কেন বন্ধ করা যাচ্ছে না অবৈধ হাসপাতাল-ক্লিনিক?

গাজীপুর কণ্ঠ ডেস্ক : কিছুদিন পরপর অবৈধ হাসপাতাল ও ক্লিনিকের বিরুদ্ধে অভিযান চালায় স্বাস্থ্য অধিদফতর। এতে কিছু হাসপাতাল বন্ধও হয়। কিছুদিন পর আবারও চালু হয়।
এভাবেই চলছে স্বাস্থ্য বিভাগের বেসরকারি খাত।
খোদ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, দেশের বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের মধ্যে মাত্র ছয় শতাংশের লাইসেন্স আছে। আর সরকারের অনুমোদন ছাড়াই চলছে বাকি ৯৪ ভাগ।
এমন পরিস্থিতিতে জনগণকে মানসম্পন্ন স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করা নিয়ে উদ্বিগ্ন বিশেষজ্ঞরাও।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিক) ডা. বেলার হোসেন বলেন, ‘‘আমরা তো তাদের নজরদারির মধ্যেই রেখেছি। এই কারণেই মাঝেমধ্যে অভিযান চালাই। কাউকে জরিমানা করি, কোনো হাসপাতাল একেবারেই বন্ধ করে দিই।”
এভাবেই চলছে স্বাস্থ্য বিভাগের বেসরকারি খাত। খোদ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, দেশের বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের মধ্যে মাত্র ছয় শতাংশের লাইসেন্স আছে। আর সরকারের অনুমোদন ছাড়াই চলছে বাকি ৯৪ ভাগ।
এমন পরিস্থিতিতে জনগণকে মানসম্পন্ন স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করা নিয়ে উদ্বিগ্ন বিশেষজ্ঞরাও।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিক) ডা. বেলার হোসেন বলেন, ‘‘আমরা তো তাদের নজরদারির মধ্যেই রেখেছি। এই কারণেই মাঝেমধ্যে অভিযান চালাই। কাউকে জরিমানা করি, কোনো হাসপাতাল একেবারেই বন্ধ করে দিই।”
আগের অভিযানে যেগুলো বন্ধ করা হয়েছিল সেগুলোর মধ্যে কোনটা কি এবারের অভিযানের সময় চালু অবস্থায় পাওয়া গেছে? জবাবে জনাব হোসেন বলেন, ‘‘অনেকগুলোই পাওয়া গেছে৷ সেগুলো আবার বন্ধ করে দিয়েছি। তিন মাস আগে আমরা যে অভিযান চালিয়েছিলাম তখন সাড়ে ১৬শ’ অবৈধ হাসপাতাল ও ক্লিনিক বন্ধ করে দিয়েছিলাম। আর এবারের অভিযানে সাড়ে আটশ অবৈধ হাসপাতাল ও ক্লিনিক বন্ধ করেছি৷ এগুলো আমরা নজরদারির মধ্যেই রেখেছি।’’
সম্প্রতি চলানো অভিযানে দেখা গেছে, অনেক হাসপাতালে নোংরা ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে চলছে চিকিৎসা। নেই সরকারি নীতিমালা অনুযায়ী অবকাঠামো। এক্সরে মেশিন এমন জায়গায় রাখা হয় যে নূন্যতম সুরক্ষাব্যবস্থা থাকে না। এতে এক্সরে করতে আসা রোগী, যিনি এক্সরে করাচ্ছেন তিনি এবং আশাপাশের মানুষ ভয়াবহ রেডিয়েশনের শিকার হচ্ছেন। রি-এজেন্ট অর্থাৎ ক্যামিকেলের পাশে রাখা হচ্ছে তরকারি। ভুয়া চিকিৎসক, অনভিজ্ঞ নার্স ও অদক্ষ আয়া দিয়ে চলছে চিকিৎসা কার্যক্রম। অর্থাৎ চিকিৎসার নামে মরণব্যবস্থা চালু আছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানায়, গত ২৯ থেকে অভিযান শুরু হয়ে তা চলে ২ সেপটেম্বর পর্যন্ত। এবারের অভিযানে ৮৫০টি অবৈধ হাসপাতাল ও ক্লিনিক বন্ধ করার পাশাপাশি বিভিন্ন হাসপাতাল-ক্লিনিক থেকে ১৫ লাখ টাকা জরিমানাও আদায় করা হয়েছে।
তবে বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিক মালিত সমিতির নেতারা অবশ্য বলছেন দেশের চিকিৎসাসেবা অনেকাংশেই বেসরকারি খাতের উপর নির্ভরশীল। এই পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে অভিযান চালানোর পরমর্শ তাদের। অভিযানের সময়ে যেন বৈধভাবে পরিচালিত হাসপাতাল-ক্লিনিকগুলোকে হয়রানি করা না হয় এমন দাবি তাদের।
বাংলাদেশ প্রাইভেট ক্লিনিক অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি অধ্যাপক ডা. মনিরুজ্জামান ভূঁইয়া বলেন, ‘‘বাংলাদেশের মানুষের যে আজ গড় আয়ু ৭৩ বছর, সেটা কিন্তু বেসরকারি চিকিৎসা সেবার কারণেই। দেশের মাত্র ৩০ শতাংশ চিকিৎসা সরকারি হাসপাতালে হয়, বাকি ৭০ শতাংশ হয় বেসরকারি হাসপাতালে। ফলে বেসরকারি খাতের অবদান অস্বীকার করার সুযোগ নেই। বিশেষ করে কোভিডের সময় আমাদের এখানে যে চিকিৎসাটা হয়েছে, সেটা তো আপনি অস্বীকার করতে পারবেন না। উন্নত দেশগুলো যেখানে হিশশিম খেয়েছে সেখানে আমরা কত চমৎকারভাবে সামাল দিয়েছি। আমাদের কোভিডের একজন রোগীও বিদেশে চিকিৎসার জন্য যায়নি। হাজার হাজার কোটি টাকা দেশে থেকেছে। এগুলো মাথায় নিয়েই অভিযান চালাতে হবে। অবৈধদের বিরুদ্ধে অভিযানে আমাদের আপত্তি নেই। কিন্তু বৈধ যারা তাদের যেন কোনভাবেই হয়রানি করা না হয়, সেদিকেও বিশেষ নজর রাখতে হবে।’’
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘‘দেশের আনাচে-কানাচে গজিয়ে উঠেছে হাজার হাজার অনিবন্ধিত ক্লিনিক-হাসপাতাল। ফলে অধিকাংশ হাসপাতালে প্রতিদিনই ঘটছে নানা অঘটন। ভুল চিকিৎসার শিকার হয়ে রোগীদের মৃত্যু পর্যন্ত ঘটছে প্রায়ই। অনেক প্রতিষ্ঠানের তথ্যও নেই স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে। দেশজুড়ে এমন অবৈধ, নিবন্ধনহীন হাসপাতালের সংখ্যা হাজার হাজার। যেগুলোর বেশির ভাগেরই নাম ও অবস্থান জানে না অধিদপ্তর।
অনলাইনে আবেদনের পর স্বাস্থ্য বিভাগের একটি টোকেন, সিটি করপোরেশনের ট্রেড লাইসেন্স নিয়ে ব্যবসা করছেন ক্লিনিক মালিকেরা। এসব অবৈধ, নিবন্ধনহীন ক্লিনিক-হাসপাতাল বন্ধে নানা সময়ে অভিযান পরিচালিত হলেও কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। বরং এই সংখ্যা দিন দিন বেড়েই যাচ্ছে।’’
আর স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন পরিস্থিতি সামলাতে নিয়মিত অভিযান চালানোর পাশাপাশি পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে হবে যেন বন্ধ হয়ে যাওয়া হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলোকে সরকারের অনুমোদন ছাড়া নতুন চালানোর সুযোগ না থাকে।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেনিন চৌধুরী বলেন, ‘‘এভাবে শৃঙ্খলা ফেরানো যাবে না৷ শুধু অভিযান চালিয়ে চলে গেলে হবে না। লাগাতার পর্যবেক্ষন করতে হবে। এই দুর্বলতা শুরু থেকেই রয়েছে। ১৯৮২ সালে যে অধ্যাদেশের মাধ্যমে আমাদের স্বাস্থ্যখাত গড়ে উঠেছে, সেটা পরে আইনে পরিণত হলেও এর যে বিধিমালা সেটা এখনও চূড়ান্ত হয়নি। সর্বশেষ গবেষণায় দেখা গেছে, আমাদের চিকিৎসাসেবার ৭৫ থেকে ৮০ ভাগই বেসরকারি খাতে। এখন তো বৈধের চেয়ে অবৈধ প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বেশি। এরজন্য আসলে প্রয়োজন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে একটা আলাদা উইং তৈরি করা৷ তাদের পর্যাপ্ত জনবল ও সুযোগসুবিধা দিতে হবে। তারা সারাবছরই এগুলো মনিটরিং করবে। এর পাশাপাশি মফস্বলে স্থানীয় প্রশাসনকেও এর সঙ্গে সংযুক্ত করতে হবে। প্রয়োজনে তাদের জবাবহিতার আওতায় আনতে হবে।’’
সূত্র: ডয়চে ভেলে