নগর পরিবহনের সবখানেই অসন্তুষ্টি
গাজীপুর কণ্ঠ ডেস্ক : ভোগান্তির শুরুটা হয় গাড়িতে উঠতে গিয়ে। ভিড় ঠেলে ওঠার পর আসন না মিললে দাঁড়িয়ে বা ঝুলে যাওয়াটাই নিয়তি। আরামে যেতে পারে না আসনধারীও। বড় অস্বস্তির কারণ ঘিঞ্জি বিন্যাসের নোংরা ও ভাঙাচোরা আসন। এই হলো ঢাকার পাবলিক বাসের চিত্র, যার ওপর নির্ভরশীল গণপরিবহন ব্যবহারকারী সিংহভাগ মানুষ।
বাস এড়িয়ে ট্যাক্সি কিংবা অটোরিকশায় যেতে চাইলে গুনতে হয় কয়েক গুণ বেশি ভাড়া। হালের রাইডশেয়ার কিছুটা সহজলভ্য হলেও সেখানে রয়েছে উচ্চভাড়া ও অপেশাদারিত্বের ছাপ। সব মিলিয়ে দুর্ভোগ-ভোগান্তিতে ভরা রাজধানীর নগর পরিবহন ব্যবস্থা। ফলে নগর পরিবহনের সবটা জুড়ে শুধুই অসন্তুষ্টি।
নগর পরিবহন ব্যবহার করে মানুষ কতটা সন্তুষ্ট, ঢাকার বাস্তবতায় তা তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে জাতিসংঘের ইকোনমিক অ্যান্ড সোস্যাল কাউন্সিলের এক প্রতিবেদনে। ‘সাসটেইনেবল আরবান ট্রান্সপোর্ট ইনডেক্স ফর ঢাকা’ শীর্ষক প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে সংস্থাটির এশিয়া অ্যান্ড প্যাসিফিক কাউন্সিল। ২০১৮ সালে প্রকাশিত প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, ঢাকার পরিবহন ব্যবস্থাপনা নিয়ে সন্তুষ্ট মাত্র ৩৮ শতাংশ মানুষ।
তবে গণপরিবহন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বর্তমানে ঢাকার নগর পরিবহন ব্যবস্থা যেভাবে বিশৃঙ্খল হয়ে উঠছে, তাতে যাত্রীদের অসন্তোষ আরো বাড়তে পারে। বিশেষত কোভিড-১৯ পরিস্থিতি গণপরিবহনে মানুষের যাতায়াতকে আরো অস্বস্তিদায়ক করে তুলেছে। স্বাস্থ্যবিধি নিয়ে সন্তুষ্ট হতে না পারায় অনেক মানুষই করোনাকালে গণপরিবহনে ভ্রমণ থেকে নিজেকে বিরত রাখছে।
ঢাকায় পাঁচটি মেট্রোরেল নেটওয়ার্ক ও দুটি বাস র্যাপিড ট্রানজিট বা বিআরটি গড়ে তুলছে সরকার। তবে এসব মেগা প্রকল্পের সুফল পাবে কেবল ১৭ শতাংশ যাত্রী। ফলে বাকি ৮০ শতাংশেরও বেশি মানুষকে বিদ্যমান পরিবহন ব্যবস্থাতেই গন্তব্যে যেতে হবে। বিদ্যমান গণপরিবহন ব্যবস্থার উন্নতির কোনো বিকল্প নেই বলেও জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
বিশ্বের সবচেয়ে যানজটপ্রবণ শহরগুলোর একটি ঢাকা। এখানে রাস্তার তুলনায় গাড়ি অনেক বেশি। যদিও জনসংখ্যার তুলনায় অপ্রতুল গাড়ির সংখ্যা। সাসটেইনেবল আরবান ট্রান্সপোর্ট ইনডেক্স বলছে, ঢাকার অর্ধেকের বেশি মানুষ গণপরিবহনের প্রাপ্যতা নিয়ে সন্তুষ্ট নয়। তবে মানুষ আরো অসন্তুষ্ট গণপরিবহনের সময়ানুবর্তিতা নিয়ে। প্রায় ৭২ শতাংশ মানুষ মনে করে, ঢাকায় গণপরিবহন সময়সূচি মেনে চলে না, যা ভোগান্তির বড় কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
জাতিসংঘের ইকোনমিক অ্যান্ড সোস্যাল কাউন্সিলের এ প্রতিবেদন প্রস্তুত করেছেন সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী নূর-ই-আলম। তিনি মনে করেন, এসব সমস্যার মূলে রয়েছে ঢাকার তীব্র যানজট। এখানে গণপরিবহনের যে অপ্রতুলতার চিত্র উঠে এসেছে, তা কিন্তু হয়েছে যানজটের কারণেই। শুধু গণপরিবহনের অপ্রতুলতাই নয়, ইনডেক্সের সব সূচকে মানুষের অসন্তুষ্টির মাত্রা বাড়াতে যানজটই মূল ভূমিকা পালন করছে।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) হিসাবে ঢাকায় বাস-মিনিবাস আছে আট হাজারের মতো। যদিও পরিবহন মালিকরা বলছেন, বর্তমানে চলাচলরত বাসের সংখ্যা সাড়ে চার থেকে পাঁচ হাজারের বেশি। এসব বাসের সিংহভাগই ভাঙাচোরা। ফিটনেস নেই অন্তত ৬০ শতাংশ বাসের। আসন-মেঝে থেকে শুরু করে দরজার হাতল পর্যন্ত নোংরা। ঢাকার এ অপরিচ্ছন্ন বাস গণপরিবহন ব্যবস্থায় সন্তুষ্ট নয় ৬৭ শতাংশ ব্যবহারকারী। শুধু বাস-মিনিবাস নয়, পরিচ্ছন্নতায় ঘাটতি রয়েছে সিএনজিচালিত অটোরিকশা, লেগুনা, ট্যাক্সির মতো বাহনেও।
ঢাকার পাবলিক বাসগুলোয় যাত্রী তোলার প্রতিযোগিতা নিত্যচিত্র। এতে সড়কে বিশৃঙ্খলা যেমন বেশি হয়, তেমনি বাড়ে দুর্ঘটনাও। বলতে গেলে ‘জীবন হাতে নিয়ে’ গণপরিবহনে ওঠে মানুষ। সাসটেইনেবল আরবান ট্রান্সপোর্ট ইনডেক্স অনুযায়ী, ঢাকার গণপরিবহন ব্যবহারকারীরা সবচেয়ে বেশি অসন্তুষ্ট গণপরিবহনের নিরাপত্তা নিয়ে। প্রতি ১০০ জন ব্যবহারকারীর ৭৬ জনই মনে করে, ঢাকায় গণপরিবহনে ভ্রমণ অনিরাপদ।
ঢাকার গণপরিবহন ব্যবহারকারীদের ‘ক্যাপটিভ ইউজার’ হিসেবে অভিহিত করেছেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক ড. মো. হাদিউজ্জামান। তিনি বলেন, ঢাকায় যারা গণপরিবহন ব্যবহার করে, তারা সবাই বাধ্য হয়েই ওঠে। যাত্রীরা চায় একটা নির্ভরযোগ্য বাস সেবা। সময়মতো বাস পাওয়া এবং সময়মতো গন্তব্যে পৌঁছা যাত্রীদের জন্য ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ।
তার মতে, ঢাকায় বাস নেটওয়ার্ক সঠিকভাবে গড়ে ওঠেনি। হওয়া উচিত ছিল বাড়ি থেকে হাঁটা দূরত্বে গিয়েই পাওয়া যাবে বাসস্ট্যান্ড। কিন্তু আমাদের নেটওয়ার্কটা এমন, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে হেঁটে বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত যাওয়া যায় না। ঢাকার বাসগুলো আরামদায়ক ও স্বস্তিদায়ক নয়। নির্ভরযোগ্য বাস, আদর্শ নেটওয়ার্ক ও স্বস্তিদায়ক ভ্রমণ—এই তিনটি বিষয় ঠিক করা গেলে যাত্রীদের সন্তুষ্টির মাত্রা অনেকটাই বেড়ে যাবে।
পাবলিক বাসের যেসব বিকল্প আছে, সেগুলোকে বেশ ব্যয়বহুল উল্লেখ করে অধ্যাপক হাদিউজ্জামান আরো বলেন, সিএনজিচালিত অটোরিকশা, ট্যাক্সির মতো ইনফরমাল গণপরিবহনগুলোয়ও কিন্তু মানুষ বাধ্য হয়েই ওঠে। পাবলিক বাসে ভাড়া কম, কিন্তু সেখানে স্বস্তি নেই। সিএনজিচালিত অটোরিকশা, ট্যাক্সিতে স্বস্তি থাকলেও ভাড়া বেশি। ফলে ব্যবহারকারীদের দুটোর যেকোনো একটি বেছে নিতে হয়।
ঢাকার রাস্তাগুলোর পুরোটা জুড়েই বাস স্টপ। এখানে রাস্তা থেকেই ওঠে যাত্রী, নামে রাস্তার ওপরই। খোদ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে নির্দেশনা এলেও ঠিক হয়নি রাস্তার ওপর যাত্রী ওঠানামা। একই চিত্র উঠে এসেছে সাসটেইনেবল আরবান ট্রান্সপোর্ট ইনডেক্সেও। ৬৮ শতাংশ ব্যবহারকারী মনে করে, ঢাকায় বাস স্টপেজগুলো সুবিধাজনক নয়।
কোন রুটে কোন বাস চলে, ঢাকায় এসে বছর খানেক না থাকলে তা বোঝা দুষ্কর। বাসের ভাড়া কত, কোথায় কোথায় থামবে, চালক বা তার সহকারী কিংবা লাইসেন্স ঠিক আছে কিনা—তা নিয়ে বরাবরই অন্ধকারে থাকে যাত্রীরা। ফলে বাসে উঠে পড়ে নানা ধরনের বিপদে। ঢাকার গণপরিবহন সম্পর্কে প্রয়োজনীয় তথ্যের ঘাটতি রয়েছে বলে মনে করে ৬৯ শতাংশ ব্যবহারকারী।
ভাড়া নিয়ে চালক-যাত্রীর ঝগড়া স্বাভাবিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে। ভাড়া আদায় করতে গিয়ে যাত্রীর সঙ্গে চরম অসৌজন্যমূলক আচরণ হরহামেশাই করেন সুপারভাইজার। আবার বাসে তোলার সময় ‘ডেকে ডেকে’ তুললেও ‘ধাক্কা দিয়ে’ নামানোর অভিযোগও নতুন কিছু নয়। বিষয়টিও উঠে এসেছে সাসটেইনেবল আরবান ট্রান্সপোর্ট ইনডেক্সে। অধিকাংশ যাত্রী মনে করে, গণপরিবহন কর্মীদের ব্যবহার সৌজন্যমূলক নয়। তবে বাসের ভাড়া নিয়ে কিছুটা সন্তুষ্ট ব্যবহারকারীরা। প্রায় ৫৭ শতাংশ ব্যবহারকারী বাস ভাড়া নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছে।
ঢাকায় সমন্বিত, সুশৃঙ্খলা ও নিরাপদ চলাচল এবং পরিবহন ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলার লক্ষ্যে কাজ করছে ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ)।
রাজধানীর গণপরিবহন ব্যবহারকারীদের সিংহভাগই যে গণপরিবহন ব্যবস্থাপনা নিয়ে অসন্তুষ্ট তার সঙ্গে একমত প্রকাশ করেছেন সংস্থাটির ট্রাফিক ইঞ্জিনিয়ার আনিসুর রহমান। তিনি বলেন, ঢাকার জন্য কোম্পানিভিত্তিক বাস ব্যবস্থাপনা প্রবর্তনের কাজ চলছে। আগামী বছরের এপ্রিল নাগাদ ঢাকার অন্তত একটি রুটে পরীক্ষামূলক হিসেবে কোম্পানিভিত্তিক বাস চালুর পরিকল্পনা আমাদের রয়েছে। তবে ঢাকাজুড়ে এ ব্যবস্থা প্রবর্তনে সময় লাগবে। ঢাকার গণপরিবহন ব্যবস্থায় বিদ্যমান বেশির ভাগ সমস্যাই কোম্পানিভিত্তিক বাস ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে সমাধান করা সম্ভব বলে মনে করেন তিনি।
সূত্র: বণিক বার্তা