প্রকৌশলী দেলোয়ার হত্যা: তদন্ত ‘বন্দি’ থানা পুলিশের ফাইলে!
গাজীপুর কণ্ঠ ডেস্ক : গাজীপুর সিটি করপোরেশনের নির্বাহী প্রকৌশলী দেলোয়ার হোসেন হত্যাকাণ্ডের চার মাস পার হতে চলেছে। এ ঘটনায় তিনজন গ্রেপ্তার হলেও চাঞ্চল্যকর এ মামলার পুরো রহস্য উদ্ঘাটন করা যায়নি। শেষ হয়নি তদন্তও। মামলার বাদীর অভিযোগ, তদন্ত কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করলেও তিনি সাড়া পাচ্ছেন না। তদন্ত কর্মকর্তাও বাদীর সঙ্গে যোগাযোগ করেন না। এমন অবস্থায় বাদী থানা পুলিশের তদন্তে অনাস্থা জানিয়ে মামলাটির তদন্ত পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনে (পিবিআই) দেওয়ার আবেদন জানিয়েছেন। সেই আবেদনের দুই মাস পার হলেও রহস্যজনক কারণে এখনও তুরাগ থানা পুলিশের হাতেই রয়েছে মামলার তদন্ত। কেন এত গুরুত্বপূর্ণ মামলা থানা পুলিশ তদন্ত করছে- সেই প্রশ্নও তুলছে অনেকে।
গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগ সভাপতি অ্যাডভোকেট আজমত উল্লাহ খান বলেন, প্রকৌশলী দেলোয়ার হত্যার ঘটনা এখনও রহস্যাবৃত। পিবিআইকে দিয়ে তদন্ত করলে এর পেছনের কোনো ঘটনা থাকলে বেরিয়ে আসত। যে তিনজন গ্রেপ্তার হয়েছে; এ ঘটনায় শুধু তারাই জড়িত থাকলে তাও নিশ্চিতভাবে জানা যেত।
তুরাগ থানা পুলিশ তিনজনকে গ্রেপ্তার করে দাবি করে আসছে, নিহত দেলোয়ারের সহকর্মী সহকারী প্রকৌশলী আনিসুর রহমান সেলিমের পরিকল্পনায় ওই হত্যাকাণ্ড ঘটে। তাকে গালমন্দ করায় সে হত্যার পরিকল্পনা করে। সে অনুযায়ী শাহিন নামে একজন খুনিকে ভাড়া করে সে। হত্যাকাণ্ড ঘটাতে একটি মাইক্রোবাসও ভাড়া করা হয়। গত ১১ মে ওই হত্যাকাণ্ডের পর সেলিম, শাহিন ও মাইক্রোবাস চালক হাবিবকে গ্রেপ্তার করা হয়। তারা আদালতে স্বীকারোক্তি দিয়ে হত্যার দায় স্বীকার করেছে। এতে অন্য কারও নাম তারা বলেনি।
অবশ্য শুরু থেকেই নিহতের স্বজনরা বলে আসছেন, অফিসের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা তার জুনিয়রকে গালমন্দ করলেই তাকে মেরে ফেলবে- এটা অবিশ্বাস্য। দেলোয়ারের টেবিলে শত শত কোটি টাকার উন্নয়ন কাজের ফাইল ছিল। এসব কাজে অনিয়ম হওয়ায় তিনি ফাইল ছাড় করছিলেন না। এ জন্য তাকে খুন করা হতে পারে।
জানা গেছে, দেলোয়ার হত্যা মামলার তদন্ত কার্যত তুরাগ থানা পুলিশের ফাইলে বন্দি রয়েছে। যদিও পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, হত্যাকাণ্ডে আর কেউ ছিল কিনা, সে বিষয়ে তদন্ত করতে গিয়ে বিলম্ব হচ্ছে।
দেলোয়ার ছিলেন গাজীপুর সিটি করপোরেশনের কোনাবাড়ী আঞ্চলিক কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী। কর্মস্থলে তিনি সৎ কর্মকর্তা হিসেবে পরিচিত ছিলেন। গত ১১ মে সকালে অফিসের উদ্দেশে রাজধানীর মিরপুরের বাসা থেকে বের হন। ওই দিন সন্ধ্যায় উত্তরা ১৭ নম্বর সেক্টরের তুরাগ এলাকার নির্জন একটি প্লটের ঝোপ থেকে পুলিশ অজ্ঞাতপরিচয়ে তার লাশ উদ্ধার করে। পরে স্বজনরা পরিচয় শনাক্ত করেন। নিহতের স্ত্রী খোদেজা আক্তার বাদী হয়ে অজ্ঞাত ব্যক্তিদের আসামি করে মামলা করেন।
খোদেজা আক্তার বলেন, থানা পুলিশ সিটি করপোরেশনের একজন সহকারী প্রকৌশলীসহ তিনজনকে গ্রেপ্তার করেই ঘটনাটি ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করছে বলে তার কাছে মনে হচ্ছে। তার স্বামীকে যে কারণে হত্যা করা হয়েছে বলে পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, তা তিনি বিশ্বাস করতে পারছেন না। এ হত্যাকাণ্ডের পেছনে আরও কেউ থাকতে পারে বলে মনে হচ্ছে।
তিনি বলেন, কোনাবাড়ী এলাকার রাস্তা প্রশস্ত করতে গিয়ে স্থানীয় কাউন্সিলর নাসির উদ্দিন মোল্লাহর সঙ্গে তার স্বামীর বড় ঝামেলা হয়েছিল বলে তিনি শুনেছেন। কাজে অনিয়ম হওয়ায় ঠিকাদারদের কয়েকশ’ কোটি টাকার ফাইল আটকে দিয়েছিলেন তার স্বামী। কিন্তু পুলিশ সেদিকে তদন্ত করছে না। বাদীর অভিযোগ, মামলাটি দায়েরের পর তিনি ও তার স্বজনরা অন্তত ৬ বার তুরাগ থানায় গিয়েছেন তদন্ত কর্মকর্তাকে তথ্য দেওয়ার জন্য। কিন্তু একবারও কেউ দেখা করেনি। কোনো খোঁজও নেয় না।
বাদীর অভিযোগ বিষয়ে জানতে চাইলে গাজীপুর সিটি করপোরেশনের ৯ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর নাসির উদ্দিন মোল্লাহ বলেন, প্রকৌশলী দেলোয়ারকে তিনি এক থেকে দেড় মাস তার এলাকায় পেয়েছিলেন। তার সঙ্গে কোনো ঝামেলাই ছিল না। অন্য একজন সহকারী প্রকৌশলী আনিছুরের সঙ্গে প্রকৌশলীর দেলোয়ারের ঝামেলা ছিল। সেই ঘটনার জের ধরেই তাকে খুন করা হয় বলে তিনি শুনেছেন।
নিহত দেলোয়ারের ভাই নূর নবী দীপ্তি বলেন, কোনাবাড়ী আঞ্চলিক কার্যালয়ের অধীনে শত শত কোটি টাকার উন্নয়ন কাজ চলছিল। তার ভাইয়ের জন্য সেখানে কোনো অনিয়ম হতে পারছিল না। তারা শুনেছেন, একটি সড়ক তিন ঠিকাদারকে ভিন্ন ভিন্ন বাজেটে উন্নয়নের জন্য দেওয়া হয়েছে। এসব অনিয়মের ফাইলে তার ভাই স্বাক্ষর করছিলেন না। এ জন্যই তাকে হত্যার মাধ্যমে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, বিভিন্ন সময়ে তার ভাইয়ের কাছে ফোন আসত। তখন তিনি বলতেন, ‘এসব কাজ তাকে দিয়ে হবে না।’ কারা তার ভাইকে ফোন করত, কারা তার ভাইয়ের জন্য সুযোগ নিতে পারেনি- তাদের বের করলেই আসল খুনিরা বের হবে। কিন্তু পুলিশ রহস্যজনক কারণে সে পর্যন্ত যাচ্ছে না। এ জন্য তারা মামলাটি থানা পুলিশ থেকে সরিয়ে পিবিআইকে তদন্তের দায়িত্ব দিতে পুলিশ সদর দপ্তরে আবেদন করেছেন।
নিহত দেলোয়ারের বড় ছেলে মাশফিকুর সালেহীন হিমেল বলেন, তার বাবার হত্যায় জড়িত নেপথ্য হোতারা গ্রেপ্তার না হওয়ায় তারা আতঙ্কে রয়েছেন।
জানতে চাইলে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা তুরাগ থানার পরিদর্শক (অপারেশন) মফিজুল ইসলাম বলেন, হত্যাকাণ্ডে আর কেউ জড়িত কিনা, তিনি সে তদন্ত অব্যাহত রেখেছেন। বাদী বা তার স্বজনের সঙ্গে দেখা না করার বিষয়ে বলেন, এ অভিযোগটি সঠিক নয়। বাদীপক্ষের সঙ্গে পুলিশের নিয়মিতই যোগাযোগ হচ্ছে। মামলাটি পিবিআইকে দিয়ে তদন্ত করতে বাদীর আবেদন বিষয়ে বর্তমান তদন্ত কর্মকর্তা বলেন, বাদী চাইলে আবেদন করতেই পারেন। তবে তদন্তভার অন্য সংস্থাকে দেওয়ার এখতিয়ার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের।
আরো জানতে….
প্রকৌশলী দেলোয়ার হত্যা: পরিবারের দাবি, সেলিমের পেছনে রাঘববোয়ালরা
গাজীপুর সিটির নিহত প্রকৌশলী দেলোয়ার হোসেনের স্ত্রীকে হুমকি
প্রকৌশলী দেলোয়ার খুনে গ্রেপ্তার আনিছুর দুর্নীতিবাজ: মেয়র জাহাঙ্গীর
মাত্র ১৫ হাজার টাকায় প্রকৌশলী দেলোয়ারকে খুন!
প্রকৌশলী দেলোয়ারের পরিবারে এখন কেবলই বিষাদের ছায়া
গাজীপুর সিটির প্রকৌশলী দেলোয়ার হত্যা : ২ জনের দায় স্বীকার, সহকর্মী রিমান্ডে
গাজীপুর সিটি করপোরেশনের প্রকৌশলী হত্যার দ্রুত বিচারের দাবি আইইবি’র