নারায়ণগঞ্জে আবাসন কোম্পানির থাবা: এক যুগে কৃষি জমি কমে অর্ধেক!

গাজীপুর কণ্ঠ ডেস্ক : নারায়ণগঞ্জে নগরায়ন, আবাসন কোম্পানি ও শিল্পকারখানা গড়ে ওঠায় দিন দিন কৃষিজমির সংখ্যা কমছে। সেই সঙ্গে দূষণ বাড়ায় কমেছে জমির উর্বরাশক্তিও। এর ফলে উৎপাদন কমে যাওয়ায় জেলার খাদ্য নিরাপত্তা এখন হুমকির মুখে পড়েছে।
কৃষকরা বলছেন, আবাসন কোম্পানির দৌরাত্ম্য ঠেকানো না গেলে ভবিষ্যতে খাদ্যসংকটে পড়তে হবে তাদের।
স্থানীয়রা জানান, নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ, সোনারগাঁ, আড়াইহাজার ও বন্দর উপজেলা একসময় কৃষিপ্রধান এলাকা ছিল। কিন্তু আশির দশকের শুরুতে রূপগঞ্জে শিল্পকারখানা গড়ে উঠতে শুরু করে। এরপর ২০১০ সাল থেকে এখানে আবাসন কোম্পানির মালিকদের দৌরাত্ম্য বাড়তে থাকে। মূলত এরপর থেকেই এখানকার কৃষিজমি কমতে থাকে। অন্য উপজেলাগুলোর মধ্যে বন্দর ও সোনারগাঁয়ে শিল্পের বিকাশ শুরু হয় ৯০-এর দশকে। তবে এ সময় আড়াইহাজারের মানুষ কৃষির ওপরই নির্ভরশীল ছিল। বর্তমানে নারায়ণগঞ্জের মধ্যে রূপগঞ্জে সবচেয়ে বেশি আবাসন কোম্পানি রয়েছে। সেই সঙ্গে এখানে অনেক শিল্পকারখানাও গড়ে উঠেছে।
উপজেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, রূপগঞ্জে ২৫টির মতো আবাসন কোম্পানি রয়েছে। এ ছাড়াও রয়েছে সাত শতাধিক শিল্পকারখানা। আড়াইহাজারে ৮-১০টি আবাসন কোম্পানি এবং জাপান অর্থনৈতিক অঞ্চলসহ ১৫টির মতো শিল্পকারখানা রয়েছে। আর সোনারগাঁয়ে ১০টি আবাসন কোম্পানি ও অর্ধশতাধিক শিল্পকারখানা গড়ে উঠেছে। আর বন্দরে আবাসন কোম্পানি রয়েছে ৫-৬টি। সেখানে শিল্পকারখানার সংখ্যা অর্ধশতাধিক।
উপজেলা কৃষি অফিসের তথ্য বলছে, গত এক যুগের ব্যবধানে এই চার উপজেলার মধ্যে তিন উপজেলাতেই কৃষিজমির পরিমাণ কমে প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে। এর মধ্যে বন্দর উপজেলায় জমি কমেছে অর্ধেকেরও বেশি। তবে এর পরিমাণ আড়াইহাজারে কিছুটা কম। তবে এ উপজেলায় শিল্প কারখানা এবং আবাসন কোম্পানির উপস্থিতিও কম।
এসব উপজেলার কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আগে কৃষিকাজ করেই জীবিকা নির্বাহ করতেন তারা। কিন্তু এখন কৃষিতে আগের মতো আর আয় নেই। কারণ আবাসন কোম্পানি ও শিল্পকারখানার মালিকরা জোরপূর্বক উর্বর জমি দখল করে বালু দিয়ে ভরাট করেছে। এরা ভূমিদস্যু এবং খুবই প্রভাবশালী। তাই বাধ্য হয়েই তাদের কাছে জমি বিক্রি করে দিতে হয়।
রূপগঞ্জের দাউদপুরের হানকুর এলাকার কৃষক রবিউল ইসলাম বলেন, আগে এক বিঘা জমির ফসল থেকে উৎপাদন খরচ বাদ দিয়ে বেশ লাভ হতো। কিন্তু এখন জমির উর্বরাশক্তি নষ্ট হয়ে গেছে। জমির চারপাশে কারখানা গড়ে ওঠায় আগের মতো ফসল হয় না। এখন আবার সবকিছুর দামও বেড়েছে।
ভোলাব এলাকার কৃষক আমিনউদ্দীন বলেন, ১৫-২০ বছর আগে খেতথামারে ধান চাষ করে সংসার চালাতেন। বিঘায় ৩০-৩২ মণ ধান পেতেন। সারা বছরের চাল রেখে বাকিটা বিক্রি করতেন। এখন আগের মতো ধান হয় না। তাই চাষের আগ্রহও কমে গেছে।
ভোলাব টাওরা এলাকার কৃষক আব্বাস আলী বলেন, ‘বিভিন্ন কোম্পানি বালু ফালাইয়া জমি ভইরা ফালাইতাছে। ফসল অইবো ক্যামনে? জমির দহল-ফহল লইয়া তাগো লগে প্রায়ই গেঞ্জাম হয়।’
রূপগঞ্জের মুড়াপাড়া বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের ভূগোল বিভাগের প্রভাষক ইসহাক মিয়া বলেন, জলবায়ু পরিবর্তন উদ্বেগের বিষয়। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে পরিবেশের ওপর। বায়ুমণ্ডল যত উষ্ণ হচ্ছে, মানুষ তত অসহিষ্ণু হয়ে উঠছে। সামাজিক অশান্তি বাড়ছে। এ ছাড়া চাষের জমি দিন দিন কমতে থাকায় মানুষ জমি পেতে যত লড়াই করছে, সহিংস ঘটনাও
তত বাড়ছে।
উপজেলার পরিবেশবাদী আন্দোলনের নেতা মাহাবুব আলম প্রিয় বলেন, পূর্বাচলের আশপাশের মৌজাগুলোতে নামে-বেনামে আবাসন কোম্পানি গড়ে উঠেছে। এসব কোম্পানির বালু ফেলার কারণে কৃষিজমি নষ্ট হয়। সেই সঙ্গে পরিবেশেরও
ক্ষতি হয়। বন্দর উপজেলার কৃষি কর্মকর্তা ফারহানা সুলতানা বলেন, নগরায়ন ও শিল্পকারখানা ছাড়াও ইটভাটার জন্য কৃষিজমি থেকে মাটির উপরিভাগ কেটে নিয়ে যাচ্ছে। এসব কারণে মূল জমির মালিকরা জমি বিক্রি করে দিচ্ছেন। এ ছাড়া কৃষি থেকে এখন উৎপাদন কম আসে। তাই কৃষকদের এখন কৃষিকাজে অনীহা।
নারায়ণগঞ্জ কৃষি অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মুহাম্মদ শাহ আলম বলেন, সরকার বলেছে, যেন তিন ফসলি জমি বাদ দিয়ে অন্যকিছু করা হয়। কিন্তু প্রশাসন তো আইন প্রয়োগ করতে পারছে না। দেশের অন্য জায়গার চেয়ে নারায়ণগঞ্জ আলাদা। জমি যতটুকু আছে, তা যেন কোনোভাবেই অনাবাদি না হয় সে চেষ্টা করা হবে।
সূত্র: দৈনিক বাংলা