নীতি সহায়তা বিদ্যুৎখাতের, লাভবান শুধু বেসরকারি উদ্যোক্তারা

গাজীপুর কণ্ঠ ডেস্ক : বিদ্যুৎকেন্দ্রের যন্ত্রাংশ আমদানিতে রয়েছে শতভাগ শুল্ক ও ভ্যাট অব্যাহতি সুবিধা। শতভাগ কর অবকাশ সুবিধাও রয়েছে ১৫ বছরের জন্য। এ নীতি সহায়তার সবটাই ভোগ করছে বেসরকারি বিদ্যুৎ কোম্পানিগুলো। এতে এ খাতের বেসরকারি উদ্যোক্তারা লাভবান হলেও এসব কেন্দ্র থেকে বেশি দামে বিদ্যুৎ কিনে লোকসানের অংক বড় করছে রাষ্ট্রায়ত্ত বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি)। এরই মধ্যে প্রতিষ্ঠানটির পুঞ্জীভূত লোকসান ৪২ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বেসরকারি উদ্যোক্তাদের নানা সুবিধা দেয়া হলেও তাদের কাছ থেকে বেশি দামেই বিদ্যুৎ কিনছে বিপিডিবি। এমনকি প্রতি বছর যে হারে বাজেটারি সাপোর্ট বা ভর্তুকি দেয়া হয়, তাতেও বাড়তি সুবিধা নেই বিপিডিবির। তবে নীতি সহায়তা কাজে লাগিয়ে ব্যবসা বড় করছে বেসরকারি কোম্পানিগুলো। আগে যে কোম্পানির একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র ছিল, ১০ বছরের ব্যবধানে একই কোম্পানি এখন একাধিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের মালিক।

বেসরকারি উদ্যোগে বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনে প্লান্ট ও ইকুইপমেন্ট আমদানিতে ১৯৯৭ সালে প্রথম শুল্কমুক্ত সুবিধা দেয় জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। একই সময়ে ছাড় দেয়া হয় মূল্য সংযোজন কর (মূসক) ও সম্পূরক শুল্কেও। পরবর্তী সময়ে ২০০০ সালে ছাড়ের তালিকায় যন্ত্রাংশকেও যোগ করা হয়। ২০০৫ সালে আরেক আদেশে বিদ্যুৎকেন্দ্রে ব্যবহূত যন্ত্রাংশের পাশাপাশি অন্যান্য পণ্যকেও ১৫ শতাংশের অতিরিক্ত শুল্ক থেকে অব্যাহতি দেয় এনবিআর। ২০১৫ সালে এটি আরো কমিয়ে ৫ শতাংশের অতিরিক্ত শুল্ক ও মূসক থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়। আয়করের ক্ষেত্রেও বেসরকারি খাতের বিদ্যুৎ কোম্পানিগুলোকে ১০ বছরের কর অবকাশ সুবিধা দেয় এনবিআর। ২০১৩ সালে দেয়া এ সুবিধার আওতায় বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরুর পর প্রথম পাঁচ বছর শতভাগ, পরবর্তী তিন বছর ৫০ শতাংশ ও শেষ দুই বছর ২৫ শতাংশ হারে এ সুবিধা দেয়া হয়। এতে কোম্পানিগুলোকে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু করার জন্য ২০১৫ সালের ১ জানুয়ারি পর্যন্ত সময়সীমা বেঁধে দেয়া হলেও পরবর্তী সময়ে তা বাড়িয়ে করা হয় ২০১৮ সালের জুন পর্যন্ত। সর্বশেষ জারি করা এসআরওর মাধ্যমে এটি বাড়িয়ে ২০১৯ সালের জুন পর্যন্ত করা হয়েছে। পাশাপাশি ১৫ বছরের জন্য শতভাগ কর অবকাশ সুবিধাও দেয়া হয়েছে। ফলে ২০৩৪ সাল পর্যন্ত কর অবকাশ সুবিধা পাচ্ছে বিদ্যুৎ কোম্পানিগুলো। তবে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কোম্পানির জন্য ১৫ বছরের শতভাগ কর অবকাশ সুবিধার পাশাপাশি বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরুর জন্য ২০২৩ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত সময় দেয়া হয়েছে।

তবে এ অব্যাহতি স্থায়ী নয় বলে জানান এনবিআর চেয়ারম্যান ও অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের জ্যেষ্ঠ সচিব মো. মোশাররফ হোসেন ভুঁইয়া। তিনি বলেন, বিদ্যুৎ দেশের সব শিল্পের সঙ্গে যুক্ত। উন্নয়নের জন্য বিদ্যুতের বিকল্প নেই। শিল্প উন্নয়নের পাশাপাশি ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে দিতে এ খাতে যেন বেসরকারি উদ্যোক্তারা এগিয়ে আসেন, সে লক্ষ্যে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। তবে এ অব্যাহতি স্থায়ী নয়, দেশে বিদ্যুতের চাহিদা পূরণ হলেই তা প্রত্যাহার করা হবে।

এদিকে বিদ্যুৎ খাতে এ সুবিধা কাজে লাগিয়ে ব্যবসা বড় করছে বেসরকারি বিদ্যুৎ কোম্পানিগুলো। দেশে পুঁজিলগ্নির বিপরীতে মুনাফায় এখন শীর্ষে রয়েছে বিদ্যুৎ খাত। উৎপাদন খাতের অন্য সব ব্যবসায় বিনিয়োগের বিপরীতে মুনাফা গড়ে ১৫ শতাংশের নিচে থাকলেও বিদ্যুতে তা ৩৫ শতাংশের বেশি। তালিকাভুক্ত বিদ্যুৎ কোম্পানিগুলোর আর্থিক প্রতিবেদনের তথ্যানুযায়ী, ২০১৭ সালে এ খাতে পুঁজিলগ্নির বিপরীতে গড়ে মুনাফার মার্জিন ছিল ৩৭ দশমিক ৬০ শতাংশ।

নীতি সহায়তা নিয়ে বিদ্যুৎ খাতের বেসরকারি উদ্যোক্তারা বড় অংকের মুনাফায় থাকলেও লোকসানের অংক বড় হচ্ছে বিপিডিবির। বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০১৮ অনুযায়ী, গত ১১ বছরে রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ কিনে বিপিডিবি লোকসান দিয়েছে ৪২ হাজার ৬১ কোটি টাকা। কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের সংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে লোকসানের পরিমাণও বেড়েছে। প্রতি বছর এ খাতে বড় অংকের ভর্তুকিও দিতে হচ্ছে সরকারকে।

বিপিডিবির তথ্যমতে, বর্তমানে দেশে উৎপাদনে আছে মোট ১২৫টি বিদ্যুৎকেন্দ্র। এর মধ্যে বিপিডিবির নিজস্ব বিদ্যুৎকেন্দ্রের সংখ্যা ৪১। বাকি ৮৪টিই ব্যক্তিমালিকানাধীন অথবা পাবলিক কোম্পানির মালিকানাভুক্ত, যেগুলো থেকে বিদ্যুৎ কিনছে বিপিডিবি। এর মধ্যে রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল ২৮টি এবং আইপিপি ও এসআইপিপি ৪৭টি। এসব বিদ্যুৎকেন্দ্রের ৫৪টিই জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করে ফার্নেস ও ডিজেল, যা সবচেয়ে ব্যয়বহুল। এসব বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ কিনতে বিপিডিবির ইউনিটপ্রতি ব্যয় হয় গড়ে ৬ টাকা ২৫ পয়সা। যদিও ফার্নেস অয়েল ও ডিজেল চালিত কিছু বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রতি ইউনিটের দাম ২৭ টাকা পর্যন্ত রয়েছে। এ দামে বিদ্যুৎ কিনে বিতরণ কোম্পানিগুলোর কাছে বিপিডিবিকে বিক্রি করতে হচ্ছে ৪ টাকা ৮৪ পয়সায়। ফলে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতে বিপিডিবির ঘাটতি থাকছে ১ টাকা ৪১ পয়সা। বিভিন্ন কোম্পানির কাছ থেকে কেনা বিদ্যুতের বিপরীতে প্রতি মাসে এ ঘাটতি দাঁড়ায় ৮০০ থেকে ১ হাজার কোটি টাকা, যা অর্থ মন্ত্রণালয়ের অনুদান পাওয়া ভর্তুকি থেকে পরিশোধ করে বিপিডিবি।

জানতে চাইলে বিপিডিবির চেয়ারম্যান প্রকৌশলী খালেদ মাহমুদ বলেন, অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে যে ভর্তুকি দেয়া হয়, সেটা দিয়ে আমরা বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের বকেয়া পরিশোধ করি। এখানে আমাদের অন্য কোনো সুবিধা নেই। তবে বর্তমানে যে মার্জিন আমাদের দেয়া হচ্ছে, সেটা বাড়ালে হয়তো বিপিডিবির আয় কিছুটা বৃদ্ধি পাবে।

লোকসান কমিয়ে আনার কৌশল হিসেবে ভর্তুকি চাহিদা বৃদ্ধির পাশাপাশি নিয়মিত ব্যবধানে বিদ্যুতের দামও বাড়ানো হচ্ছে। গত ১০ বছরে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে আটবার। এক দশক আগে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের গড় মূল্য ছিল ২ থেকে আড়াই টাকা। ২০১৭ সালের নভেম্বরে ঘোষিত সর্বশেষ মূল্যহার অনুযায়ী সেই দাম ঠেকেছে ৬ টাকা ২৫ পয়সায়।

তেলভিত্তিক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ না হলে এ অবস্থা চলতে থাকবে বলে জানান জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. এম শামসুল আলম। তিনি বলেন, পিডিবির যে সংকট, সেজন্য দায়ী মূলত তরল জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন বেড়ে যাওয়া। নিয়মিত ভর্তুকি বাবদ যে অর্থ দেয়া হয়, তা বেসরকারি কোম্পানিগুলোর পকেটেই যায়। বিতরণ ও হুইলিং চার্জই বিপিডিবির আয়ের উৎস। তেলভিত্তিক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ না হলে ভর্তুকির পরিমাণ বৃদ্ধিসহ বিদ্যুতের দাম বাড়তেই থাকবে।

 

সূত্র: বণিক বার্তা

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button