সিলেট ও সুনামগঞ্জে বন্যার আভাস থাকলেও ছিল না প্রস্তুতি!
গাজীপুর কণ্ঠ ডেস্ক : পাহাড়ি ঢল আর ভারী বৃষ্টিতে সৃষ্ট বন্যায় রোববার পর্যন্ত দেশের উত্তর ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলের ১২ জেলার ৬৪ উপজেলা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বন্যায় সিলেটের ৬০ শতাংশ এবং সুনামগঞ্জের প্রায় ৯০ শতাংশ এলাকা এখন পানির নিচে। এসব এলাকার প্রায় ৬০ লাখ মানুষ চরম অসহায়ত্বের মধ্যে দিন পার করছে।
বলা হচ্ছে, এই বন্যা ১২২ বছরের রেকর্ড ভেঙেছে। অথচ জুনের মাঝামাঝিতে বড় বন্যা দেখা দিতে পারে, এমন পূর্বাভাস দেওয়া হলেও সংশ্লিষ্টরা বিষয়টি আমলে নেননি। বন্যা হলে কী উপায়ে উদ্ধার কাজ পরিচালনা করা হবে, কীভাবে বন্যার্তদের সরিয়ে নেওয়া হবে, এসব বিষয়ে সরকার কোনো প্রস্তুতি নেয়নি। ফলে এখন বন্যার্তদের উদ্ধারে সরকারকে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে।
কর্মকর্তারা জানান, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উদ্যোগে সিলেট বিভাগের বিভিন্ন জেলা ও উপজেলায় কৃষকদের কৃষি আবহাওয়া সম্পর্কে সচেতন করার পাশাপাশি বিরূপ পরিস্থিতিতে করণীয় ঠিক করতে একাধিক সেমিনারের আয়োজন করা হয়। বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে আবহাওয়া অধিদপ্তর ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) সহযোগিতায় হওয়া এসব সেমিনারে বন্যার পূর্বাভাস জানানো হয়েছিল। কিন্তু সংশ্লিষ্টরা বিষয়টিতে গুরুত্ব দিয়ে পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হয়েছেন। ফলে বন্যা প্লাবিত সিলেট ও সুনামগঞ্জের মানুষের দুর্ভোগ চরমে পৌঁছেছে।
রোববার নিজ কার্যালয়ে এক অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও বলেন, ‘কিছুদিন পর পর, বিশেষ করে ১০ থেকে ১২ বছর পর পর বাংলাদেশে বড় বড় বন্যা আসে। আমি সবাইকে অনেক আগে থেকেই সতর্ক করেছিলাম যে এবারের বন্যাটা কিন্তু বিরাট আকারে আসবে। তবে আমাদের প্রস্তুতি আছে। এই পানি নামলে শ্রাবণ থেকে ভাদ্র পর্যন্ত দক্ষিণাঞ্চল প্লাবিত হবে। এ সময়ে মানুষের যেন কষ্ট না হয়, আমরা যথাযথ ব্যবস্থা নিচ্ছি।’
এবারের বন্যাকে ভয়াবহ উল্লেখ করে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় বন্যার্তদের জন্য ত্রাণসামগ্রী ও নগদ টাকা বরাদ্দ দিয়েছে। কিন্তু সরকারের এমন বরাদ্দ প্রয়োজনের তুলনায় খুবই অপ্রতুল বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
ভবিষ্যতে এ ধরনের বড় বন্যার আশঙ্কা করেছেন পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ ও ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক আইনুন নিশাত। তিনি বলেন, এর জন্য প্রস্ততি ও পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। তবে বর্তমানে বন্যার্তদের পাশে দাঁড়াতে হবে। জরুরি ভিত্তিতে স্কুল-কলেজ বন্ধ করে আশ্রয়কেন্দ্র ও বন্যায় দুর্গতদের ত্রাণ বিতরণসহ প্রয়োজনীয় সব ধরনের ব্যবস্থা নিতে হবে।
তিনি বলেন, এমন বন্যার ঘটনা প্রতি ৪ থেকে ৫ বছর পর বারবার হয়। ফের ৪ থেকে ৫ বছর পর এমন পরিস্থিতি তৈরি হবে। অর্থাৎ প্রকৃতি কীভাবে আচরণ করবে, এটি ভালোভাবে বুঝে নিয়ে তার প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। এ বছরের যে বন্যা সৃষ্টি হয়েছে, এর পানি নামানোর কোনো উপায় নেই। ফলে এ বছর বন্যাদুর্গত মানুষের পাশে দাঁড়াতে হবে। ত্রাণ কার্যক্রম বাড়াতে হবে, দ্রুত পানিবন্দি মানুষদের আশ্রয় প্রকল্পে সরিয়ে নিতে হবে।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. মো. এনামুর রহমান বলেন, পরিস্থিতি মোকাবিলায় সেনাবাহিনী, কোস্টগার্ড, নৌবাহিনী, বিমানবাহিনী, বিজিবি, বাংলাদেশ ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সসহ স্থানীয় প্রশাসন একসঙ্গে উদ্ধার কাজ পরিচালনা করছে। বন্যা দুর্গত এলাকায় শুকনো ও অন্যান্য খাবার ছাড়াও নগদ অর্থ দেওয়া হয়েছে; যা দিয়ে স্থানীয়ভাবে চিড়া, মুড়ি, বিস্কুট ইত্যাদি ক্রয় করে সরবরাহ এবং রান্না করা খাবার সরবরাহ করা হচ্ছে।
অন্যদিকে আন্তর্জাতিক সংস্থা ইউনিসেফ বন্যা দুর্গত এলাকায় বিশুদ্ধ পানির বোতল, পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট এবং শুকনো খাবার সরবরাহ করার ঘোষণা দিয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলেন, সিলেট ও সুনামগঞ্জে বন্যার প্রধান কারণ বৃষ্টি। মেঘালয়ে প্রচুর পরিমাণ বৃষ্টি হচ্ছে। সিলেট শহরেও বৃষ্টি হচ্ছে। এ ছাড়া আগে থেকেই নদীর পানি অনেক উঁচুতে ছিল। বর্তমানে টানা বর্ষণের ফলে বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়েছে।
তারা আরও বলেন, আষাঢ়-শ্রাবণে প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যর জন্যই বন্যা হয়। বেশি বৃষ্টি হয়ে বন্যা হতেই পারে। তবে এটি জেনেও যদি কোনো প্রস্তুতি বা ব্যবস্থাপনা না থাকে, তা হলে বন্যা মোকাবিলা করা সম্ভব নয়। সবচেয়ে বড় বিষয়, সিলেট-সুনামগঞ্জ শহরে বন্যা নিয়ন্ত্রণকারী কোনো বাঁধ নেই। এ কারণেই বন্যা হচ্ছে।
স্থানীয় সরকারমন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম বলেন, সিলেট ও সুনামগঞ্জে বন্যার পানি যাতে সরে যেতে পারে, এ জন্য কয়েকটি রাস্তা কেটে ফেলা হয়েছে। কিছু রাস্তা কাটার প্রয়োজন পড়েছে বলে জানিয়েছেন মেয়র। এতে পানি সহজে নেমে যাচ্ছে। দেশের কোথাও প্রয়োজন হলে আরও রাস্তা কেটে ফেলা হবে। প্রয়োজনে সড়ক কেটে ফেলার বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ আছে বলেও জানান তিনি।