সাগরের বুকে ইসলামিক স্থাপত্য জাদুঘর
গাজীপুর কণ্ঠ ডেস্ক : কাতারের রাজধানী দোহায় অবস্থিত ‘দি মিউজিয়াম অব ইসলামিক আর্ট’। ১৪০০ বছরের পুরনো সংগ্রহ রয়েছে এই জাদুঘরে। জাদুঘর সীমানার মধ্যে আছে ২ লাখ ৮০ হাজার বর্গমিটারের বিশাল পার্ক যা ২৪ ঘণ্টা খোলা থাকে। এখন এটি হয়ে উঠেছে বিনোদনের এক প্রাণকেন্দ্র। কাতারের দর্শনীয় স্থানগুলোর মধ্যে অন্যতম এই জাদুঘর। বছরে প্রায় ৫ লাখ মানুষ এই জাদুঘর পরিদর্শন করেন। এবারের আয়োজন এই জাদুঘর নিয়ে।
স্থাপত্যশৈলী
জাদুঘরটির প্রাচীন ইসলামি স্থাপত্যশৈলী দ্বারা প্রভাবিত। কিন্তু প্রভাবিত হলেও আধুনিক সময়ে অনন্য স্থাপত্যশৈলীর নিদর্শন হয়ে দাঁড়িয়েছে এই জাদুঘর। আধুনিক সময়ের সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা সংবলিত, চোখ ধাঁধানো, নজরকাড়া এই জাদুঘর দেখতে ভিড় লেগেই থাকে সব সময়। এই জাদুঘরটি এত জনপ্রিয় যে এটি কাতারের সবথেকে বেশি দর্শনীয় স্থানের জায়গায় নাম লিখিয়েছে। ২০১৭ সালে এই জাদুঘর পরিদর্শন করেছেন সাড়ে চার লাখেরও বেশি মানুষ। যা কাতারের অন্য সব দর্শনীয় স্থানের তুলনায় বেশি।
জাদুঘরের পাশের পার্কটি সবসময় উন্মুক্ত থাকলেও নির্ধারিত সময়ে খোলা হয় জাদুঘর। শনি থেকে বৃহস্পতিবার খোলা থাকে সকাল ৯টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত। শুধু শুক্রবার অর্ধদিবস তথা দুপুর ১টা ৩০ মিনিট থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত খোলা থাকে জাদুঘর।
পাঁচ তলা বিশিষ্ট এ বিশাল জাদুঘরে নারী ও পুরুষদের জন্য আলাদা আলাদা ওজু ও নামাজের জন্য রয়েছে ব্যবস্থা। আগত দর্শনার্থীদের বিনোদনের জন্য রয়েছে ২০০ আসন বিশিষ্ট একটি থিয়েটার।
নির্মাতা আইএম পাই
এই জাদুঘরের নকশা করেছেন বিখ্যাত চীনা বংশোদ্ভূত মার্কিন স্থপতি আইএম পাই। ৯১ বছর বয়সে ৪৫ হাজার বর্গমিটারের বিশাল ভবনের নকশা করেন। এ জাদুঘরের নকশা করার আগে তিনি বিশ্বের বিভিন্ন মুসলিম দেশে প্রায় ৬ মাস ভ্রমণ করেছেন। পরিদর্শন করেছেন বিভিন্ন জাদুঘর ও মুসলিম স্থাপত্য । জ্ঞান অর্জন করেছেন মুসলিম ইতিহাস সম্পর্কে।
কাতার সরকার জাদুঘরের জন্য আরও অনেক জায়গা প্রস্তাব করেছিল। তবে তিনি সব জায়গা বাদ দিয়ে দোহা উপসাগরের এ স্থানটিকে বেছে নেন। কারণ হিসেবে তিনি জানান, জাদুঘরটি এমন জায়গায় হওয়া উচিত যেখানে ভবিষ্যতে কোনো উঁচু স্থাপনা এটিকে ঢেকে না দেয়। জাদুঘরের নির্মাণকাজ শুরু হয়েছিল ২০০০ সালে। ২০০৬ সালে নির্মাণকাজ শেষ হলেও ২০০৮ সালে তা সবার জন্য খুলে দেওয়া হয়।
স্থপতি এমন একটি জাদুঘর নির্মাণ করতে চেয়েছিলেন যেটাতে ইতিহাসের পাশাপাশি আধুনিকতার মিশ্রণে তৈরি হবে। আর তিনি তাই করেছেন।
নজরকাড়া ডিজাইন
জাদুঘরের অভ্যন্তরে জায়গা হচ্ছে প্রায় চার লাখ স্কয়ার ফিট। পাঁচতলা এই জাদুঘরের ভেতরের অংশগুলো অদ্ভুতভাবে কাচ দিয়ে সাজানো। যার এক পাশ থেকে আরেক পাশে যেতে হলে রয়েছে কাচের তৈরি সিঁড়ি। এর অভ্যন্তরীণ নকশাও এমনভাবে করা হয়েছে যেটাতে ফুটে উঠেছে ইসলামিক ভাবধারা। মাঝখানে রয়েছে ১৬৪ ফুট উঁচু এক গম্বুজ। নকশা এমনভাবে করা হয়েছে যা বাইরের দেয়ালের মধ্যে লুকানো। এর ওপরে রয়েছে খোলা জায়গা যেটা দিয়ে আলো প্রবেশ করতে পারে ভেতরে।
এই জাদুঘর তৈরিতে ব্যবহার করা হয়েছে পৃথিবীর সব থেকে মূল্যবান সব সামগ্রী। এসব বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আনা হয়েছে। জেট মিস্ট গ্রানাইড আনা হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র থেকে। পাথর আনা হয়েছে ফ্রান্স থেকে। স্টেইনলেস স্টিল আনা হয়েছে জার্মানি থেকে। এগুলো ছাড়াও বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তু থেকে মূল্যবান সব জিনিস দিয়ে তৈরি করা হয়েছে এই জাদুঘর।
বিচিত্র সব নিদর্শনে সমৃদ্ধ
পাঁচতলা প্রাচীন এই জাদুঘরটি আরব ইতিহাসের বহু গুরুত্বপূর্ণ দলিল-দস্তাবেজ, শিলালিপি, ইতিহাস-ঐতিহ্য এবং বিচিত্র সব নিদর্শনের খণ্ডচিত্র সংগ্রহ করার দিক থেকে এক সমৃদ্ধ জাদুঘর। এখানে ইসলামের বিভিন্ন যুগ অনুযায়ী আলাদা আলাদা গ্যালারিতে ভাগ করা হয়েছে। রয়েছে বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন সময়ের স্থাপত্য শিল্পের নিদর্শন। যেমন, ইসলামের প্রাথমিক যুগের জন্য রয়েছে আলাদা শিল্প গ্যালারি। মধ্য এশিয়া ও ইরানের ১২-১৬তম শতাব্দীর স্থাপত্য শিল্পের জন্য দুটি আলাদা গ্যালারি।
মিসর ও সিরিয়ার ১২-১৫ তম শতাব্দীর স্থাপত্য শিল্পের জন্য দুটি আলাদা গ্যালারি। ইরানের ১৬-১৯ শতকের আধুনিক স্থাপত্য শিল্পের আলাদা গ্যালারিও।
জাদুঘরে স্থান পাওয়া বস্তুগুলোর মধ্যে ধাতব বস্তু, কারুশিল্প সামগ্রী, কার্পেট, পাথর, সিরামিক পণ্য, কুরআনের দুর্লভ পান্ডুলিপি, মুদ্রা, জুয়েলারি, অস্ত্র, কয়েন, কাচের জিনিসসহ ইসলামি শিল্পের নানা নিদর্শন। এইসব বিভিন্ন ধরনের সংগ্রহ দিয়ে সমগ্র মুসলিম বিশ্বে ইসলামি সভ্যতার সমৃদ্ধি এবং কীভাবে সেগুলো দীর্ঘদিনে বিস্তৃত হয়েছে তা তুলে ধরা হয়েছে।
লাইব্রেরি
বিভিন্ন সভ্যতায় চিকিৎসাবিজ্ঞান, প্রকৌশল, জাদুবিজ্ঞান, জ্যোতির্বিজ্ঞানে মুসলিমদের অবদান ও বিভিন্ন ব্যবহৃত জিনিস যেমন স্থান পেয়েছে জাদুঘরে তেমনি এসবের ওপর লেখা বিভিন্ন দুর্লভ ও অমূল্য বই রয়েছে জাদুঘরে। আরবি ও ইংরেজিতে প্রায় ২০০ বিরল বই রয়েছে এখানে অন্য কোথাও পাওয়া যাবে না।
দেড় লাখেরও বেশি বই নিয়ে গঠিত এই লাইব্রেরিতে গবেষণার ব্যবস্থাও রয়েছে। শিশুদের জন্য রয়েছে আলাদা পড়ার জায়গা। আর সেই জায়গাটি এতই জনপ্রিয় যে শিশুরা তাদের অংশ ছেড়ে আসতেই চায় না।
এ পাঠাগারটিও সপ্তাহে ৫দিন রবিবার থেকে বৃহস্পতিবার সকাল ৮টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত খোলা থাকে। শুক্র ও শনিবার বন্ধ থাকে এ বিশাল গ্রন্থশালা। অনেক দুর্লভ বইয়ের সংগ্রহও রয়েছে এ পাঠাগারে।
গিফট শপ ও রেস্টুরেন্ট
ভোজন বিলাসীদের জন্য আরবি, ফরাসি ও ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের মজাদার খাবারে সমৃদ্ধ রেস্টুরেন্ট রয়েছে। এই রেস্টুরেন্টের বিশেষত্ব হলো এখানে সব অর্গানিক খাবার পাওয়া যায়। জাদুঘরটি সন্ধ্যা ৭টায় বন্ধ হয়ে গেলেও রেস্টুরেন্টটি রাত ১০টা পর্যন্ত খোলা থাকে। তবে শুক্রবার এ রেস্টুরেন্টটি বন্ধ থাকে।
রয়েছে গিফটশপ। এখানে জুয়েলারি, বই, ঘর সজ্জার নানা জিনিস মোমবাতি, শো পিসসহ নানা ধরনের জিনিস কেনাকাটা করতে পারবেন।
মিউজিয়ামটিতে দর্শনার্থীদের সুবিধার্থে আর্থিক লেনদেনের জন্য এটিএম বুথ, যোগাযোগের জন্য ফ্রি ওয়াইফাই কানেকশন, ফ্রি গাইড লাইন এবং অভ্যর্থনা ও তথ্য অনুসন্ধান কেন্দ্রও রয়েছে।
মিউজিক
জাদুঘরটি শুধু জাদুঘর থাকেনি। সেটা হয়ে উঠেছে বিনোদনের এক অনন্য জায়গাও। প্রতিমাসে একবার এখানকার হলরুমে আয়োজন করা হয় ইসলামিক মিউজিকের। সেই দিনটা যদি আগে থেকে জানা থাকে তাহলে সারা দিন ঘোরাঘুরির পর সেখানে আরাম করে একটু বিশ্রাম নিতে পারবেন সেই সঙ্গে সংগীতও শোনা হয়ে যাবে। রয়েছে ২০০ আসনের বিশাল এক থিয়েটার রুম।
পার্ক
জাদুঘর সীমানার মধ্যে রয়েছে ২ লাখ ৮০ হাজার বর্গমিটারের বিশাল পার্ক। যা কিনা ২৪ ঘণ্টা খোলা থকে। এ পার্কের নাম (MIA Park=The Museum of Islamic Art Park) এই পার্কটি সব বয়সীদের কাছে খুব জনপ্রিয়। বিশেষ করে শিশুরা এখানে খুব মজা পায়। শিশুদের বিভিন্ন বয়সের উপযুক্ত খেলার সরঞ্জাম, সাইকেল, স্কেট বোর্ড রয়েছে। এখানে যে কেউ চাইলে পিকনিকও করতে পারে। এই পার্ক এখন হয়ে উঠেছে কাতারবাসীর পারিবারিক সমাবেশের এক জনপ্রিয় স্থান।
শীতের দিনগুলোতে জাদুঘরের পাশের পার্কে বসে অস্থায়ী বাজার। নিত্যপ্রয়োজনীয় টুকিটাকি সেখান থেকেই কিনে নিতে পারবেন জাদুঘর পরিদর্শন শেষে।