কোটি কোটি টাকার সম্পত্তি গড়েছেন গণপূর্ত বিভাগের কার্য সহকারী রফিকুল, দুদকে অভিযোগ
গাজীপুর কণ্ঠ ডেস্ক : কোটি কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন গণপূর্ত বিভাগের কার্য সহকারীর পদে চাকরি করে কালীগঞ্জের রফিকুল ইসলাম মোল্লা।
উত্তরাতে কিনেছেন বিলাসবহুল ফ্ল্যাট। সম্প্রতি রেলওয়ের জমি দখল করে কালীগঞ্জে চলমান রয়েছে পাঁচতলা ফাউন্ডেশন দিয়ে প্রায় নয় শতক জমিতে দু’টি বাড়ির নির্মাণ কাজ। এর মধ্যে একটি বাড়ির চারতলা যা প্রায় ১৪০০ স্কয়ার ফিট এবং অপরটির প্রায় ১৮০০ স্কয়ার ফিট দ্বিতীয় তলার নির্মাণ প্রায় শেষ পর্যায়ে। বাড়ি নির্মাণে খরচ এখন পর্যন্ত ছাড়িয়েছে প্রায় কোটি টাকা।
এছাড়াও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, কালীগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন মৌজায় তার রয়েছে দশ বিঘারও বেশি সম্পত্তি। যার বাজার মূল্যে পাঁচ কোটি টাকার অধিক। রয়েছে পূর্বাচলে কয়েকটি প্লট। গণপূর্ত বিভাগে চাকরি করে গত ৩৬ বছরে এতসব তিনি গড়েছেন। এ সব সম্পত্তি রয়েছে তার স্ত্রী, তিন সন্তান এবং স্ত্রীর বোনসহ নিজ নামে।
১৯৮১ সালে মাস্টার রোলে খন্ডকালীন দৈনিক মজুরি ভিত্তিক ‘নো ওয়ার্ক নো পে’ অর্থাৎ ‘কাজ আছে মজুরি আছে, কাজ নেই মজুরি নেই’- এই শ্রেণির কর্মচারী হিসেবে গণপূর্ত বিভাগে যোগদান করে পনের বৎসর পর ১৯৯৬ সালে ‘কার্য সহকারী’ পদে চাকরি স্থায়ী হয়। বর্তমানে গাজীপুরে কর্মরত রয়েছেন রফিকুল ইসলাম মোল্লা।
৩৬ বছরে কার্য সহকারীর পদে চাকরি করে তার মোট বৈধ উপার্জন বেতন থেকে প্রাপ্ত অর্থের পরিমাণ মাসে গড়ে ১২ হাজার করে হিসেব করলে সর্বোচ্চ দাড়ায় ৪৭ লাখ ৫২ হাজার টাকা। এর বিপরীতে ৩৬ বছরে তার পারিবারিক, শিক্ষা ও চিকিৎসা খাতে ব্যয়ের হিসেব করলে উপার্জিত অর্থের সম্পূর্ণটাই শেষ হয়ে যাওয়ার কথা। এর পরও রফিকুল ইসলামের এতো স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি অর্জনের বিষয়ে এলাকায় ছড়িয়ে পড়লে লোকজনের মাঝে ব্যাপক চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়েছে।
এরই প্রেক্ষিতে সম্প্রতি তার সম্পদ অনুসন্ধানের জন্য দুর্নীতি দমন কমিশনের কাছে আবেদন করেছে এলাকাবাসী। সেই আবেদনের অনুলিপি একই সঙ্গে পাঠিয়েছে জেলা প্রশাসকের কার্যালয় এবং গণপূর্ত বিভাগের গাজীপুর জেলা অফিসের প্রধানের বরাবর। আবেদনে রয়েছে শতাধিক এলাকাবাসীর স্বাক্ষর।

রফিকুল ইসলাম মোল্লা কালীগঞ্জ উপজেলার গোলাবাড়ি গ্রামের মোসলেহ উদ্দিনের ছেলে। বর্তমানে তিনি কালীগঞ্জে উপজেলার গোলাবাড়ির বাড়িতে বসবাস করেন।
জানা যায়, ১৯৮১ সালে গণপূর্ত বিভাগে মাস্টার রোলে চাকুরিতে যোগদান করে পনের বৎসর পর ১৯৯৬ সালে তৃতীয় শ্রেণির ‘কার্য সহকারী’ পদে চাকরি স্থায়ী হয়। এর পর থেকে প্রায় ২২ বৎসর যাবৎ গণপূর্ত বিভাগ এর গাজীপুর জেলা অফিসে কর্মরত রয়েছেন রফিকুল ইসলাম মোল্লা। আরে এ সুযোগে তিনি বিভিন্ন অনিয়মের জড়িয়ে পড়েছে। যদিও চাকরি বিধান অনুযায়ী তিন বছরের অধিক একই স্থানে থাকার কোনো বিধান না থাকলেও রহস্যজনকভাবে রফিকুল ইসলাম রয়েছে গাজীপুরেই।
রফিকুল ইসলামের ছেলে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং এ ডিপ্লোমা করেছে এবং দুই মেয়ে বর্তমানে ইডেন কলেজে অনার্স (স্নাতক) শ্রেণীতে অধ্যায়নরত রয়েছে, যা খুবই ব্যয় বহুল বলে জানিয়েছে এলাকাবাসী।
দুদকের আবেদনে বলা হয়েছে, গণপূর্ত বিভাগ গাজীপুরে কার্য সহকারী হিসেবে কর্মরত থাকিয়া নামে বেনামে কোটি কোটি টাকার সম্পত্তির মালিক হয়েছে রফিকুল ইসলাম মোল্লা। যাহা দুদক কর্তৃক অনুসন্ধান হওয়া অপরিহার্য। অল্প কিছুদিন যাবৎ তার বাড়ি কালীগঞ্জের গোলাবাড়ি এলাকায় সড়ক ও রেল লাইনের পাশে দুইটি বৃহৎ আকারের পাঁচতলা ভবন নির্মাণ করার জনগণের মনে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে রফিকুলের আয়ের উৎস কি? একজন তৃতীয় শ্রেণীর কর্মচারী তার বেতন ভাতা দিয়ে ছেলে-মেয়ে লেখাপড়া চালিয়ে সংসার পরিচালনা করাই কঠিন। কিন্তু তার বিত্ত বৈভবের যেন কুলকিনারা নেই। এসব এলাকার জনমানুষের জিজ্ঞাসা রফিকুল মনে হয় আলাদিনের চেরাগ পেয়েছে? তার শ্বশুর বাড়ীর এলাকায় কালীগঞ্জের মুক্তারপুরে নামে-বেনামে প্রচুর কৃষি জমি ক্রয় করেছে বলে জানা গেছে। যা তদন্তে বেরিয়ে আসবে।
দুদকে আবেদনের পর সরেজমিনে জানা গেছে, কালীগঞ্জ-ঘোড়াশাল বাইপাস সড়কের গোলাবাড়ি এলাকায় নির্মাণাধীন রয়েছে দুটো বাড়ি, এর একটি টঙ্গী-ভৈরব রেললাইন ঘেঁষে স্থাপন করা হচ্ছে। দুইতলা পর্যন্ত এর মধ্যে নির্মাণ প্রায় শেষ পর্যায়ে। যার কিছু অংশ রয়েছে রেলেওয়ের জমির মধ্যে। অপরটি বাড়িটি স্থাপন করা হয়েছে সড়কের পাশে ওই বাড়ির চারতলা পর্যন্ত নির্মাণ শেষ পর্যায়ে রয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় একাধিক ব্যক্তি জানান, রফিকুলের বাড়ি দু’টির নির্মাণ খরচ প্রায় কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। এছাড়াও কালীগঞ্জ উপজেলার বালিগাঁও, মূলগাঁও এবং উত্তরগাঁও মৌজায় রয়েছে তার প্রায় দশ বিঘা জমি। তার শশুর বাড়ি মোক্তারপুরেও রয়েছে অনেক জমি। আছে পূর্বাচলে কয়েকটি প্লট এবং উত্তরার সাত নাম্বার সেক্টরে কিনেছেন বিলাসবহুল একটি ফ্ল্যাট। সব মিলে প্রায় দশ কোটি টাকার বেশি স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি রয়েছে তার। এতো সব করেছেন তার স্ত্রী, তিন সন্তান এবং স্ত্রীর বোনের এবং রফিকুলের নিজের নামে। সামান্য বেতনে চাকরি করে এতো সম্পত্তি অর্জনের বিষয়ে এলাকায় ছড়িয়ে পড়লে লোকজনের মাঝে ব্যাপক চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়।
এছাড়াও সে ‘একোয়ার ব্যবসা’র নামে বিভিন্ন সময়ে সরকার জমি অধিগ্রহণ করার সময় ক্ষতিগ্রস্তদের জমি চুক্তিভিত্তিক ভাড়া নিয়ে ক্ষতিপূরণে বেশি অর্থ আদায়ের জন্য বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণ করে অতিরিক্ত বিল উত্তোলন করে। অধিগ্রহনে ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণ করে থাকে গণপূর্ত বিভাগ এ সুযোগেই সে এসব অপকর্ম করে থাকে। যা করেছিল কালীগঞ্জ-ঘোড়াশাল বাইপাস সড়ক, টঙ্গী-ভৈরব ডাবল রেললাইন এবং গাজীপুর-আজমতপুর-ইটাখোলা সড়ক নির্মাণের অধিগ্রহণের সময়। এসকল বিষয়ে অনুসন্ধানের জন্যই আমরা দুর্নীতি দমন কমিশনের কাছে আবেদন করেছি।
অভিযোগের কিছুটা সত্যতা মিলেছে রফিকুল ইসলাম মোল্লা সঙ্গে আলাপকালে। ‘একোয়ার ব্যবসা’র বিষয়ে তিনি বলেন ওটা আমর ছেলের নামে।
বাড়ি নির্মাণ আর জমির বিষয়ে বলেন, ‘টঙ্গী-ভৈরব ডাবল রেললাইন নির্মাণের সময় জমি অধিগ্রহণ থেকে প্রাপ্ত ৩৭ লাখ টাকা এবং পৈত্রিক সূত্রে প্রাপ্ত এক বিঘা জমি বিক্রি ৫৭ লাখ টাকায় পৈত্রিক সূত্রে পাওয়া ৪ শতক জমিতে একটি এবং স্ত্রী নামে শশুরের কিনে দেওয়া ১১ শতক জমি থেকে টঙ্গী-ভৈরব ডাবল রেললাইন নির্মাণে অধিগ্রহণের পর থাকা ৫ শতক জমির মধ্যে অপর একটি বিল্ডিং তৈরির কাজ করছি’। বর্তমানে নির্মাণ কাজ বন্ধ রয়েছে। এছাড়াও ‘৫০ হাজার টাকা দিয়ে স্ত্রীর নামে মুক্তাপুর এলাকায় ১৯৯৩ সালে ১২ গন্ডা জমি কিনে দিয়েছেন আমার শশুর’।
উত্তরার বিলাসবহুল ফ্ল্যাট এবং পূর্বাচলের প্লট সম্পর্কে তিনি বলেন, এগুলো সম্পূর্ণ মিথ্যে এবং বানোয়াট তথ্য যা সম্পূর্ণ উদ্দেশ্য প্রণোদিত।
অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র মূলকভাবে এসব অপপ্রচার চালানো হচ্ছে, যা সম্পূর্ণ মিথ্যা এবং বানোয়াট।
১৯৮১ সালে তিনি চাকরিতে যোগদান করেন। তখন গাজীপুর সার্কেল ছিল সাভারে। এরপর ‘প্রায় ২০ বৎসর যাবৎ গাজীপুরে কর্মরত রয়েছেন বলেও জানান তিনি’।
গণপূর্ত বিভাগ গাজীপুরের নির্বাহী প্রকৌশলী মুহাম্মদ সারওয়ার জাহান বলেন, রফিকুল ইসলামের সম্পদ অনুসন্ধানের আবেদনের বিষয়টি সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
উল্লেখ্য: এলাকাবাসীর স্বাক্ষরসহ দুদকে দেওয়া আবেদনের কপি আমাদের সংরক্ষণে রয়েছে।