প্রতারিত প্রবাসীরা কারাগারে, প্রতারকদের মুক্ত জীবন ?

গাজীপুর কণ্ঠ ডেস্ক : দেশে ফেরত আসা ৮৩ জন প্রবাসীকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে বিদেশে বাংলাদেশের ‘ভাবমূর্তি’ ক্ষুন্ন করার অভিযোগে। তাদের ‘অপরাধ’ তারা প্রতারিত হয়ে প্রতিবাদ করেছেন। কিন্তু প্রতারক দালালদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।

যে ৮৩ জনকে মঙ্গলবার কারাগারে পাঠানো হয়েছে তাদের মধ্যে ৮১ জন ভিয়েতনাম ফেরত। আর দুই জন কাতার ফেরত। কারাগারে পাঠনোর আগে ১৪ দিন তাদের ঢাকার তুরাগের দিয়াবাড়ির কোয়ারান্টিন সেন্টারে রাখা হয়। ভিয়েতনাম থেকে আসা আরো ২৫ জনকে অবশ্য ছেড়ে দেয়া হয়েছে। গত ১৮ আগস্ট একটি বিশেষ বিমানে করে ভিয়েতনাম থেকে ১০৬ জন বাংলাদেশে আসেন। এরপরই তাদের কোয়ারান্টিনে নেয়া হয়।

প্রবাস ফেরত ৮৩ জনের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট কোনো মামলা হয়নি, ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। তবে তাদের বিরুদ্ধে একটি সাধারণ ডায়েরি করা হয়েছে তুরাগ থানায়। তাতে বলা হয়েছে, এই প্রবাসীরা বিভিন্ন অপরাধে সাজাপ্রাপ্ত হয়ে বিদেশের কারাগারে আটক ছিলেন। তারা সেখানে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করেছেন।

বাংলাদেশের অভ্যন্তরেও তারা নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়তে পারেন। জিডিতে আরো অভিযোগ করা হয়েছে যে, তারা দেশে আসার পর কোয়ারান্টিন সেন্টারে বসে গ্রুপ ভিত্তিক রাষ্ট্র ও সরকারবিরোধী কর্মকাণ্ড, ধ্বংসাত্মক কাজ ও কর্মসূচির পরিকল্পনা করছিল। তাদের ছেড়ে দেয়া হলে বা জামিন পেলে তারা পলাতক হয়ে দেশের মধ্যে ডাকাতি, দস্যুতা, খুন, পারিবারিক সহিংসতা ও জঙ্গি নাশকতামূলক অপরাধে জড়িয়ে পড়তে পারে।

অবশ্য এইসব অভিযোগের ব্যাপারে যে ২৫ জনকে কারাগারে পাঠানো হয়নি তাদের একজন রাজু আহমেদ জানান, ‘‘ভিয়েতনামে আমাদের কেউই কোনো অপরাধে যুক্ত ছিলাম না। কারাগারেও ছিলাম না। আমাদের অপরাধ, আমরা প্রতারিত হয়ে ভিয়েতনামে বাংলাদেশি দূতাবাসে অভিযোগ জানাতে গিয়েছিলাম। আমাদের মধ্যে কেউ কেউ দূতাবাসের সামনের রাস্তায় অবস্থান নেয়। কেউ কেউ জোরালো প্রতিবাদ জানায়। আমাদের মধ্য থেকে বছাই করে ৮১ জনকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। আর কোয়ারান্টিন সেন্টারে বসে আমরা কখন ছাড়া পেয়ে বাড়ি যাব তার জন্য ব্যাকুল ছিলাম। আমরা সরকারবিরোধী কাজের পরিকল্পনা করলাম কখন!’’

তিনি অভিযোগ করেন, সাত মাস আগে দালালকে সাড়ে চার লাখ টাকা দিয়ে ভিয়েতনাম যান৷ তাদের বিএমইটি কার্ডও ছিলো৷ তারপরও কোনো চাকরি বা কাজ তারা পাননি। উপরন্তু তাদের ছোট ছোট কক্ষে এক সঙ্গে রেখে নির্যাতন করা হয়েছে৷ খাবার দেয়া হয়নি। সেই বাংলাদেশি দালালরা এখনো ভিয়েতনামে আছে। দূতাবাস তাদের চেনে। তিনি বলেন, ‘‘প্রতারক দালালদের গ্রেপ্তার না করে নিরীহ প্রবাসীরা দেশে ফেরার পর তাদের জেলে পাঠানো হলো। এর চেয়ে অবিচার আর কি হতে পারে!’’

যাদের কারাগারে পাঠানো হয়েছে তাদের একজন ইসমাইল হোসেন। তার স্ত্রী ফায়েজা বেগম বলেন, ‘‘আমাদের টাকা গেল, আমার স্বামী জেলেও গেল। কোয়ারান্টিন শেষে তার ১ তারিখ (১ সেপ্টেম্বর) বাড়ি আসার কথা ছিলো। কিন্তু জেলে পাঠানোর খবর শুনে আমরা শ্বশুর শ্বাশুড়ি অসুস্থ হয়ে পড়েছেন।’’

তিনি কান্না জড়িত কন্ঠে জানান, ‘‘আমার স্বামী দেশে ভালোই ছিলেন। সাত মাস আগে দালালের প্রলোভনে সাড়ে চার লাখ টাকা খরচ করে বিদেশে যান। সেখানে কোনো কাজ পাননি। তাকে কাজ না দিয়ে যে নির্যাতন করা হয়েছে তার ভিডিও আগেই আমাকে পাঠিয়েছেন। এই সাত মাস দুইটি সন্তান নিয়ে আমি বড় কষ্টে ছিলাম। এখন স্বামীকে জেলে পাঠানো হলো। কার কাছে এর বিচার আমি পাবো? আমার স্বামীকে কীভাবে ছাড়িয়ে আনব?’’

প্রবাসীদের বিরুদ্ধে জিডিটি করেছেন তুরাগ থানার সাব ইন্সপেক্টর (এসআই) মো. আনোয়ারুল ইসলাম ১ আগস্ট। তিনিই জিডিটির তদন্ত করছেন। তিনি জিডিতি দাবি করেন, ‘‘এই প্রবাসীরা দিয়াবাড়ি কোয়ারান্টিন সেন্টারে বসে রাষ্ট্র ও সরকার বিরোধী কাজের পরিকল্পনা করছিল বলে সন্দেহ হয়েছে। গোপন সূত্রে আমি এই তথ্য পাই। তাই তাদের গ্রেপ্তার করে ৫৪ ধারায় কারাগারে পাঠিয়েছি।’’ তারা কী ধরনের পরিকল্পনা করছিল জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘‘সেটা তদন্তে জানা যাবে। এখন আর কানো তথ্য আমার কাছে নাই।’’

তুরাগ থানার ওসি( তদন্ত) মো. শফিউল্লাহকে ফোন করলে তিনি বলেন, ‘‘৫৪ ধারায় আটক করা হয়েছে এইটুকু আমি জানি। এর বাইরে আমার কিছু জানা নাই। সব কিছু জানেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা(এসআই মো. আনোয়ারুল ইসলাম)।’’

মানবাধিকার বিষয়ক সংস্থা আইন ও সালিস কেন্দ্র(আসক) এই প্রবাসীদের আইনগত সহায়তা দিচ্ছে। আসকের সিনিয়র সমন্বয়কারী আবু আহমেদ ফয়জুল কবীর জনান, তারা মঙ্গলবারই তাদের জামিন আবেদনের প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। কিন্তু তাদের আদালতে হাজির না করে সরাসরি কারাগারে পাঠানো হয়। দুই-এক দিনের মধ্যেই জামিনের আবেদন করা হবে। তিনি জানান, ‘‘এই ৮৩ জনের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ করা হয়েছে ঠিক একই অভিযোগে এর আগে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ থেকে আসা ২১৯ জন প্রবাসীকে কারাগারে পাঠানো হয়। এবার শুধু নামের বদল হয়েছে৷ আর সব অভিযোগ একই। কোনো পরিবর্তন নাই।’’

গত জুলাই মাসেও কুয়েত থেকে ১৪১, কাতার থেকে ৩৯ এবং বাহরাইন থেকে ৩৯ জনসহ মোট ২১৯ জন প্রবাসী দেশে ফেরত আসেন ৷ তাদের বিভিন্ন অপরাধের সাজা মওকুফ করে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো হয়। মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ তাদের সাজা মওকুফ করলেও বাংলাদেশের পুলিশ তাদের জেলে পাঠায়।

আর এই সব বিষয়ে কথা বলার জন্য প্রবাসী কল্যাণমন্ত্রী বা সচিব কাউকেই পাওয়া যায়নি। তবে দায়িত্বশীল কয়েকটি জায়গায় কথা বলে জানা গেছে, ভিয়েতনামে বাংলাদেশি দূতাবাসের সামনে গিয়ে প্রতিবাদ করার কারণেই প্রবাসীদের এই পরিণতি বরণ করতে হয়েছে। এর আগে পররাষ্ট্রমন্ত্রী কিছু প্রবাসীর বিরুদ্ধে ভিয়েতনাম দূতাবাস দখল চেষ্টার অভিযোগও করেছিলেন।

 

সূত্র: ডয়চে ভেলে

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button