মোগল আমলে কৃষকের জীবন ছিল অভাব ও দুঃখের বাসভূমি

গাজীপুর কণ্ঠ ডেস্ক : কৃষকরা একদিকে যেমন মাটির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ একইভাবে ঘনিষ্ঠ উৎপাদন প্রক্রিয়ার সঙ্গে। দক্ষিণ এশিয়ার মতো কৃষিপ্রধান অঞ্চলে কৃষিকে কেন্দ্র করে গঠিত হয় জীবনাচার ও অর্থনীতি। ফলে মোগল সাম্রাজ্যের গতি প্রকৃতি বুঝতে সে সময়ের কৃষি ও কৃষকের অবস্থা পর্যালোচনা করা জরুরি।

সতেরো শতকে ভারতীয় উপমহাদেশের গ্রামগুলো কয়েক ভাগে বিভক্ত ছিল। আবার গ্রামীণ কৃষক সমাজও বিভক্ত ছিল কয়েক ভাগে। ইতিহাসবেত্তারা মোগল আমলের গ্রামীণ সমাজকে তিনটি আলাদা ভাগে ভাগ করেছেন। যারা উঁচু স্তরের কৃষক ছিলেন, তাদের ‘মালিক-ই-জমিন’ কিংবা ভূমির মালিক হিসেবে ডাকা হতো; যারা ভূমির প্রকৃত মালিক হিসেবে বিবেচিত হতেন। দ্বিতীয় শ্রেণীর যারা ছিলেন তাদের বলা হতো ‘পাহি’ বা ‘উপারি’, যারা ছিলেন বইরে থেকে আসা। তারা গ্রামে গ্রামে কৃষিকাজের খোঁজ করতেন, কাজ পেলে সেখানে তারা কাজ করতেন। কাজের খোঁজে ভিন্ন ভিন্ন গ্রামে তারা যেতেন। তৃতীয় শ্রেণীর ব্যক্তিরা মালিক-ই-জমিন বা ভূমির মালিকদের থেকে শস্যের ভাগ বিনিময়ের দ্বারা জমি নিতেন। এছাড়া ভূমিহীন কিছু কৃষক ছিলেন। তাদের অনেকেই চর্মকার, কুমার ও ধোপা ছিলেন। এ শ্রেণীর মানুষ কৃষকদের বিভিন্ন প্রয়োজনীয় কাজ করে দিতেন এবং শস্য ফলানোর পর কৃষক মজুরি হিসেবে কিছু শস্য তাদের প্রদান করতেন।

সম্রাট জাহাঙ্গীরের আমলে ফ্রান্সিসকো পেলসার্ট নামে একজন ওলন্দাজ পর্যবেক্ষক মন্তব্য করেছিলেন, ‘সাধারণ মানুষ এতটাই দারিদ্র্যের মধ্যে বাস করে যে তাদের জীবনের ছবি বা নিখুঁত বিবরণ দিলে বলতে হয় এ জীবন শুধু এক তীব্র অভাব ও নিদারুণ দুঃখের বাসভূমি।’ কৃষকরা ছিলেন এ জনগোষ্ঠীর মধ্যে অন্যতম। কৃষকদের সাধারণ ভোগ্য ও ব্যবহৃত জিনিসপত্রের বিবরণ দিতে গেলে আমাদের চোখে ভেসে উঠবে এমন কিছু মানুষের বেঁচে থাকার সংগ্রাম, যারা টিকে থাকার জন্য সর্বনিম্ন প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র জোগাড় করতে সক্ষম হতেন।

কৃষকদের খাদ্যাভ্যাস কেমন ছিল তা খুঁজতে গেলে তাদের খাদ্যতালিকা আমাদের পরিষ্কার দিকনির্দেশনা দিতে পারে। বাংলা, ওড়িশা, সিন্ধু ও কাশ্মীরের প্রধান শস্য ছিল চাল। স্বভাবতই ধারণা করা যায়, এসব অঞ্চলে চালই সাধারণ মানুষের প্রধান খাদ্য। গুজরাটের বেলায় ছিল জোয়ার ও বাজরা। কিন্তু চাষীদের উৎপন্ন ফসলের মধ্যে সবচেয়ে নিচু মানের ফসলই নিজেদের পরিবারের জন্য রাখতে হতো। কাশ্মীরে সাধারণ মানুষের খাদ্য ছিল মোটা চালের ভাত এবং বিহারের কৃষকরা বাধ্য হতেন মটরশুঁটির দানার মতো খেসারি খেতে। ফলে তাদের মধ্যে নিত্য অসুখবিসুখ লেগে থাকত। সবচেয়ে ভালো গম উৎপন্ন হতো আগ্রা ও দিল্লি অঞ্চলে। কিন্তু এ গম তাদের পেটে জুটত না। সাধারণ মানুষের খাদ্যতালিকায় তাদের উৎপন্ন গম থাকত না, বরং তাদের খেতে হতো চাল ও ডাল। বিশেষ করে আগ্রার শ্রমিকদের বর্ণনা প্রসঙ্গে ইতিহাসবিদরা বলেন, তাদের একঘেয়ে দৈনিক খাদ্যের মধ্যে অল্প একটু খিচুড়ি ছাড়া আর কিছু ছিল না। এটি তৈরি হয় কাঁচা ডালের সঙ্গে চাল মিশিয়ে। সন্ধ্যায় মাখন দিয়ে খাওয়া হয়। দিনের বেলা তারা অল্প শুকনো ডাল বা অন্য শস্য চিবোয়, যা তাদের ধারণা অনুযায়ী তাদের রোগা পেটের পক্ষে যথেষ্ট ছিল। খাদ্যশস্যের সঙ্গে গ্রামের চাষীরা খেতেন সাধারণত অল্প কিছু সবজি ও আনাজ। বাংলা, ওড়িশা, সিন্ধু বা কাশ্মীরের বেশির ভাগ লোক পাশাপাশি মাছ খেত। ধর্মীয় বাধানিষেধ (গো-হত্যা ও শুয়োর পালনের বিরুদ্ধে) ও দারিদ্র্যের দরুন চাষীরা মাংস খেতে পারতেন না বললেই চলে।

তবে মোগল আমলে মাথাপিছু ঘি উৎপাদন বেশি ছিল। আগ্রা অঞ্চলে, বাংলা ও পশ্চিম ভারতে প্রধান খাদ্যের সঙ্গে সবসময় ঘি থাকত। আসামের লোকের সঙ্গে আবার ঘির কোনো সম্পর্কই ছিল না। বস্তুটিকে তারা প্রচণ্ড ঘৃণার চোখে দেখত। কাশ্মীরের মানুষে পানি দিয়েই রান্না করত। আখরোট, তেল ও ঘি ছিল তাদের কাছে বড়লোকি ব্যাপার। তাভারনিয়ে বলেছেন, ‘ছোটো ছোটো গ্রামেও তরল মিষ্টিজাতীয় জিনিস পর্যাপ্ত পরিমাণে পাওয়া যেতো।’ এ থেকে এটা পরিষ্কার হয়, গ্রামগুলোয় মিষ্টির চাহিদা হিসেবে গুড় খাওয়ার রেওয়াজ ছিল। আবার লবণ খাওয়া নিয়ে ইতিহাসবিদ মোরল্যান্ড দেখিয়েছেন, বাংলায় নুন ছিল খুবই দুষ্প্রাপ্য ও দুর্মূল্য। বাংলার কোনো কোনো অংশে এবং আসামে মানুষ বাধ্য হয়ে ব্যবহার করত কলাগাছের গোড়া পুড়িয়ে এক ধরনের উৎকট বস্তু; এর মধ্যে অবশ্য কিছু পরিমাণ নুন পাওয়া যেত। গোলমরিচ কিংবা কাঁচালঙ্কা এখন যেকোনো পরিবারেই রান্নার জন্য ব্যবহার হয়, কিন্তু সে সময়ের মানুষ এর সঠিক ব্যবহার সম্পর্কে জানত না। পাশাপাশি অন্যান্য মসলা (জিরা, ধনে, আদা) কৃষকদের নাগালে ছিল।

কৃষকরা সাধারণত কী ধরনের কাপড় পরিধান করতেন সে সম্পর্কে অল্পস্বল্প জানা গেলেও কোনো রকম লজ্জাস্থান নিবারণ করার জন্য কৃষকের কাছে সামান্য পরিমাণ কাপড়চোপড় থাকত। পায়ে দেয়ার মতো তাদের কোনো জুতা বা স্যান্ডেল থাকত না। ফলে খালি পায়ে তারা চলাফেরা করতেন। মোগল আমলে হিন্দুস্তানে অর্থাৎ ‘বেরা থেকে বিহার’ পর্যন্ত এলাকায় কৃষকদের পরিধেয় বস্তু নিয়ে মোগল সম্রাট বাবুর মন্তব্য করেছেন, চাষী ও গরিব লোকেরা সম্পূর্ণ খালি পায়ে থাকে আর লঙ্গুটা দিয়ে লজ্জা নিবারণ করে। লঙ্গুটা নাভির নিচে বাঁধা দুই বিঘত পরিমাণ ঝোলা কাপড়। এ ঝোলা কাপড়ের গ্রন্থির নিচ থেকে আরেক টুকরো কাপড় দুই ঊরুর মাঝখান দিয়ে শক্ত করে বেঁধে রাখা হয়। মেয়েরাও লুঙ্গ নামে একধরনের কাপড় পরে, যার অর্ধেক কোমরে জড়ানো থাকে এবং বাকিটা মাথার ওপর তুলে দেয়া হয়। অন্যভাবে বলা যায়, পুরুষদের সবচেয়ে ছোটো ধুতি ও মেয়েদের একটি শাড়িই ছিল যথেষ্ট এবং তারা আর কিছুই পরত না। একইভাবে পরবর্তী শতকে আগ্রার এক ইংরেজ কুঠিয়াল মন্তব্য করেছেন, সাধারণ লোক এত গরিব যে তাদের বেশির ভাগই লিনেন কাপড় দিয়ে শরীরের গোপন অঙ্গ ঢাকা ছাড়া প্রায় নগ্ন হয়েই থাকে।

বেনারস সম্বন্ধে একই কথা বলতে গিয়ে ফিচ যোগ করেছেন, শীতকালে পশমের বদলে মানুষের পরিচ্ছদ ছিল আমাদের তোষক ও তুলো ভরা টুপির মতো একধরনের সুতি কাঁথার ঢোলা পোশাক। বাংলার মানুষ এর চেয়েও কম কাপড় পরিধান করত বলে মন্তব্য করেছেন আবুল ফজল। বিভিন্ন গ্রন্থে এটা উল্লেখ রয়েছে যে কাশ্মীরে সুতার কাপড় একেবারেই পরা হতো না; পুরুষ ও নারী উভয়ই ‘পাত্তু’ নামে গোড়ালি পর্যন্ত নেমে আসা একটি পশমের পোশাক না ধুয়ে তিন-চার বছর পরত। পুরোপুরি ছিঁড়ে না যাওয়া পর্যন্ত এটি গায়েই থাকত। গুজরাটের মেয়েদের জামাকাপড় ছিল কাঁধের ওপর বেল্টের মতো ঢিলা করে বাঁধা ও ছোট ব্রিচেসের ধরনের পায়ের মাঝে জড়ানো একটি লুঙ্গি আর একটি ছোট কাঁচুলি। তাদের জামাকপড় বলতে এ দুটোই এবং সবসময় তারা জুতো-মোজা ছাড়াই চলাফেরা করত। তুলা উৎপাদনকারী বিশাল মোগল দক্ষিণাঞ্চল সম্বন্ধে কোনো নির্দিষ্ট তথ্য না থাকলেও অবস্থা সম্ভবত সেখানেও ছিল একই রকম। আবার দক্ষিণ দিকে অর্থাৎ গোলকুণ্ডা ও দক্ষিণ ভারতের কাছাকাছি জামাকাপড়ের স্বল্পতা খুব বেশি করে চোখে পড়ত। কৃষকদের বাসস্থান নিয়ে পাওয়া তথ্যগুলোর ওপর দ্রুত চোখ বুলিয়ে নেয়া যায়। দেখা যায়, ভারতের বেশির ভাগ অঞ্চলের মতো বাংলার সাধারণ কুঁড়েঘরকে বলা হয়েছে খুবই ছোট ও খড় দিয়ে ছাওয়া। কাঠ, বাঁশ ও খড় দিয়ে কুঁড়েঘরই কৃষকদের কুঁড়েঘর। মাটি খুঁড়ে কাদার ভিতের ওপর দড়ি দিয়ে একসঙ্গে বাঁশ বেঁধে এগুলো তৈরি হতো। ওড়িশায় দেয়াল তৈরি হতো নলখাগড়া দিয়ে। বিহারে বেশির ভাগ বাড়িরই চাল ছিল টালির। দোআবে চাষীদের কুঁড়েগুলো কোনো রকমে খড়ে ছাওয়া ও মাটির দেয়াল দিয়ে ঘেরা বলে বর্ণনা করা হয়েছে। বলা হয়েছে, সিন্ধু নদীর তীরে গ্রামগুলোয় ছিল কাঠ ও খড়ের বাড়ি।

আজমীর প্রদেশে কৃষকরা তাঁবুর ধাঁচে তৈরি বাঁশের কুঁড়েতে বাস করতেন। সিরোঞ্জের (মালব) কাছাকাছি কৃষকরা বাস করতেন ছোট গোল কুঁড়ে ও ঝুপড়িতে। গুজরাটের বাড়িগুলোয় ছিল টালির চাল এবং প্রায়ই সেগুলো ইট ও চুন দিয়ে তৈরি হতো। আবার, খান্দেশ ও বিহারে কুঁড়েগুলোর দেয়াল ছিল মাটির ও খড়ে ছাওয়া। সে সময়ে কুঁড়েগুলো কোনো রকম স্থাপত্যকৌশল ছাড়াই সবচেয়ে সহজলভ্য জিনিস দিয়েই তৈরি হয়। এ থেকে বলা যায়, ব্যবহৃত উপাদান, জলবায়ু ও মাটিই এখনকার সব রকমের আঞ্চলিক বৈচিত্র্যের জন্য দায়ী।

কৃষকদের কুঁড়েঘর কিংবা ঝুপড়িতে তেমন কোনো আসবাব বা কোনো জিনিসপত্র ছিল না। পানি রাখার পাত্র, রান্না করার জন্য পাত্র ও স্বামী-স্ত্রীর দুটো বিছানা ছাড়া অন্য কোনো আসবাব ছিল না। অন্য একজন ইতিহাসবিদের বর্ণনা থেকে এ তথ্যও পাওয়া যায়, গৃহস্থালির সংক্ষিপ্ত তালিকার সঙ্গে রুটি সেঁকার জন্য একটি ছোট লোহার চুল্লিও ছিল।

 

সূত্র : বণিক বার্তা

Related Articles

Back to top button