করোনার জাল সার্টিফিকেটের জমজমাট ব্যবসা
গাজীপুর কণ্ঠ ডেস্ক : দেশে করোনার জাল সার্টিফিকেটের জমজমাট ব্যবসা চলছে। গত এক সপ্তাহে করোনার সার্টিফিকেট জাল করে এরকম কয়েকটি চক্রের সদস্যদের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী গ্রেপ্তার করেছে। তাদের কাছ থেকে জাল সার্টিফিকেটও উদ্ধার করা হয়েছে।
এই চক্রগুলো করোনা নেগেটিভ এবং পজেটিভ দুই ধরনের জাল সার্টিফিকেটই তৈরি করে চাহিদা অনুযায়ী। তবে নেগেটিভ সার্টিফিকেটের চাহিদা বেশি।
সাধারণ চিকিৎসার জন্যও এখন হাসপাতালগুলো রোগী ভর্তি হতে গেলেই করোনা নেগেটিভ সার্টিফিকেট চায়। এই সার্টিফিকেট ছাড়া রোগী ভর্তি তো দূরের কথা অনেক সময় চিকিৎসাই দিতে চায়না তারা। এর বাইরে কর্মস্থল, পোশাক কারখানা এবং ভ্রমণের জন্য করোনা নেগেটিভ সার্টিফিকেট অনেকটা বাধ্যতামূলক হয়েছে। কিন্তু সাধারণভাবে করোনা টেস্ট এখানে সময় সাপেক্ষ এবং উপসর্গ ছাড়া পরীক্ষা করানো কঠিন। আর এই সুযোগ নিচ্ছে প্রতারক চক্র৷ তারা বিভিন্ন হাসপাতাল, করোনা টেস্টিং সেন্টারের সিল, চিকিৎসকের নাম, সাক্ষর এবং করোনা সার্টিফিকেটের স্টাইল জাল করে ভুয়া সার্টিফিকেট দিচ্ছে৷ তারা শুধু নেগেটিভ নয়, পজেটিভ সার্টিফিকেটও দিচ্ছে। পজেটিভ সার্টিফিকেট নিয়ে কেউ কেউ আবার অফিসে না গিয়ে বাসায় ছুটি কাটানোসহ নানা সরকারি সুবিধা নিচ্ছেন। ঢাকা শহরে এইসব সার্টিফিকেট বিক্রি হচ্ছে পাঁচ থেকে সর্বোচ্চ সাত হাজার টাকা।
ঢাকাসহ জেলা শহরের হাসপাতালগুলোকে কেন্দ্র করেই এই চক্র সবচেয়ে বেশি তৎপর। তারা হাসপাতাল এলকা থেকেই প্রধানত জাল সার্টিফিকেট ক্রেতাদের টার্গেট করে। এছাড়া পোশাক কারখানা এলাকায়ও তাদের তৎপরতা আছে।
ঢাকার ব়্যাব-৩ এর সদস্যরা সোমবার বিকেলে মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এলাকা থেকে করোনা সার্টিফিকেট জালকারী এইরকম একটি চক্রের চার সদস্যকে আটক করেছে। তারা হলো: ফজল হক, মো. শরিফ হোসেন, মো. জামশেদ ও মো. লিয়াকত আলী ৷ তাদের কাছ থেকে করোনার বেশ কিছু জাল সার্টিফিকেট, দুইটি কম্পিউটার, দুইটি প্রিন্টার ও দুইটি স্ক্যানার উদ্ধার করেছে র্যাব। ওই চক্রটি এরইমধ্যে করোনার দুই শতাধিক জাল সার্টিফিকেট বিক্রির কথা স্বীকার করেছে।
ব়্যাব-৩ এর অধিনায়ক লে. কর্নেল রকিবুল হাসান জানান, ‘‘এখন যারা জরুরি প্রয়োজনে দেশে বাইরে যান তারাও এই জাল নেগেটিভ সার্টিফিকেট কেনেন। এই জালিয়াত চক্র হাসপাতাল ও টেস্টিং সেন্টার এলাকা ছাড়াও অনলাইনে তৎপর। তারা অনলাইনে করোনা সার্টিফিকেটের নানা ধরনের অফার দেয়।’’ এই ধরনের চক্র শুধু ঢাকায় নয়, ঢাকার বাইরেও তৎপর বলে জানান তিনি। ঢাকায় এই সার্টিফিকেট জরুরি ভিত্তিতেও বিক্রি হয়৷ দাম পড়ে বেশি।
এর আগে ৬ জুন সাভার এলাকা থেকে আটক করা হয় দুইজনকে। তারা পোশাক শ্রমিকদের কাছে করোনা নেগেটিভ ও পজেটিভ সার্টিফিকেট বিক্রি করে আসছিলো। পোশাক কারখানার শ্রমিকরা করোনা পজেটিভ হলে তাদের কোয়ারিন্টেনে পাঠানো হয়। কোয়ারিন্টিনের সময় তারা বেতন নাও পেতে পারেন এই ভয়ে কোনো কোনো পোশাক শ্রমিক প্রতারকদের কাছ থেকে জাল সার্টিফিকেট কেনেন। আবার করোনা হলে চাকরি হারানোর ভয়ও আছে।
সাভারের ডেনিটেক্স নামে একটি পোশাক কারখানায় করোনা নেগেটিভের কয়েকটি সার্টিফিকেট নিয়ে সন্দেহ দেখা দিলে তারা সাভার পুলিশকে জানায়। এরপর যারা সার্টিফিকেট নিয়েছে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশ করোনার জাল সার্টিফিকেটের ব্যাপারে নিশ্চিত হয়। তাদের কাছ থেকে তথ্য নিয়ে পুলিশ আবু সাঈদ ও রাজু নামে দুইজনকে সাভারের গেন্ডা এলাকা থেকে আটক করে। সাঈদ আগে সাভার উপেজলা স্বাস্থ্য কেন্দ্রে আউট সোর্সিং-এ স্বাস্থ্যকর্মীর কাজ করতো। তার একটি ওষুধের দোকান আছে৷ তাদের কাছ থেকেও জাল সার্টিফিকেট এবং সার্টিফিকেট তৈরির সরঞ্জাম উদ্ধার করা হয়।
তাদের আটকারী সাভার থানার সাব ইন্সপেক্টর হামিদুর রাহমান জানান, ‘‘সাঈদ নিজেকে ডাক্তার বলে পরিচয় দেয়। পোশাক শ্রমিকরা ছয়-সাত জন এক সঙ্গে থাকেন। তাদের কেউ একজন করোনা আক্রান্ত হলে কাজের জন্য বাকিদের করোনা নেগেটিভ সার্টিফিকেট লাগে। তাদের কাছেই সাঈদ এই সার্টিফিকেট বিক্রি করতো।’’ করোনা আক্রান্ত হলে কোনো কোনো পোশাক কারখানা ছুটির সাথে প্রণোদনাও দেয়। তাই কিছু পোশাক শ্রমিক সেই সুবিধা নিতে করোনা পজেটিভ সার্টিফিকেটও কেনেন। চক্রটি দুই ধরনের জাল সার্টিফিকেট বিক্রির কথাই স্বীকার করেছে বলে জানান এই পুলিশ কর্মকর্তা। তবে পোশাক কারখানা এলাকায় জাল সার্টিফিকেটের দাম কম৷ সর্বোচ্চ এক হাজার টাকা।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ এবং প্রিভেনটিভ মেডিসিন-এর চিকিৎসক ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, ‘‘এর আগে আমরা দেখেছি বিমানবন্দরে জাপান যাওয়ার পথে এক বাংলাদেশি যাত্রী করোনার ভুয়া নেগেটিভ সার্টিফিকেট নিয়ে ধরা পড়েছেন। তাকে ফেরত পাঠানো হয়েছে৷ তার কারণে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হয়েছে। আর দেশের অভ্যন্তরে এই ধরনের জল সার্টিফিকেট চরম ক্ষতির কারণ হচ্ছে। দেখা যাবে করোনা রোগী এই সার্টিফিকেট নিয়ে দিব্যি অফিস করছেন, ঘুরে বেড়াচ্ছেন, করোনা ছাড়াচ্ছেন।’’
তবে এজন্য সরকারের নীতিকেও দায়ী করেন তিনি৷ আর সাধারণ রোগের চিকিৎসায়ও করোনা নেগেটিভ সার্টিফিকেটের যে রেওয়াজ চালু হয়েছে তাও এই জাল জালিয়াতির জন্য দায়ী। ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন,‘‘করোনা সার্টিফিকেট যদি প্রয়োজনই হয় তাহলে তা সরকার কেন্দ্রীয়ভাবে দেয়ার নিয়ম চালু করতে পারে। আর আজকে কেউ করোনা নেগেটিভ তার মানে এই নয় যে তার করোনার পজেটিভ হওয়ার আর কোনো সম্ভাবনা নাই।”
প্রসঙ্গত, বাংলাদেশে করোনার প্রাথমিক পর্যায়ে মার্চ মাসের দিকে বিদেশ থেকে আসা যাত্রীদের কাছে বিমানবন্দরে করোনা নেগেটিভ সার্টিফিকেট বিক্রির অভিযোগ ছিলো। জাল নয়, টাকার বিনিময়ে আসল সার্টিফিকেট বিক্রিরই অভিযোগ ওঠে তখন। যাত্রীরা বাধ্যতামূলক কোয়ারিন্টিন এড়াতে বিমানবন্দরে দায়িত্বরত অসাধু কর্মকর্তাদের কাছ থেকে টাকার বিনিময়ে এই সার্টিাফিকেট নিতেন বলে অভিযোগ।
সূত্র: ডয়চে ভেলে