হুমায়ূন আহমেদ, যিনি অমৃতকে ধারণ করেছিলেন

গাজীপুর কণ্ঠ ডেস্ক : হুমায়ূন আহমেদের ‘বাদশা নামদার’ পড়ছিলাম, আর বারবার চোখ পানিতে ঝাপসা হয়ে আসছিলো। আমি নিজে ইতিহাসের ছাত্র। আর ইতিহাসের ছাত্ররা হয় একটু কাঠখোট্টা ধরণের। ইতিহাসের নিষ্ঠুরতা পড়তে পড়তে তার ছাপ তাদের হৃদয়েও পড়ে। পড়তে গিয়ে মনে হয় এটাই স্বাভাবিক। অথচ উল্টোটা হয় হুমায়ূন আহমেদের ‘বাদশা নামদার’ পড়তে গিয়ে। বারবার পড়তেও ইচ্ছে করে, অথচ যতবার পড়ি ততবারই চোখ ভিজে যায়। কেন যে যায়!

সম্রাট হুমায়ূন পারস্যের শাহ’র কব্জায়। তাকে গৃহবন্দি করা হয়েছে। একদিন শাহ হুমায়ূনকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আল্লাহ কোথায় বাস করেন?’

সম্রাট হুমায়ূন উত্তর দিলেন, ‘তিনি বাস করেন ব্যথিত মানুষের হৃদয়ে।’

হুমায়ূনের ভাষায় সম্রাট হুমায়ূনের এই উক্তি পড়তে গিয়ে নিজেকে প্রশ্ন করি, এই যে হৃদয় বাষ্পীভূত হয়, চোখ ভিজে যায় তবে কি আমিও ব্যথিত? আমার হৃদয়ে কি খোদা বাস করেন?

শাহ’র প্রশ্নে সম্রাট হুমায়ূন কোনো জবাব দেননি। জানি, আমার এ প্রশ্নেরও কোনো জবাব নেই।

হুমায়ূন আহমেদের ‘বাদশা নামদার’ যারা পড়েছেন, তাদের ইতিহাসের লিখনশৈলি বিষয়ে ধারণাই বদলে যাবে। তারা ভেজা চোখে ভাববেন এভাবেও ইতিহাস লেখা যায়! বিস্ময় তাদের মগজে স্থায়ী বাসা বাঁধবে।

ইতিহাসেও সাহিত্য করা সম্ভব এবং সম্ভবত তা শুধু হুমায়ূন আহমেদের পক্ষেই। তিনি যখন সম্রাট হুমায়ূনের ছোট ভাই মীর্জা কামরানকে উদ্ধৃত করে শের শোনান। বলেন,

‘গর্দিশে গরদূনে গরদ না রা দর্গ কর্দ

বর সরে আহলে তমীজা ওয়া নাকি সারা মর্দ কর্দ’

‘ললাটের এমনই লিখন যে সে শ্রেষ্ঠজনকে মাটিতে মেশায় যোগ্যদের মাথার উপর অযোগ্যদের বসায়।’

তখন মনে হয় না ইতিহাস পড়ছি নাকি সাহিত্য। বিষয়ের বিষয়টি মাথা থেকে উধাও হয়ে যায়, শুধু জেগে থাকে এক বিস্মিত অনুভূতি। এক মোহময়তা।

ইতিহাস শুধু নিষ্ঠুরতাই নয়, ভালোবাসারও। ইতিহাসের অন্য পাঠে তা না বোঝা গেলেও হুমায়ূন আহমেদের ‘বাদশা নামদার’ তা বুঝিয়ে দেয়। কিভাবে, সেটা জানি হুমায়ূনের ভাষাতেই-

“এখন মধ্যরাত্রি বহু বছর আগের একটি ঘটনার পুনরাবৃত্তি হচ্ছে। হুমায়ূনের বিছানার চারপাশ দিয়ে হামিদা বানু হাঁটতে হাঁটতে বলছেন, আমার প্রাণের বিনিময়ে হে আল্লাহ্পাক তুমি সম্রাটের জীবন ভিক্ষা দাও।

চতুর্থবার ঘূর্ণন শেষে করে হামিদা বানু চমকে তাকালেন, হুমায়ূন চোখ মেলে তার দিতে তাকিয়ে আছেন। মায়াময় হাসি হাসি চোখ। হুমায়ূন বললেন, ‘হামিদা! বিড়বিড় করে কী বলছ?’ হামিদা বানু ছুটে এসে সম্রাটকে জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘কিছুক্ষণ আগে খবর এসেছে বৈরাম খাঁ সিকান্দর শাহ্কে পরাজিত করে দিল্লী দখল করেছেন। আপনি এখন হিন্দুস্থানের সম্রাট।”

মৃত্যুপথযাত্রী সম্রাট হুমায়ূনকে বাঁচাতে তার বেগম হামিদা বানু’র আকুলতার যে বর্ণনা এবং ভাষা, তাতে কি মনে হয় না, এর চেয়ে ভালোবাসার ধ্রুপদী একই সাথে সরল বর্ণনা আর হয় না, হওয়া সম্ভব নয়।

নিশ্চিত মৃত্যু থেকে রক্ষা পেয়ে হুমায়ূন দিল্লীর সিংহাসনে বসেছেন। ছোট ভাই মীর্জা কামরানকে তার প্রাপ্য মৃত্যুদণ্ড মাফ করা হয়েছে সম্রাটের নির্দেশে। তবে কামরানের চোখ অন্ধ করে দেয়া হয়েছে। যাতে সে আবার বিদ্রোহ করতে না পারে। কামরান এর আগে হুমায়ূনের সাক্ষাত চাইলেন। কিন্তু কামরানকে দেখলে তাকে মাফ করে দিতে পারেন এমন সম্ভাবনায় সম্রাটের সাথে তার দেখা করানো হয়নি।

অন্ধ কামরান মক্কায় চলে যাবেন। পরেরটুকু বলছি হুমায়ূন আহমেদের ভাষায়-

“মক্কা যাওয়ার দিন কামরানের সঙ্গে হুমায়ূনের দেখা হলো। কামরান তাঁর কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করলেন এবং নিজের একটি কবিতা আবৃত্তি করার অনুমতি প্রার্থনা করলেন।

সম্রাট বললেন, ‘ভাই, তুমি কবিতা পড়ো।’

মীর্জা কামরান দীর্ঘ কবিতা আবৃত্তি করলেন।

কবিতাটির শুরু এরকম-

‘মাটির ভাণ্ডে অমৃত ধারণ করা যায় না।

আমি মীর্জা কামরান মাটির ভাণ্ড ছাড়া কিছু না।

আমি গরল ধারণ করতে পারি

অমৃত কখনো না।

হুমায়ূন স্বর্ণভাণ্ড

তিনি একারণেই হৃদয়ে অমৃত

ধারণ করতে পেরেছেন।…”

‘বাদশা নামদারে’র এ অংশটি উদ্ধৃত করলাম কারণ হলো, আমাদের সাহিত্যসম্রাট হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে অনেকে অনেক কথা বলেন। তার লেখা জনপ্রিয় কিন্তু ধ্রুপদী সাহিত্য বলতে যা বোঝায় সে রকম নয়, এমন কথা প্রায়ই শুনি। যারা বলেন মূলত তাদের জন্যেই এই অংশটি উদ্ধৃত করা। মীর্জা কামরানের ভাষায় আমিও বলি, আমাদের হুমায়ূন স্বর্ণভাণ্ড। যারা তার সাহিত্যকে ধ্রুপদী বলেন না তারা মাটির ভাণ্ড। অমৃতকে ধারণ করার ক্ষমতা তাদের নেই। সেই ক্ষমতা আমাদের হুমায়ূনের রয়েছে এবং তিনি অমৃতকেই ধারণ করেছিলেন, করেছেন।

মৃত্যুদিনে খোদার কাছে প্রার্থনা আপনার জন্য প্রিয় হুমায়ূন আহমেদ। আপনি মানুষকে আনন্দ দিয়েছেন। আনন্দে চোখ ভেজানোর যে ক্ষমতা তাকে ছোট করে দেখার ধৃষ্ঠতা শুধু অজ্ঞরাই করতে পারে। মীর্জা কামরান অন্ধ হয়ে বুঝেছিলেন আলোর প্রয়োজনীয়তা। তাই হুমায়ূনকে তার কবিতায় এভাবে চিত্রিত করতে পেরেছিলেন। আমাদের অজ্ঞদের অন্ধ হওয়ারও ক্ষমতা নেই। রবি ঠাকুরের ভাষায় তাদের জন্য প্রার্থনা, ‘অন্ধজনে দেহো আলো, মৃতজনে দেহো প্রাণ–. তুমি করুণামৃতসিন্ধু করো করুণাকণা দান।’

হুমায়ূন আপনি রয়েছেন আরেক ভুবনে। সেখানেও আপনি নিশ্চয়ই আনন্দে থাকবেন। আর অজ্ঞরা এ ভুবনে জ্বলবেন ঈর্ষার নরকে।

 

লেখক : প্রাবন্ধিক, লেখক ও সাংবাদিক কাকন রেজা।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button