৫০ বছরে পররাষ্ট্রনীতি: একাত্তরের শত্রুও কাছে, বন্ধু ভারত আরো কাছে
গাজীপুর কণ্ঠ ডেস্ক : বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের অবদান কারো অজানা নয়। আর তখন পশ্চিম পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ করেই তো স্বাধীন হয়েছে বাংলাদেশ।
স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে এই দুই দেশসহ একাত্তরের সব ‘শত্রু-মিত্রের’ সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কটা কেমন?
বিশ্বের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে মুক্তিযুদ্ধের পর বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিপক্ষে অবস্থান নেয়া দেশগুলোর সাথেও সম্পর্ক স্থাপন করে বাংলাদেশ। তাই ভারত নয়, চীন এখন বাংলাদেশের বড় উন্নয়ন সহযোগী। তারপরও বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি এখন অনেকটাই ভারতমুখী বলে মনে করেন কোনো কোনো বিশ্লেষক।
এবার পাকিস্তানের প্রজাতন্ত্র দিবসে (২৩ মার্চ) বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান ও সেদেশের জনগণকে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। তিনি কোভিড আক্রান্ত ইমরান খানের সুস্থতাও কামনা করেছেন। আর ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী এবং বঙ্গবন্ধুর জন্ম শতবার্ষিকীতে ২৬ মার্চ, অর্থাৎ বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবসেই আসছেন ঢাকায়।
সাবেক পররাষ্ট্র সচিব তৌহিদ হোসেন মনে করেন জাতীয় দিবসে ইমরান খানকে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর এই শুভেচ্ছা একটি আনুষ্ঠানিকতা। এটা দিয়ে বন্ধুত্ব বা শত্রুতা নির্ধারণ করা যায় না। রিপাবলিক দিবসে এক দেশ আরেক দেশকে শুভেচ্ছা জানায়৷ বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক না হলেও জানায়।
তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানের পক্ষ নিয়ে অ্যামেরিকা, চীন ও সৌদি আরবসহ আরো অনেক মুসলিম দেশ বাংলাদের স্বাধীনতা চায়নি। কিন্তু তখন বিশ্ব ছিল দুই ব্লকে বিভক্ত৷ ভারত, রাশিয়া বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে কাজ করেছে। কিন্তু এখন বিশ্ব রাজনীতিতে পরিবর্তন এসেছে৷ বিশ্ব এখন বলতে গেলে এককেন্দ্রিক। তাই বাংলাদেশও আর কোনো ব্লকের দিকে নয়, সব রাষ্ট্রের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করে চলছে।
রাশিয়ার সাথে সম্পর্ক থাকলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সম্পর্ক থাকবে না, আবার ভারতের সাথে সম্পর্ক থাকলে চীনের সাথে থাকবে না- সেটা এখন আর হয়না। তাই বাংলাদেশ ভারতের সাথেও সম্পর্ক রাখছে, চীনের সাথেও সম্পর্ক রাখছে। রাশিয়ার সাথে সম্পর্ক আছে আবার যুক্তরাষ্ট্রের সাথেও সম্পর্ক আছে। বাংলাদেশের যে বিনিয়োগ দরকার, অবকাঠামো দরকার সেখানে ভারত তেমন কিছুই দিতে পারবে না। তাই চীনকে আমাদের লাগছে। কিন্তু ভারতের সাথেও আমাদের সুসম্পর্ক রাখতে হবে। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় প্রতিবেশী ভারত৷ আমাদের দেশের তিন দিকে তাদের অবস্থান।
বিশ্বরাজনীতি, ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব এবং ব্যবসা ও বিনিয়োগের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশের সাথেও সম্পর্ক রাখছে বাংলাদেশ৷ এখন বিশ্বপরিস্থিতিই এমন যে সবার সাথে সবার সম্পর্ক রাখতে হয়।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রহমান বলেন, ‘‘পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে স্থায়ী কোনো বন্ধু থাকে না, স্থায়ী কোনো শত্রু থাকে না। মুক্তিযুদ্ধের সময় চীন আমাদের তীব্র বিরোধিতা করলেও এখন সবচেয়ে বড় উন্নয়ন সহযোগী। আমার স্বার্থে যাকে প্রয়োজন, তার সঙ্গেই সম্পর্ক করা।’’
তিনি বলেন, ‘‘বঙ্গবন্ধুর এই কূটনৈতিক দূরদর্শিতা ছিল। আর এই কারণেই তিনি ১৯৭৫ সালের প্রথম দিকে কে এম কায়সারকে চীনে পাঠিয়েছিলেন, চীন যাতে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয় তা নিশ্চিত করতে। তিনি এটাও উপলব্ধি করেছিলেন যে, ইসলামি বিশ্বের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক জরুরি৷ আর সে কারণেই তিনি ওআইসি সম্মেলনে গিয়েছিলেন।’’
তিনি মনে করেন, সামনের দিনগুলোতে এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চল গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে। যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত মিলে চীনকে আটকানোর প্রক্রিয়া আছে। বাংলাদেশ এক্ষেত্রে কোনো দিকে না গিয়ে ভারসাম্য বজার রাখার যে অবস্থানে আছে তা অব্যাহত রাখতে হবে৷ তবে তার মতে, ‘‘ভারত দ্বিপাক্ষিক অনেক সমস্যারই সমাধান করছে না। আমাদের খেয়াল রাখতে হবে ভারত যেন সব সময় বেশি না নিয়ে নেয়।’’
তবে গত কয়েক বছরে বাংলাদেশের কূটনীতিতে ভারত নির্ভরতা বাড়ছে বলে মনে করেন সাবেক রাষ্ট্রদূত মেজর জেনারেল (অব.) শহীদুল হক। তিনি মনে করেন, স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের বিদেশ-নীতি বহুপাক্ষিক দিকেই ধাবিত হয়। আর সেটাই সঠিক। কিন্তু ১০-১২ বছরে আবার যেন বাংলাদেশ ভারত ব্লকভুক্ত হচ্ছে। বিশেষ করে গত দুই বছরে ভারতের ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভর হয়ে গেছে বাংলাদেশ। তবে তিনি মনে করেন, ‘‘এটা রাষ্ট্রের স্বার্থের চেয়ে দলীয় স্বার্থ বিবেচনায় হচ্ছে।’’ তার প্রশ্ন, ‘‘এখন বাংলাদেশের জন্য ভারতের কন্ট্রিবিউশন কী? তাহলে ভারতের ওপর কেন এই নির্ভরতা?’’
এই সাবেক কূটনীতিক আরো বলেন, ‘‘১৯৭৪ সালে পাকিস্তানে ওআইসি সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু গিয়েছিলেন ভারতকে উপেক্ষা করে। তিনি সেই ধরনের রাষ্ট্রনায়ক ছিলেন। তিনি দেশের স্বার্থটা দেখেছেন।’’
সূত্র: ডয়চে ভেলে