারটি স্টেশনের কাজ এরই মধ্যে শেষ হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে গাজীপুর চৌরাস্তা মডার্ন ফায়ার স্টেশন, কাশিমপুরে সারাবো মডার্ন ফায়ার স্টেশন, সাভার সেনানিবাসের পাশে জিরাবো মডার্ন ফায়ার স্টেশন ও পাবনার রূপপুর গ্রীন সিটি মডার্ন ফায়ার স্টেশন। এ স্টেশনগুলোর মধ্যে গাজীপুর চৌরাস্তার মডার্ন ফায়ার স্টেশনটি বাদে অন্য তিনটি উদ্বোধন না হলেও অপারেশনাল কাজে যুক্ত হয়েছে। কিন্তু প্রবেশ ও বের হওয়ার সড়ক না থাকায় গাজীপুর চৌরাস্তার মডার্ন ফায়ার স্টেশনটি এখনো অপারেশনাল কার্যক্রমে যুক্ত হতে পারেনি। এর বাইরে রাজেন্দ্রপুর মডার্ন ফায়ার স্টেশনের কাজের অগ্রগতি ৮৩ শতাংশ, কোনাবাড়ি ৫৫ শতাংশ, চট্টগ্রামের কর্ণফুলী মডার্ন ফায়ার স্টেশনের ৯৩ শতাংশ, কালুরঘাটের ৩০ শতাংশ অগ্রগতি হয়েছে। নারায়ণগঞ্জের কাঁচপুর ব্রিজ ও ফতুল্লা শিবু মার্কেট মডার্ন ফায়ার স্টেশনের কাজ যথাক্রমে ৮৫ ও ২০ শতাংশ ভৌত অগ্রগতি সম্পন্ন হয়েছে। এ দুটি স্টেশনের ঠিকাদারের মৃত্যুর কারণে পুনঃদরপত্র আহ্বান করার সিদ্ধান্ত রয়েছে ফায়ার সার্ভিসের।

ঢাকা-গাজীপুর মহাসড়কের ভোগড়া বাইপাস থেকে কোনাবাড়ির দিকে মিনিট পাঁচেক হাঁটলেই পেয়ারাবাগান এলাকা। শিল্প অধ্যুষিত এ এলাকায় অগ্নিদুর্ঘটনা মোকাবেলায় নির্মাণ করা হয়েছে গাজীপুর চৌরাস্তা মডার্ন ফায়ার স্টেশন। চারতলা এ স্টেশনের নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে বছরখানেক আগে। শুক্রবার সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, স্টেশনটির কোনো প্রধান ফটক নেই। নেই গাড়ি বের হওয়ার কোনো বিকল্প ব্যবস্থা। স্টেশনটির প্রধান ফটকের জন্য নির্ধারিত জায়গায় মার্কেট নির্মিত হয়েছে ব্যক্তিমালিকানার সম্পত্তিতে। আর ডান দিকেও ব্যক্তিমালিকানাধীন সম্পত্তি। পেছনে পুকুর। শুধু স্টেশনটির বামদিকে একটি শাখা সড়ক রয়েছে। তবে সেটিও চলাচলের উপযোগী নয়। সেখানে একটি বৈদ্যুতিক খুঁটি প্রতিবন্ধক হিসেবে দাঁড়িয়ে রয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে সব ধরনের প্রস্তুতি ও সক্ষমতা থাকার পরও কোনো দুর্ঘটনায় অংশ নিতে পারছে না স্টেশনটি। এমনকি এ স্টেশনের অগ্নিনির্বাপণ গাড়িগুলোও সেখানে রাখা সম্ভব হচ্ছে না।

স্টেশনটির ভেতরে প্রবেশ করতেই সামনের দেয়ালে দুটি অ্যারো চিহ্ন চোখে পড়ে। স্টেশনের পেছনের পুকুরের সাইড ওয়ালের নির্মাণকাজ চলছে। সেখানকার এক নির্মাণ শ্রমিক নাম না প্রকাশের শর্তে জানান, নকশায় এ অংশই স্টেশনটির প্রধান ফটক হিসেবে উল্লেখ রয়েছে। কিন্তু এখানে ব্যক্তিমালিকানার সম্পত্তিতে স্থাপনা থাকায় প্রধান ফটক নির্মাণ সম্ভব হয়নি। তাই চিহ্ন দুটি দিয়ে রাখা হয়েছে। পরবর্তী সময়ে জমি অধিগ্রহণের মাধ্যমে এখানে প্রধান ফটক নির্মাণ করা হবে। রাস্তা নিয়ে জটিলতা না থাকলে স্টেশনটি অগ্নিনির্বাপণ কার্যক্রমে যুক্ত হতে পারত বলেও মন্তব্য করেন তিনি। শুধু নির্মাণ শ্রমিকেরাই নন, স্থানীয়দের মধ্যেও রয়েছে এ ফায়ার স্টেশন নিয়ে নানা কৌতূহল। মডার্ন ফায়ার স্টেশনের সামনে নির্মিত মার্কেটে সোনিয়া এন্টারপ্রাইজের সামনে কথা হয় স্থানীয় প্রবীণ হিরু মিয়ার সঙ্গে। পৈতৃক সূত্রে তিনি পেয়ারাবাগানের বাসিন্দা।

হিরু মিয়ার ভাষ্যমতে, এ ফায়ার স্টেশনের অবকাঠামোগত নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে গত বছরের শুরুতে। কিন্তু জমি নির্ধারণে ত্রুটি থাকায় এখন কাজে আসছে না স্টেশনটি। জমি নির্বাচনের ক্ষেত্রে যথাযথ যাচাই-বাছাই না করেই স্টেশন নির্মাণ করায় এ ধরনের জটিলতা তৈরি হয়েছে বলেও মনে করেন তিনি। এর পাশেই পেয়ারাবাগান চায়না মার্কেট। সেখানে কথা হয় স্থানীয় ব্যবসায়ী সাত্তার মিয়ার সঙ্গে। তিনি জানান, যে জমিতে মডার্ন ফায়ার স্টেশন নির্মাণ করা হয়েছে সেখান থেকে সরাসরি প্রধান সড়কে ওঠার সড়ক নেই। শাখা সড়ক থাকলেও সেটিতে ফায়ার সার্ভিসের অত্যাধুনিক অগ্নিনির্বাপণ গাড়ি যাতায়াত সম্ভব নয়। সামনে ব্যক্তিমালিকানাধীন সম্পত্তি থাকার বিষয়টি দেখেও স্টেশন নির্মাণ করা হয়েছে। এজন্যই মূলত স্টেশনটি কোনো ধরনের দুর্ঘটনায় সাড়া দিতে পারছে না।

গাজীপুর মডার্ন ফায়ার স্টেশনের জন্য কেনা অত্যাধুনিক সরঞ্জামে সজ্জিত গাড়িগুলোর দেখা মেলে গাজীপুর ফায়ার স্টেশনে। স্টেশন দুটির দূরত্ব ৬ কিলোমিটারেরও বেশি। ওই স্টেশনে গিয়ে দেখা যায়, মডার্ন ফায়ার স্টেশনের গাড়িগুলো খোলা আকাশের নিচে রাখা হয়েছে। স্টেশনটির কর্তব্যরত কর্মকর্তা জানান, মডার্ন স্টেশনে প্রবেশ ও বের হওয়ার রাস্তা না থাকায় গাড়িগুলো এ স্টেশনে রাখা হয়েছে। নিজেদের স্টেশনের গাড়ির পাশাপাশি এই গাড়িগুলো রক্ষণাবেক্ষণ নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি। বলেন, এটি একটি সাধারণ স্টেশন। স্বল্প লোকবল দিয়ে নিজেদের গাড়িগুলো শেডে রাখতে হিমশিম খেতে হয়। এরপর আবার মডার্ন স্টেশনের অত্যাধুনিক সরঞ্জামে সজ্জিত গাড়িগুলো এখানে রাখতে হয়। এসব গাড়ি রক্ষণাবেক্ষণ বেশ কঠিন।

গাজীপুর মডার্ন ফায়ার স্টেশনের বের হওয়ার রাস্তা না থাকার বিষয়টি উঠে এসেছে সরকারি এক মূল্যায়ন প্রতিবেদনেও। সেখানে বলা হয়েছে, স্টেশনটি নির্মাণকাজ শুরু হওয়ার পর প্রাথমিক নকশায় প্রদর্শিত স্টেশনটির সম্মুখ ভাগের প্রধান সড়কসংশ্লিষ্ট জায়গা ব্যক্তিমালিকানাধীন জমি হিসেবে দাবি করে সেখানে একটি টিনশেড স্থাপনা নির্মাণ করা হয়েছে। অগ্নিনির্বাপণে ব্যবহূত পানিবাহী গাড়ি চলাচলের কথা বিবেচনায় নিয়ে ওই জমি অধিগ্রহণের উদ্যোগ গ্রহণ করার পরামর্শও দেয়া হয়েছে প্রতিবেদনে। বলা হয়েছে, প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে গার্মেন্টস শিল্প অধ্যুষিত অঞ্চলে মডার্ন ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স স্টেশনগুলোর আওতায় দ্রুততার সঙ্গে এবং আধুনিক সরঞ্জামের মাধ্যমে অগ্নিনির্বাপণ, উদ্ধার ও প্রাথমিক চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। আধুনিক যন্ত্রপাতির যথাযথ ব্যবহারের মাধ্যমে অগ্নিদুর্ঘটনাসহ যেকোনো প্রকার দুর্ঘটনায় আটকে পড়া বিপন্ন মানুষকে দ্রুততম সময়ে কার্যকরভাবে উদ্ধার করা সম্ভব। শিল্পাঞ্চলের অগ্নিনির্বাপণে সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে উঠতে এবং ফায়ার সার্ভিস স্টেশনের সক্ষমতা বৃদ্ধিতে প্রকল্পটির দ্রুত বাস্তবায়ন প্রয়োজন।

১১টি মডার্ন ফায়ার স্টেশন প্রকল্পের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন উপসচিব শহীদ আতাহার হোসেন। তিনি বলেন, এরই মধ্যে এ প্রকল্পের চারটি মডার্ন স্টেশনের নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে। গাজীপুর মডার্ন ফায়ার স্টেশন থেকে প্রধান সড়কে ওঠার গেটটি নির্মাণের জন্য আরো কিছু জমি অধিগ্রহণের প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। দ্রুততম সময়ের মধ্যেই এ সমস্যার সমাধান হবে বলেও জানান তিনি।

 

সূত্র: বণিক বার্তা

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button