জাহালমকে কি পরিকল্পিতভাবে ফাঁসানো হয়েছে?
গাজীপুর কণ্ঠ ডেস্ক : দুদকের মামলায় বিনাদোষে ৩ বছর কারাভোগের পর মুক্তি পেয়ে জাহালম দুদকের বিচার দাবি করেছেন। প্রশ্ন উঠেছে– মামলায় নাম না থাকার পরও দুদকের তদন্তকারীরা কিভাবে জাহালমকে চার্জশিটভুক্ত করল?
হাইকোর্টের নির্দেশে জাহালম রবিবার রাতেই কাশিমপুর কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে তাঁর গ্রামের বাড়ি টাঙ্গাইলে চলে গেছেন। কাশিমপুর কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে জাহালম সেখানে উপস্থিত সাংবাদিকদের বলেন, ‘‘কোনো অপরাধ না করলেও দুদক আমাকে মিথ্যা মামলায় তিন বছর কারাগারে আটকে রেখেছে আমি দুদকের কঠিন বিচার চাই। তাদের কারণে আমি জেলখানায় অনেক কষ্টে দিন কাটিয়েছি। কারাগারের ওয়ার্ডে সেবকের কাজ-কর্ম করেছি এর আগে আমি দুদককে বলেছিলাম, আমি সালেক নই, আমি জাহালম। কিন্তু তারা তা বিশ্বাস করেনি।”
সোনালি ব্যাংকের প্রায় সাড়ে ১৮ কোটি টাকা জালিয়াতির অভিযোগে আবু সালেক নামে একজনের বিরুদ্ধে ৩৩টি মামলা হয়৷ এর মধ্যে ২৬টিতে জাহালমকে আসামি আবু সালেক হিসেবে চিহ্নিত করে অভিযোগপত্র দেয় দুদক। ২০১৬ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি দুদকের এসব মামলায় জাহালমকে গ্রেপ্তার করা হয়। জাহালম নরসিংদির একটি পাটকলের শ্রমিক। মামলার তদন্ত পর্যায়ে জাহালম দুদকের নোটিশ পেয়ে দুদক কার্যালয়ে কয়েকবার হাজির হয়ে জানান, তিনি জাহালম, একজন পাটকল শ্রমিক, তিনি আবু সালেক নন। তারপরও দুদক তাকে রেহাই দেয়নি। সরেজমিন তদন্তও করেনি৷ ঠিকানা দেখেই জাহালমের নামে চার্জশিট দিয়েছে।
ঘটনাটি সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশ হলে হাইকোর্টে রিট করেন আইনজীবী অমিত দাসগুপ্ত। হাইকোর্ট রবিবার সব মামলা থেকে জাহালমকে অব্যহতির আদেশ এবং তাঁকে ক্ষতিপুরণ দেয়ার নির্দেশ দেন।
অ্যাডভোকেট অমিত দাসগুপ্ত বলেন, ‘‘মামলার তদন্ত হয়েছে৷ কিন্তু সঠিক তদন্ত হয়েছে কিনা সেটাই এখন প্রশ্ন। এখানে তদন্তে অবহেলা থাকতে পারে। আবার উদ্দেশ্যমূলকভাবে জাহালমকে জড়িয়ে প্রকৃত আসামিকে আড়াল করারও চেষ্টা থাকতে পারে। সেটাই এখন তদন্ত করে দেখার বিষয়। ব্যাংক প্রকৃত তথ্য সরবরাহ করেছে কিনা, প্রকৃত অপরাধীরা কৌশলে নিরপরাধ ব্যক্তিকে ফাঁসিয়েছে কিনা– এসবই দেখার বিষয়। এই মামলায় প্রকৃত আসামি এখনো চিহ্নিত হয়নি। তারা আবু সালেককে জাহালম মনে করে চার্জশিট দিয়েছে।”
মামনবাধিকার কর্মী এবং আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সাবেক নির্বাহী পরিচালক নূর খান বলেন, ‘‘জাহালম যে বিনা অপরাধে তিন বছর জেল খেটেছেন তার দায়-দায়িত্ব দুদককেই নিতে হবে। কারণ, তারা একজন নির্দোষ ব্যক্তিকে অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করেছে৷ সঠিক তদন্ত করেনি। তাই এই তদন্তের সঙ্গে যারা জড়িত ছিলেন, দুদকের সেই তদন্ত কর্মকর্তাদের চিহ্নিত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে, যাতে আর কেউ জাহালমের মতো পরিণতি বরণ না করেন।”
দেশে জাহালমের ঘটনাই প্রথম নয়। এর আগেও নামের মিল থাকায় অথবা চেহারায় মিল থাকায় একাধিক ব্যক্তিকে বিনাদোষে জেল খাটতে হয়েছে। শুধু তাই নয়, একজনের পরিবর্তে আরেকজনের জেল খাটারও নজির আছে। অ্যাডভোকেট অমিত দাসগুপ্ত বলেন, ‘‘এর প্রধান কারণ তদন্তকারীদের অদক্ষতা। অন্য কারণও আছে। উদ্দেশ্যমূলকভাবেও করা হয়। যদি এটা এখনই প্রতিরোধ করা না হয়, তদন্তকাজে দক্ষ তদন্তকারীদের নিয়োগ দেয়া না হয়, তাহলে এরকম জাহালমের মতো ঘটনা আরো ঘটবে।”
সোনালী ব্যাংকের প্রায় সাড়ে ১৮ কোটি টাকা জালিয়াতির মামলাগুলো তদন্ত করেছেন দুদকের মোট ৯ জন কর্মকর্তা। দুদক এখনো তাদের কিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। এরইমধ্যে তাদের ৮ জন ‘পেশাগত দক্ষতার’ জন্য পদোন্নতিও পেয়েছেন। ওই ৯ কর্মকর্তার মধ্যে সহকারী পরিচালক সেলিনা আক্তার মনি এখন পদোন্নতি পেয়ে উপপরিচালক হয়েছেন। মেফতা হুল জান্নাত উপসহকারী পরিচালক থেকে পদোন্নতি পেয়ে সহকারী পরিচালক হয়েছেন। মাসুদুর রহমান সহকারী পরিচালক থেকে উপপরিচালক হয়েছেন। জয়নাল আবেদীন উপসহকারী পরিচালক থেকে সহকারী পরিচালক হয়েছেন। রাফি মো. নাজমুস সাদাত সহকারী পরিচালক থেকে উপপরিচালক হয়েছেন। এ এস এম সাজ্জাদ হোসেন সহকারী পরিচালক থেকে উপপরিচালক হয়েছেন। মো. সাইদুজ্জামান এবং সিলভিয়া ফেরদৌসও উপসহকারী পরিচালক থেকে সহকারী পরিচালক হয়েছেন। এছাড়া শেখ মেজবাহ উদ্দিন এখনো উপপরিচালক হিসেবেই আছেন।
সোমবার দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ সংবাদ মাধ্যমকে জানিয়েছেন, ‘‘অপরাধ না করেই জাহালমের তিন বছর কারাভোগের ঘটনায় দুর্নীতি দমন কমিশনের পরিচালক আবুল হাসনাত মোহাম্মদ আব্দুল ওয়াদুদকে প্রধান করে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।” তিনি বলেন, ‘‘শুধু দুদক এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত নয়৷ পুলিশ জাহালমকে গ্রেপ্তার করেছে. সব পক্ষকে সঙ্গে নিয়েই কাজ করা হবে. জাহালমের ঘটনায় যদি কারো গাফিলতি থাকে, তাহলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে.”
জাহালম বলেন, ‘‘আমি দুদক কর্মকর্তাদের অনেক বোঝানোর চেষ্টা করেছি। আমার চাকরির সব কাগজপত্র দিয়েছি। তারপরও তারা আমাকে অপরাধী বানিয়েছে। তাদের একটিই যুক্তি ছিল, আবু সালেকের সঙ্গে নাকি আমার ছবির কিছুটা মিল রয়েছে। তারা বলেছে, আমি ঢাকা কলেজে পড়াশুনা করেছি। আমি লেখাপড়াই জানি না। আমি যতই সত্য কথা বলি, ততই তারা বলেছে, আমি নাকি তথ্য গোপন করেছি। তারা আমার কোনো কথাই শুনতে চায়নি।” তিনি আরো বলেন, ‘‘আমি এর বিচার চাই। দুদকের বিচার চাই৷ প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমি বিচার চাই। আমি ক্ষতিপূরণ চাই৷ আমার মিলের চাকরি ফিরে পাবো কিনা জানি না।”
এদিকে হাইকোর্টের আদেশে জাহালমকে ক্ষতিপূরণ দেয়ার কথা বলা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে আইনজীবী অমিত দাসগুপ্ত বলেন, ‘‘ক্ষতিপূরণের পরিমাণ আদালতই ঠিক করে দেবেন।”
সূত্র: ডয়চে ভেলে