করোনার ‘বিদায় সংবর্ধনা’ দেয়ার সব আয়োজনই সম্পন্ন!

গাজীপুর কণ্ঠ ডেস্ক : বাংলাদেশে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছাড়া সবই খুলে গেছে। সেপ্টেম্বরে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও খুলে দেয়ার প্রস্তুতি চলছে। অথচ করোনার সংক্রমণ কিন্তু কমছে না। বরং বাড়ছে। কিন্তু টেস্ট কমিয়ে দেয়া হয়েছে।

মৃত্যুহারও অন্তত এক মাস ধরে একই রকম আছে। পাশাপাশি প্রত্যন্ত অঞ্চলে করোনা ছড়িয়ে পড়ছে। স্বাস্থ্যবিধি মানা নিয়ে নানা কথা হলেও তা লোকজন তেমন মানছেন না। আর গণপরিবহণে স্বাস্থ্যবিধি না মানায় পরিবহণ মালিকরা এখন বাস বোঝাই করে যাত্রী নেয়ার অনুমতি চাচ্ছেন। যদিও বাস্তবে তা-ই নিচ্ছেন। ভাড়া নিচ্ছেন অর্ধেক সিট খালি রাখার সেই পুরনো শর্তে দ্বিগুণ। টেস্ট কমানোর পর করোনা হাসপাতালও কমিয়ে দিতে চাইছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেছেন, ‘‘বাংলাদেশে ভ্যাকসিন লাগবে না। করোনা এমনিতেই চলে যাবে৷ সংক্রমণ অনেক কমে গেছে।’’

করোনাকে বাংলাদেশে ‘বিদায় সংবর্ধনা’ দেয়ার সব আয়োজনই যেন সম্পন্ন। তারপরও প্রশ্ন থেকে যায়, স্বাস্থ্যমন্ত্রণালয় বিদায় সংবর্ধনা দিতে পারে, কিন্তু করোনা কি বিদায় নেবে?

এরইমধ্যে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের করোনা ব্রিফিং বন্ধ হয়ে গেছে। জাতীয় টেকনিক্যাল কমিটি অবশ্য এর বিরোধিতা করেছে। এখন শুধু সংবাদবিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয় স্বাস্থ্য অধিপ্তরের ওয়েব সাইটে। তাদের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, বৃহস্পতিবারও ২৪ ঘণ্টায় সারাদেশে করোনায় মারা গেছেন ৪১ জন। আর এ পর্যন্ত করোনায় মোট মারা গেছেন তিন হাজার ৮২২ জন। ২৪ ঘণ্টায় ১৪ হাজার ৫৯টি নমুনা পরীক্ষা করে দুই হাজার ৮৬৮ জন শনাক্ত হয়েছেন। এ পর্যন্ত মোট শনাক্ত হয়েছেন দুই লাখ ৮৭ হাজার ৯৫৯ জন।

বাংলাদেশে করোনায় আক্রান্ত হয়ে প্রথম রোগীর মৃত্যু হয় গত ১৮ মার্চ, প্রথম রোগী শনাক্ত হয়েছিল গত ৮ মার্চ। এখন পর্যন্ত মোট নমুনা পরীক্ষা হয়েছে ১৪ লাখ সাত হাজার ৫৫৬টি।

বৃহস্পতিবার ২৪ ঘণ্টায় শনাক্তের হার ২০ দশমিক ৪ শতাংশ এবং এ পর্যন্ত শনাক্তের হার ২০ দশমিক ৪৬ শতাংশ। শনাক্ত বিবেচনায় সুস্থ হয়ে ওঠার হার ৫৮ দশমিক ৬৯ শতাংশ এবং মৃত্যুর হার ১ দশমিক ৩৩ শতাংশ৷বর্তমানে কোয়ারান্টিনে আছেন ৪৭ হাজার ৭৬৪ জন। আইসোলেশনে আছেন ৬৫ হাজার ৩৬ জন।

স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যই বলছে বাংলাদেশ এখনো করোনা কমার কোনো লক্ষণ নেই। বরং টেস্ট কম করার পরও সংক্রমণ বাড়ছে। এখনো নির্ভরযোগ্য জরিপ হয়নি। অ্যান্টিবডি টেস্ট শুরু হয়নি।

বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ)-র মহাসচিব অধ্যাপক ডা. এহতেশামুল হক চৌধুরী বলেন, ‘‘স্বাস্থ্যমন্ত্রী কিসের ভিত্তিতে বললেন যে বাংলাদেশ থেকে করেনা চলে গেছে আমরা তা জানি না। আমাদের কাছে বিজ্ঞানভিত্তিক কোনো তথ্য নেই যে বলবো করোনা কমছে। মন্ত্রীর মতো কথা বললে চলবে না। আমাদের কথা বলতে হবে তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে। আর সেজন্য যে গবেষণা প্রয়োজন তা এখানে হয়নি।’’

বাংলাদেশে ছোট একটি গবেষণা হয়েছে। আইইডিসিআর এবং আইসিডিডিআর,বি করেছে। ঢাকায় ১২ হাজার মানুষের ওপর তারা গবেষণা করেছে। তাতে দেখা গেছে, ঢাকার শতকরা ৯ ভাগ মানুষ করোনায় আক্রান্ত। ঢাকার ১২ হাজার মানুষের মধ্যে জরিপ করে সিদ্ধান্তে আসা যায় না বলে মনে করেন এই চিকিৎসক।

বাংলাদেশে ২৫ মার্চ থেকে করোনা প্রতিরোধে সাধারণ ছুটি দেয়া হয়। এরপর তা বাড়িয়ে বাড়িয়ে ৩১ মে পর্যন্ত করা হয়। তারপর সব কিছু ধীরে ধীরে খুলে দেয়া হয়। যদিও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত সাধারণ ছুটি বহাল আছে।

করোনা নিয়ে সবচেয়ে জটিল অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল পোশাক কারখানায়। বারবার নানা ধরনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। সাধারণ ছুটি প্রত্যাহারের পর করোনার হটস্পট চিহ্নিত করে লকডাউনের কাজও করা হয়। ঢাকার পূর্ব রাজাবাজার এবং ওয়ারীসহ ঢাকার বাইরে কয়েকটি এলাকায় ঢাকঢোল পিটিয়ে ২১ দিনের লকডাউন করা হলেও তার ফল অজানা। আর এখন সেটাও করা হচ্ছে না।

ডা. এহতেশামুল হক চৌধুরী বলেন, ‘‘সব কিছু স্বাভাবিক হয়নি, স্বাভাবিক করা হচ্ছে নির্দেশ দিয়ে। আমাদের কাছে করোনা কমার কোনো তথ্য নেই। আমরা করোনায় শুধু উল্টো পথে নয়, আমাদের সামনে বিপর্যয় অপেক্ষা করছে। শীত আসছে। পরিস্থিতি কী হয় বলা যায় না।’’

করোনা ব্যবস্থাপনায় চিকিৎসক এবং জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের কোনো মতামত নেয়া হচ্ছে না। তারা কোনো মতামত দিলে তা উপেক্ষা করা হচ্ছে-এমন অভিযোগও রয়েছে। জাতীয় টেকনিক্যাল কমিটিকে নামে মাত্র রাখা হয়েছে। সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন আমলারা। ১৮ আগস্ট স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় নতুন একটি কমিটি করেছে যার নাম ‘করোনা ভাইরাস প্রতিরোধ ও স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতকরণ গ্রুপ’৷ এই কমিটিতে কোনো চিকিৎসক বা জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ নেই৷ সবাই আমলা।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেনিন চৌধুরী মনে করেন, ‘‘করোনা নিয়ে এ পর্যন্ত যতগুলো সিদ্ধান্ত হয়েছে তার কোনোটিই সঠিকভাবে বাস্তবায়ন হয়নি। আমাদের যখন যেটা করা প্রয়োজন সেটা করিনি৷ করেছি উল্টোটা।’’

তিনি বলেন, ‘‘গবেষণায় দেখা গেছে শুধু ঢাকায় করোনা সংক্রমিত রোগী ১৮ লাখ। তাহলে সারাদেশে কত? আমি ধারণা করি এখন টেস্ট কমিয়ে রোগী কম দেখানোর একটা প্রবণতা আছে। কিন্তু তাতে কি করোনা দূর হবে?’’

তার মতে, কার্যকর প্রতিরোধ ব্যবস্থা না নেয়ায় বাংলাদেশে করোনা প্রলম্বিত হবে। পৃখিবীর বিভিন্ন দেশে করোনা পিক-এ গিয়ে তারপর নেমে এসেছে। কিন্তু বাংলাদেশে দীর্ঘ সময় ধরে সংক্রমণ একই আছে, কমছে না। মানুষের দুর্ভোগ বাড়ছে। এটা বিপর্যয়ের দিকে যেতে পারে বলে তিনি মনে করেন।

 

সূত্র: ডয়চে ভেলে

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button