রাজ হাউজিং এর জালিয়াতি: নদী কবরস্থানের ভূমি বন্ধক রেখে ২৫০ কোটি টাকা ঋণ

গাজীপুর কণ্ঠ ডেস্ক : কাপাসিয়া উপজেলার সহরটোক মৌজার পাঁচটি দাগে (দাগ নং ৮২, ৮৩, ৯০, ১৩৭ ও ১৩৮) মোট জমির পরিমাণ ১ একর ২৮ শতক। আরএস খতিয়ান অনুযায়ী এর পুরোটাই ব্রহ্মপুত্র নদের চালা ও শিকস্তি ভূমি (নদীতে ভেঙে যাওয়া জমি), যা নৌকা চলাচল ও সর্বসাধারণের ব্যবহার্য। এ জমিই ঋণের জামানত হিসেবে নিয়েছে বেসরকারি আইএফআইসি ব্যাংক। এর বাইরে কবরস্থান, সরকারি বিভিন্ন সংস্থার জমিসহ খাস জমি বন্ধক রেখে রাজ হাউজিং লিমিটেড নামে একটি আবাসন প্রতিষ্ঠানকে প্রায় ২৫০ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে ব্যাংকটি।
একে গুরুতর অনিয়ম হিসেবে দেখছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, সরকারি খাস জমি, শিকস্তি ও পয়স্তি ভূমি, কবরস্থান, মসজিদসহ ধর্মীয় কোনো ভূমি জামানত হিসেবে নেয়ার সুযোগ নেই। যদিও ব্যাংকের দাবি, নিজস্ব আইনজীবী ও রেজিস্ট্রি অফিস থেকে যাচাই করে ও দলিল তৈরির পরই তারা ঋণ অনুমোদন দিয়েছে।
৩২৩ বিঘা সম্পত্তি জামানত রেখে রাজ হাউজিং লিমিটেডকে ঋণটি দিয়েছে আইএফআইসি ব্যাংকের গুলশান শাখা। গত বছরের জুনে ঋণ নেয়ার আগে প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে ব্যাংকের কাছে জামানতের সম্পত্তির দলিলপত্র জমা দেয়া হয়। ৫৫ পৃষ্ঠার নথি অনুযায়ী, গাজীপুরের দুই উপজেলা ও ময়মনসিংহের এক উপজেলার মোট পাঁচটি মৌজার এ ভূমি জামানত হিসেবে রাখা হয়েছে। এর মধ্যে গাজীপুরের জয়দেবপুর উপজেলার সমরসিং মৌজায় জমির পরিমাণ ১২৭ দশমিক ২৯ বিঘা ও উদর মৌজার ১০ দশমিক ৪৪ বিঘা। একই জেলার কাপাসিয়া উপজেলার সহরটোক মৌজায় ৬৩ দশমিক ৮১ বিঘা ও সুলতানপুরে জমির পরিমাণ ১৮ দশমিক ৯ বিঘা। এছাড়া ময়মনসিংহ জেলার ভালুকা উপজেলার মেদুরি মৌজার ১৮ দশমিক ৯ বিঘা জমিও জামানত হিসেবে রাখা হয়েছে।
সহরটোক মৌজায় বন্ধকি জমির নথি পর্যালোচনায় দেখা যায়, মৌজার ১৩৫ নং দাগের নয় শতক জমি কবরস্থান। এজমালি সম্পত্তি হিসেবেই আরএস খাতিয়ানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে এটি। তার পরও কবরস্থানের এ ভূমি জামানত হিসেবে নিয়েছে আইএফআইসি ব্যাংক। একই মৌজার ২২ নং দাগের ছয় শতক, ৫৮ নং দাগের ৩৫ শতক, ৮৬ নং দাগের ২২ শতক ও ৭১ নং দাগের ১০ শতক জমি শিকস্তি। আরএস খতিয়ানে শিকস্তি হিসেবে উল্লেখ থাকলেও রাজ হাউজিং লিমিটেড আইএফআইসি ব্যাংকের কাছে তা বন্ধক রেখেছে। আরএস খতিয়ান অনুযায়ী সহরটোক মৌজার ৫৭ নং দাগের প্রায় ৩০ শতক শিকস্তি জমি সরকারের ডেপুটি কাস্টডিয়ানের নামে নিবন্ধিত। এ জমিও জামানত হিসেবে নিয়েছে আইএফআইসি ব্যাংক।
খতিয়ান অনুযায়ী, গাজীপুরের কাপাসিয়া উপজেলার সহরটোক মৌজার ৪৯ নং দাগের ৫৫ শতক ভূমি ব্রহ্মপুত্র নদের। নদের ভূমিটি এজমালি হিসেবে আরএস খতিয়ানে নিবন্ধিত। অথচ ব্রহ্মপুত্র নদের ওই অংশও রাজ হাউজিং লিমিটেডের কাছ থেকে জামানত হিসেবে গ্রহণ করেছে ব্যাংকটি। একই মৌজার ৮২, ৮৩, ৯০, ১৩৭ ও ১৩৮ নং দাগে ১ একর ২৮ শতক ভূমি ব্রহ্মপুত্র নদে নৌকা ও সর্বসাধারণের চলাচলের পথ হিসেবে খতিয়ানে লিপিবদ্ধ আছে।
পাঁচটি মৌজার মধ্যে শুধু সহরটোক মৌজার নথি পর্যালোচনা করেই নদী, শিকস্তি ও কবরস্থানের সাত বিঘা ভূমি বন্ধক রাখার হিসাব পাওয়া গেছে। বাকি চারটি মৌজার বন্ধক রাখা ভূমির মধ্যেও উল্লেখযোগ্য পরিমাণ এ শ্রেণীর বলে সংশ্লিষ্ট এলাকায় খোঁজ নিয়ে ও এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে।
বিষয়টি শিকার করেছে রাজ হাউজিং লিমিটেড কর্তৃপক্ষও। আবাসন প্রতিষ্ঠানটির মহাব্যবস্থাপক (জিএম) দেলোয়ার হোসেনের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, জমিগুলো আমরা তৃতীয় পক্ষের (দালাল) মাধ্যমে কিনেছিলাম। তাই পুরো জমির কাগজপত্র সেভাবে দেখে নেয়া সম্ভব হয়নি। ব্যাংকে কাগজপত্র জমা দেয়ার পর আমরা জানতে পেরেছি, সেখানে নদী ও কবরস্থানের জায়গা রয়েছে। এর পরই আমরা বিকল্প নিষ্কণ্টক জমি কিনেছি। দু-তিন মাসের মধ্যেই আমরা এ কাগজগুলো ব্যাংকে জমা করব।
ঋণটি অনুমোদন দেয়ার সময় আইএফআইসি ব্যাংকের গুলশান শাখার ব্যবস্থাপকের দায়িত্বে ছিলেন মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম। বর্তমানে তিনি ব্যাংকটির প্রিন্সিপাল শাখায় কর্মরত। কবরস্থান, শিকস্তি ও নদীর জমি জামানত রেখে ঋণ দেয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, যেকোনো ঋণের জামানতের সম্পদ বিষয়ে ব্যাংকের প্যানেল আইনজীবীদের মতামত নেয়া হয়। জামানতের সম্পত্তিতে কোনো সমস্যা থাকলে সেটি আইনজীবীরা চিহ্নিত করে নিজেদের মতামত দেন। এক্ষেত্রে স্থানীয় ভূমি অফিসের মতামতও গুরুত্বপূর্ণ। একটি ঋণ প্রস্তাব গ্রহণ থেকে শুরু করে বিতরণ পর্যন্ত ব্যাংকের একাধিক পক্ষ সম্পৃক্ত থাকে। ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে ব্যবস্থাপকের একক কর্তৃত্ব থাকে না। যদি এমন কিছু থাকে, তার দায়ভার স্থানীয় ভূমি অফিসের। ভূমি অফিসের দলিলপত্রের সঙ্গে মিলিয়ে আমরা ঋণপত্র চূড়ান্ত করে থাকি।
রাজ হাউজিং লিমিটেডের ঋণটি যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করেই দেয়া হয়েছে দাবি করে তিনি বলেন, এখন পর্যন্ত ওই ঋণের বিষয়ে কোনো অভিযোগ আমি শুনিনি। তাছাড়া গুলশান শাখায়ও আমি এখন নেই। ফলে ঋণটির সর্বশেষ পরিস্থিতি আমার জানা নেই।
যদিও আইনানুযায়ী, সরকারি খাস জমি, দাগ নম্বর চিহ্নিত করা যায় না, এমন শিকস্তি ও পয়স্তি ভূমি, কবরস্থান, মসজিদসহ ধর্মীয় কোনো পবিত্র ভূমি কখনই জামানত হিসেবে নেয়া যায় না। যদি জামানতের সম্পত্তিতে এ ধরনের কোনো জমি থাকে, প্রাথমিক পর্যায়ে আইনজীবীদের মাধ্যমে তা চিহ্নিত করে বাদ দিতে হয়।
আইনজীবী ব্যারিস্টার মনোয়ার পাটোয়ারি এ প্রসঙ্গে বলেন, সরকারি খাস জমি, নদী, কবরস্থান কিংবা ব্যক্তিমালিকানাধীন নয়, এমন জমি কখনই ব্যাংকে জামানত হিসেবে রাখার সুযোগ নেই, তবে শিকস্তি বা পয়স্তির মাধ্যমে সৃষ্ট কোনো জমি সরকারের কাছ থেকে লিজ নেয়া হলে সে জমি শর্তসাপেক্ষে জামানত রাখা যেতে পারে।
অভিযোগ আছে, আবাসন প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে মোটা অংকের ঘুষের বিনিময়ে রেজিস্ট্রি অফিসের একশ্রেণীর কর্মকর্তার যোগসাজশে এ প্রতারণার ঘটনা ঘটেছে। নিয়ম লঙ্ঘন করে রাজ হাউজিং লিমিটেডকে বিপুল অংকের এ ঋণ দেয়া হলেও আবাসন খাতের অখ্যাত প্রতিষ্ঠানটির কোনো অবকাঠামো দেখা যায়নি।
রাজ হাউজিং লিমিটেডের বন্ধক রাখা জমির মূল্যও ধরা হয়েছে অস্বাভাবিক বেশি। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গাজীপুরের কাপাসিয়া উপজেলার সমরসিং মৌজার প্রতি শতক সাইল জমির দাম ১ লাখ ৭৮ হাজার টাকা। সে হিসাবে এ মৌজার ১২৯ বিঘা জমির (৩৩ শতকে ১ বিঘা) সর্বোচ্চ মূল্য ৭৬ কোটি টাকা। একই উপজেলার উদুর মৌজার প্রতি শতক সাইল জমির দাম ১ লাখ ৬১ হাজার টাকা হিসাবে ১০ দশমিক ৫৪ বিঘার মূল্য দাঁড়ায় প্রায় ৬ কোটি টাকা। এছাড়া সহরটোক মৌজার প্রতি শতক জমির সর্বোচ্চ দাম ১ লাখ ৯০ হাজার টাকা হিসাবে ব্যাংকটির কাছে জমা দেয়া এ মৌজার ৬৫ দশমিক ৭৫ বিঘা জমির মূল্য দাঁড়ায় ৪১ কোটি টাকা। কাপাসিয়ার সুলতানপুর মৌজার প্রতি শতক দেড় লাখ টাকা হিসেবে ১৯ বিঘা সম্পত্তির সর্বোচ্চ মূল্য ১০ কোটি টাকা। এর বাইরে ময়মনসিংহের ভালুকা উপজেলার মেদুরি মৌজার প্রতি শতক জমি বিক্রি হচ্ছে ৫০ হাজার টাকায়। সে হিসাবে আইএফআইসি ব্যাংকে বন্ধক রাখা মৌজাটির ১০২ বিঘা জমির সর্বোচ্চ মূল্য ১৭ কোটি টাকা। অর্থাৎ সরকারি মূল্যের ভিত্তিতে ব্যাংকটির কাছে জামানত দেয়া সব সম্পত্তির মূল্য ১৫০ কোটি টাকার বেশি হবে না। যদিও এ জমির বিপরীতে ব্যাংকটি গ্রাহককে দিয়েছে প্রায় আড়াইশ কোটি টাকা।
এ সংক্রান্ত আরো জানতে….
কালিয়াকৈরে জালিয়াতি করে শতাধিক কৃষকের ৫শ বিঘা জমি হাতিয়েছে রাজ হাউজিং