বীজগণিতের গাছ-পাথর!

সাদিয়া ইসলাম বৃষ্টি : মিসরের রামেসিয়ামে খননকাজ চলছিল সেবার। হঠাৎ খুঁজে পাওয়া গেল এক বহু পুরনো প্যাপিরাস। তাতে প্রাচীন মিসরীয় সংখ্যার হিসাব লেখা। বহু পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর জানা গেল এই প্যাপিরাসের জন্ম খ্রিস্টপূর্ব ১৫৫০-এ। পরবর্তী সময়ে এর নাম রাখা হয় স্কটিশ ক্রেতা আলেকজান্ডার হেনরি রাইন্ডের নামকরণে রাইন্ড ম্যাথমেটিক্যাল প্যাপিরাস। কী ছিল এই প্যাপিরাসে?

মিসরীয় ইতিহাসে অক্ষর ও সংখ্যার লেখনী শুরু হয় খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় সহস্রাব্দে। তখন থেকে বেশির ভাগ সময় সংখ্যাকেই ব্যবহার করা হয়েছিল সেখানে নানা কাজে। হিসাব রাখা হতো গবাদিপশু আর উৎপাদনের, যার অনেকটাই পুরুষকেন্দ্রিক। মিসরীয় সভ্যতার শুরু প্রায় ৭ হাজার বছর আগে হলেও সেখানে ছিল দুটো লেখনী, আর লেখনীর মধ্যে সংখ্যার দুটো মাধ্যম। লেখনী দুটো ছিল হায়ারোগ্লিফিক আর হাইরেটিক। আর সংখ্যাগুলো দুটোতেই বেজ ভ্যালু ১০ হলেও একটিতে ছিল ১, ১০, ১০০, ১০০০…ধারা, অন্যটিতে ছিল ১ থেকে ১০ অবধি নানা রকম সংখ্যার উল্লেখ।

হ্যাঁ, প্রথমে সেটা পাটিগণিতে পূর্ণতা পেয়েছিল। তবে স্থাপত্য আর সরকারি কার্যক্রমের পর্যায়ে এসে ধীরে ধীরে নতুন এক ধারার দিকে যেতে শুরু করে মিসর। আর সেটা হলো বীজগণিত বা অ্যালজেব্রা।

মিসর অবশ্য একা নয়, বীজগণিতের যে খটমট সব সূত্র, সংখ্যা, চিহ্ন ব্যবহার করি আমরা এখন, তার শুরুতে হাতে হাত মিলিয়ে ছিল মেসোপটেমিয়া আর গ্রিসও। চলুন, বীজগণিতের সেই শুরুর গল্পটাকেই শুনে ফেলা যাক আজ।

মিসরীয় বীজগণিত

গণিত মিসরীয় সভ্যতার একটা বড় অংশ জুড়ে ছিল সবসময়। বিশেষ করে প্রাচীন মিসরে স্থাপত্য ও প্রশাসন—এই বিশাল দুটো স্তম্ভের ভিত্তিই ছিল গণিত। ফারাওদের মাধ্যমে সে সময় পণ্যের বণ্টন, পঞ্জিকার হিসাব, কর প্রদান, পারিশ্রমিক ইত্যাদি ব্যাপার মিসরে যে বেশ জমজমাটভাবে বজায় ছিল একটা সময় সেটা স্পষ্ট। তবে পণ্য, উৎপাদিত শস্য আর গবাদিপশুর হিসাব করতে গাণিতিক এসব জিনিসের ব্যবহার হওয়ায় পুরোটা যে পুরুষকেন্দ্রিক হিসেবেই ছিল সেখানে, সেটা ধারণা করে নেন বিশেষজ্ঞরা।

তবে হ্যাঁ, ভগ্নাংশের যে বীজগণিত, সেটা মিসরেই প্রথম ব্যবহার করার প্রমাণ পাওয়া গেছে। কথার এ পর্যায়ে এসে মিসরের বিখ্যাত দুটো প্যাপিরাসের কথা বিস্তারিতভাবে না বললেই নয়।

রাইন্ড ও মস্কো প্যাপিরাস

রাইন্ডের কথা তো আগেই বলেছি। রাইন্ড প্যাপিরাসের মতোই আরেকটি ১৫ ফুট লম্বা আর ৩ ইঞ্চি প্রশস্ত প্যাপিরাস পাওয়া যায় ফারাওদের অঞ্চলে। সেটার প্রথম মালিক, রাশিয়ার ভ্লাদিমির গোলেনিসচেভের সম্মানে নামকরণ করা হয় মস্কো ম্যাথমেটিক্যাল প্যাপিরাস। রাইন্ড ও মস্কো প্যাপিরাসের মধ্যকার মূল পার্থক্য ছিল এর গণিতকে দেখার ও বিশ্লেষণ করার পদ্ধতিতে। মস্কো শুধু যে রাইন্ডের চেয়ে বয়সে বড় ছিল তাই নয়, একই সঙ্গে এতে গাণিতিক সমস্যার সমাধানও করা হয়েছিল ব্যবহারিকভাবে। অন্যদিকে রাইন্ড প্যাপিরাসে দেয়া হয় বিশদ বর্ণনা।

রাইন্ড প্যাপিরাসে প্রাচীন মিসরীয় গণিতবিদদের দেখা যায় নানা রকম কঠিন সব সমস্যার সমাধান করতে। একাধিকবার দুই দিয়ে গুণের মাধ্যমে গুণন ও ভাগ বা সংখ্যাকে অর্ধেক করে ফেলে তার বিভাজন দুটোকেই রাইন্ডে দেখানো হয় দারুণভাবে। অন্যদিকে মস্কো প্যাপিরাসের পুরোটা জুড়েই ছিল দিকনির্দেশনা। মূলত, জাহাজের জন্যই করা হয়েছিল সংখ্যাকে ব্যবহার করে গতিবিধির এই হিসাবনিকাশ। সঙ্গে ছিল জ্যামিতিক খুঁটিনাটি।

এই যে আমাদের এত n সংখ্যকবার ধরে নিয়ে হিসাব করার প্রবণতা, 1/n ভগ্নাংশের প্রয়োগ, তার উৎপত্তিটা এখানেই। তবে এটুকুতেই আটকে ছিল মিসরীয়রা সেটা ভাবলে ভুলই হবে। অবশ্য তার পরও মিসরীয় পাটিগণিত চর্চার পর এই দুটো প্যাপিরাসকেই তাদের এবং পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন ও সহজ বীজগণিতের চর্চা বলে মনে করা হয়।

এই যেমন ধরুন না রাইন্ড প্যাপিরাসের ৭৫ নম্বর অংকের কথা। সেখানে নির্দিষ্ট পরিমাণ ময়দা থেকে ১৫৫টি পেসু ২০ বানানো গেলে সেই একই পরিমাণ ময়দা থেকে কতগুলো পেসু ৩০ বানানো যাবে সেই হিসাব করতে বলা হয়েছে। আর এ সমস্যার সমাধান করতে বেছে নেয়া হয়েছে x : 30 = 155 : 20 প্রক্রিয়াটিকে। পরবর্তী সময়ে ১৫৫কে ২০ দিয়ে ভাগ করে এরপর ফলাফলের সংখ্যাকে ৩০ দিয়ে গুণ করে পাওয়া গেছে ২৩২ দশমিক ৫। কী? মাথা ঘুরল তো প্রাচীন মিসরের এমন গণিতচর্চার প্রমাণ পেয়ে?

ঠিকঠাক মাথা ঘুরবে যখন জানতে পারবেন পিরামিডের পেছনে থাকা বীজগণিতের কারিকুরির কথা। এই যে মিসরীয় পিরামিড নিয়ে সবার এত উৎসাহ, সেটাকে বানাতেও এই বীজগণিত ব্যবহার করেছে বলে ধারণা অনেকের। এখানে জিওমেট্রি বা জ্যামিতির অবদান স্বীকার না করে উপায় নেই। মজার ব্যাপার হলো, বীজগণিতের এই জ্যামিতিক অংশের কথা তুললেই চলে আসে আরেকটি সভ্যতার কথা। বলছিলাম প্রাচীন মেসোপটেমিয়া নিয়ে। চলুন, এবার তাহলে বীজগণিতে এ সভ্যতার অবদানটুকুর কথাও জেনে নেয়া যাক!

মেসোপটেমিয়ার বীজগণিত

দুটো নাম একসঙ্গে পরপর এলেও মিসর আর মেসোপটেমিয়ার দূরদূরান্তে কোনো আত্মীয়তা নেই। দুটোর সময় ভিন্ন, আবার মিসর যেখানে নীল নদীর জন্য বিখ্যাত, মেসোপটেমিয়া সভ্যতা গড়ে উঠেছিল টাইগ্রিস আর ইউফ্রেটিস নদীর তীরে। পাঁচ সহস্র খ্রিস্টপূর্বে গড়ে ওঠা এ সভ্যতাকে শাসনের শুরুটা আক্কার সাম্রাজ্য করলেও পরবর্তী সময়ে আসে বদল। নিজেদের রাজত্বকে স্থায়ী করতেই শাসকরা বেছে নেয় স্ক্রাইব। শেষ পর্যন্ত শাসক হাম্মুরাবি এসে আইনি ও নগরকেন্দ্রিক সচেতনতা বৃদ্ধি করলে বদলে যায় পুরো সভ্যতা।

মিসরের চেয়ে কিছুটা ভিন্নতা দেখা যায় মেসোপটেমিয়া সভ্যতার গণিতে। এখানে লেখক কেবল পুরুষ নন, ছিলেন নারীও। তাদের চিত্রটা ছিল মিসরীয় নারীদের চেয়ে ভিন্ন। মজার ব্যাপার হলো মিসরীয় গণিতের বেশির ভাগই হারিয়ে গেলেও মেসোপটেমিয়ার বীজগণিত বেশ বড় আঙ্গিকে সংরক্ষণ করা সম্ভব হয়েছিল।

স্ক্রাইব সংরক্ষণে মেসোপটেমীয়দের দক্ষতা

কাগজে নয়, বরং মাটির ট্যাবলেটের ওপর গণিত কষেছেন মেসোপটেমিয়ার বাসিন্দারা। তারপর সেই মাটিকে কখনো রোদে, কখনো চুল্লিতে পুড়িয়েছেন। এক হাতে এটে যাওয়ার মতো ট্যাবলেটগুলো একটা পোস্টেজ স্ট্যাম্প থেকে শুরু হয়ে এনসাইক্লোপিডিয়ার বিশাল আকারেও পাওয়া যেত। এ সভ্যতার ধ্বংস হওয়া, মাটির নিচে পুঁতে থাকা দালান-কোঠার চাপে অনেক ট্যাবলেট হারিয়ে গেলেও তার মধ্যে থেকে কয়েকশ এমন ট্যাবলেট পাওয়া গেছে যেগুলো শুধু ঠিক আছে তাই নয়, একই সঙ্গে গণিতচর্চার সাক্ষ্যও বহন করছে।

মেসোপটেমিয়ায় গণিতের ধরন-ধারণ

বাণিজ্য ও পণ্য বণ্টনের জায়গা থেকেই গণিত চলে এসেছে মেসোপটেমিয়ায়। এই গণিতে ছিল ১ থেকে ৬০ পর্যন্ত গণনার হিসাব। ছিল a, b, c, d, e ইত্যাদি এবং এদের ব্যবহারও। তখন অবশ্য এত সহজ ছিল না অক্ষরগুলো। গণিতের ফাঁকা অংশে শূন্য ব্যবহারের ব্যাপারটাকেই তারা ভাবেনি। অ্যাকাউন্টিং, সার্ভে, জমির পরিমাণসহ নানা রকম কাজে ব্যবহার করে তারা গণিত। আর সেখান থেকেই পরিমাপের আন্দাজ নিয়ে কাজ করার প্রক্রিয়া সম্পর্কে ভাবতে গিয়ে জন্ম নেয় ‘‌জ্যামিতিক বীজগণিত’ বা ‘‌জিওমেট্রিকার অ্যালজেব্রা’। আপনি অনেক কিছুর আসল দৈর্ঘ্য বা প্রস্থ না-ই জানতে পারেন। জিওমেট্রিক অ্যালজেব্রা সেটাই ঠিক করার রাস্তা বাতলে দেয়।

মূলত, প্রতিদিনের কার্যক্রমের অংশ হিসেবেই বীজগণিত ব্যবহার করা, তৈরি ও চর্চা শুরু করে মেসোপটেমিয়া। খুব কোনো প্রয়োজন থেকে নয়। এই বিশেষ বীজগণিতের কাজটাই টু-ডাইমেনশনাল। একদিকে যেখানে লিনিয়ার ইকুয়েশনের মতো ব্যাপারে মেসোপটেমিয়া সিদ্ধহস্ত, তাদের ধাক্কাটা দিচ্ছিল পিছিয়ে থাকার অনুভূতিটা। আর সেখান থেকেই আসে ax = b-কে ধরে নিয়ে ax : a = x : 1-এর সম্পূর্ণ কাল্পনিক কিছু একটা প্রক্রিয়া। ব্যাপারটা খুব সহজ। এই মনেই করুন না, একটা পাথরের অংকটাকে!

YBC 4652 ট্যাবলেটে পাওয়া এই প্রশ্নটা ছিল অনেকটা এমন যে, আমি একটা পাথর পেলাম। এবার তাতে আরো সাত কেজি ওজন চাপালাম। তারপর চাপালাম আর ১১ কেজি। ওজন হলো ১ মিনা। এবার পাথরের ভার নিয়ে সেটাকে কীভাবে বের করবেন?

প্রথমে তো পাথরটার মোট ওজন কত সেটা জেনে নিন। তারপর বাকি সব ওজন বাদ দিলে এমনিতেও পাথরের আসল ওজন বের করা সম্ভব। যেটাকে একটু ফ্যাশনেবলভাবে সেখানে লিপিবদ্ধ করে লেখা হয়েছে X দিয়ে। এই যে একটা চারকোনা মাঠ নিয়ে অংক, চৌবাচ্চা নিয়ে অংক—এসবটাতেও আছে মেসোপটেমিয়ার জ্যামিতিক বীজগণিতের হাত। সঙ্গে ‘‌কোয়াড্রাটিক ফর্মুলা’র ব্যাপার তো আছেই। কোইফিশিয়েন্ট অব X-এর ব্যবহার নেতিবাচক আর ইতিবাচক দুটোকেই ধরেছিল এই সভ্যতার মানুষগুলো।

‘‌স্কেলিং’, ‘‌স্কয়ার’ বা ‘‌কনভেক্স স্কয়ার’-এর মতো সূত্রগুলোও এসেছিল মেসোপটেমীয়দের হাত ধরে। মজার ব্যাপার হলো এমন অনেক মেসোপটেমীয় ট্যাবলেটের খোঁজ পাওয়া গেলেও সেখানে গণিতগুলো করা হয়েছিল কেন, কোন প্রয়োজন থেকে, কোথায় এর ব্যবহার হয়েছিল সেসবের ব্যাপারে লেখা নেই। বিশেষজ্ঞদের মধ্যে অনেকে এ ব্যাপারটাকে বংশানুক্রমিকভাবে চলে আসা ট্যাবলেট বলে মনে করেন। এগুলো জন্ম নেয়ার পেছনের কারণকে নিজের মতো করে বানিয়েছেন অনেকেই। এই যেমন জেন্স রাপের মতে, সমীক্ষক আর লেখকদের পারদর্শিতা বোঝাতে জ্যামিতিক বীজগণিতগুলো করা হয়েছিল। আবার এলেনর রবসনের মতে, শাসন ব্যবস্থার পদ্ধতিগুলো নির্ণয় করতে বানানো হয়েছিল ট্যাবলেটগুলো। জমির ভাগ-বণ্টন, কর প্রদান এসবের জন্য দরকার পড়েছিল হিসাবের। তবে কারণ যেটাই হোক না কেন, নিজেদের বুদ্ধিমত্তার প্রমাণ দিয়ে গেছেন মেসোপটেমিয়ার বাসিন্দারা এ হিসাবনিকাশের মাধ্যমে।

সাধারণত মিসর বা মেসোপটেমিয়ায় জ্ঞান শিক্ষক তার ছাত্রের কাছে দিয়ে গেছেন। কিছু জ্ঞান গড়িয়েছে বংশের মাধ্যমে। ফলে শিক্ষক শুধু যে বাস্তব সমস্যা সমধানের জন্য যেটুকু গণিত প্রয়োজন সেটুকুরই চর্চা করেছেন তা নয়, বরং ভবিষ্যতে কী কী সম্ভাব্য সমস্যা দেখা দিতে পারে সেগুলোর সমাধানটাও দেয়ার চেষ্টা করেছেন। ফলে সব মিলিয়ে এই দুটো সভ্যতায় পাওয়া সব লিনিয়ার ইকুয়েশন বা কোয়াড্রাটিকের সঙ্গে বাস্তব সমস্যার যোগাযোগ খুঁজতে যাওয়াটা অনেক ক্ষেত্রে বোকামি হবে আমাদের জন্য। তবে তাদের এ জ্ঞান আরো গড়িয়েছে বহুদূর।

বর্তমান যুক্তরাষ্ট্র বা ইসলামিক রাষ্ট্র তো মিসরীয় ও মেসোপটেমীয় গাণিতিক জ্ঞান ব্যবহার করেছেই, তবে তার চেয়েও আরেকটু নিকট দূরত্বে থাকা সভ্যতা নিয়ে কথা বলতে গেলে এর পরই চলে আসবে গ্রিসের নাম।

গ্রিক বীজগণিত

গ্রিসে বীজগণিতের যে চর্চা সেটার শুরুটা হয়েছিল সভ্যতাটির বিকাশ পদ্ধতির অংশ হিসেবেই। ৬০০ খ্রিস্টপূর্বে গণিত বেশ বড় একটা জায়গা করে নেয় এখানে। আর সেটাও মিসর বা মেসোপটেমিয়ার চেয়ে অনেকটা আলাদাভাবে।

গ্রিস রাজনীতিকে অসম্ভব গুরুত্ব দেয়। নগরায়ণকে অনেকটা এগিয়ে নিয়ে যায় পোলিস বা শহর অঞ্চল তৈরির মাধ্যমে। এখানে জনগণের শাসক হিসেবে একতান্ত্রিক বা বহুতান্ত্রিক যে মাধ্যমই আসুক না কেন, তাকে লড়তে হয়েছে সবার সঙ্গে মানসিক দক্ষতায়। গণতন্ত্র মজবুত ছিল গ্রিসে। তাই শাসককে জবাবদিহিতা যে দিতে হবে সেটাও ছিল স্পষ্ট। ফলত যার যার চিন্তা আর ধারণাকে ঠিক প্রমাণের একটা বড় হাতিয়ার ছিল গ্রিসে গণিত।

একদম ঠিকঠাকভাবে গণিত নিয়ে গ্রিসে প্রথম লেখা হয় ৩২০ খ্রিস্টপূর্বে। ‘‌ইউডেমাস অব রোডস’ নামের এই লেখনীর পর এসেছে ‘‌সিই’। কাজ করেছেন থাকেল ও আরো অনেক গণিতবেত্তা। বিশেষ করে পঞ্চম ও চতুর্থ খ্রিস্টপূর্বে পিথাগরাস, ইউডোক্সাস, আর্কিটাসের মতো বহুজন কাজ করেছেন বীজগণিত নিয়ে। প্রাথমিক এই বেশির ভাগ গাণিতিক কার্যক্রমের কেন্দ্রস্থল ছিল ধনাঢ্য ব্যক্তিদের অঞ্চল এথেন্স। সিমিলারিটি, রেশিও, পলিগনস, প্রোপরশনের মতো শব্দগুলোর দেখা মেলে সেখানে। একই সঙ্গে অ্যারিস্টটলের যৌক্তিক বিতর্ক এবং অন্য গণিতবিদদের প্রোপজিশনাল লজিকের ঝাঁজটাও বাড়তে থাকে এ সময়।

গণিতচর্চায় ইউক্লিড ও তার শিষ্যরা

ইউক্লিড কে ছিলেন তা নিয়ে খুব একটা তথ্য নেই কোথাও। আলেকজান্দ্রিয়ায় বাস ছিল তার, এতটুকুই তথ্য আছে সবার কাছে। তবে অ্যারিস্টটলের মূলনীতি মেনে খুব দ্রুত গণিতে বেশ বড় আকারের প্রভাব রাখেন তিনি। বিশেষ করে গ্রিসে তার গণিতকে সেরা হিসেবে ধরা হয় সে সময়। নিজের ‘‌এলিমেন্ট’-এ বীজগণিতকে উপস্থাপন করেন ইউক্লিড, যেটা নিয়ে বিতর্কেরও জন্ম হয় পরবর্তী সময়ে। কেন লিখেছিলেন তিনি এই বই, উদ্দেশ্য কী ছিল এমন প্রশ্ন মাথায় ঘোরে সবার।

এলিমেন্টের দ্বিতীয় ভলিউমে নানা রকম চতুষ্কোণ আর আয়তক্ষেত্রের মধ্যকার সম্পর্ককে ফুটিয়ে তোলেন তিনি এ বইয়ে। অনেকেই বলে থাকেন যে একসঙ্গে প্রথম ও চতুর্থ বইয়ের কিছু ব্যাপার মিলিয়ে নিলে সেটাকে সহজেই ‘‌জ্যামিতিক বীজগণিত’ বলে দেয়া যায়। আয়তক্ষেত্রকে সবসময় দুটো সোজা লাইনের মাধ্যমেই বর্ণনা করেছেন ইউক্লিড। কখনই এর প্রশস্তের দিকে যাননি। আর নিজের এ বর্ণনায় হিসাব করতে ব্যবহার করেছেন তিনি সংখ্যা।

ধরুন, ইউক্লিডের দ্বিতীয় বইয়ের নিম্নোক্ত সমস্যাটির কথা—

Proposition II.11: To cut a given straight line so that the rectangle contained by the whole and one of the segments is equal to the square on the remaining segment.

এখানে পুরো ব্যাপারটিকে জ্যামিতিক মনে হলেও এতে লুকিয়ে আছে বীজগণিতও। এভাবেই নিজের কাজে বীজগণিত আর জ্যামিতিকে মিশিয়ে ফেলেছেন এ গণিতবিদ। এমনকি তার পরবর্তী বই, যেমন ‘‌দ্য ডাটা’ ‘‌এলিমেন্ট’কেই বোঝাতে সহায়তা করেছে।

তবে ইউক্লিডের পাশাপাশি এক্ষেত্রে এগিয়ে থাকবেন গ্রিক গণিতবিদ অ্যাপোলোনিয়াসও। মনে করা হয় ইউক্লিডেরই একজন শিষ্য ছিলেন অ্যাপোলোনিয়াস। সেখান থেকেই তার মধ্যে গণিতচর্চার আগ্রহ জন্ম নেয়। পরবর্তী সময়ে যেটা গিয়ে দাঁড়ায় কনিক সেকশনে। সতেরো শতকে কনিক সেকশনকেই অ্যানালিটিক্যাল জিওমেট্রি বা বীজগণিতকে জ্যামিতির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়ার মাধ্যম মনে করা হয়। আর এর পুরোধা হিসেবে এগিয়ে রাখা হয় অ্যাপোলোনিয়াসকে। শুধু জ্যামিতিক না, বরং জ্যামিতির বীজগাণিতিক সত্তার উদ্ভাবক হিসেবেও মনে করা হয় তাকে।

অ্যাপোলোনিয়াসের পর আসেন আর্কিমিডিস। যিনি শুধু কনিক সেকশন নয়, বরং এটার মাধ্যমে কিউবিক ইকুয়েশনের সমাধানের দিকেও এগিয়ে যান। আর এভাবেই একটু একটু করে এগিয়ে যায় বীজগণিত বা অ্যালজেব্রার চর্চা। মিসর, মেসোপটেমিয়া বা গ্রিসের এই সময়টায় বীজগণিতের বেশির ভাগটাই যে জ্যামিতিক ছিল সেটা বলা ভুল হবে না অবশ্য!

 

লেখক : সাদিয়া ইসলাম বৃষ্টি

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button