পাচারের সুযোগ কম বলেই কি কালো টাকা সাদার রেকর্ড?
গাজীপুর কণ্ঠ ডেস্ক : বিদায়ী অর্থবছরে রেকর্ড ২০ হাজার ৬০০ কোটি কালো টাকা সাদা হয়েছে। ১১ হাজার ৮৫৯ জন ব্যাক্তি কালো টাকা বৈধ করেছেন। দেশ স্বাধীনের পর কালো টাকা সাদা করা অতীতের সব রেকর্ড এবার ভেঙে গেছে।
করোনা মহামারির মধ্যে হঠাৎ করে এত কালো টাকা এল কোথা থেকে? কেনইবা প্রায় ১২ হাজার মানুষ কালো টাকা সাদা করলেন? জানতে চাইলে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অফ ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্রাটেজিক স্টাডিজের (বিআইআইএসএস) গবেষণা পরিচালক মাহফুজ কবীর বলেন, ‘‘বাংলাদেশে কালো টাকার উৎস তো কখনই জানা যায় না। আর এবার অনেক বেশি কালো টাকা সাদা হওয়ার দু’টো কারণ আমার কাছে মনে হয়েছে। প্রথমত, করোনার কারণে সারা বিশ্বই আক্রান্ত। যারা টাকা পাচার করেন তারা এই সময়ে পাচারের সুযোগটা পাননি। ফলে তাদের কাছে যে বিশাল অংকের টাকা রয়ে গেছে সেটা সরকারের বিশেষ সুযোগের ফলে সাদা করে নিয়েছেন। আর দ্বিতীয় কারণ হল, এর আগে কখনই কোন সরকার এমন সুযোগ দেয়নি, যেটা গত অর্থবছরে ছিল। সেটা হল, কালো টাকা সাদা করলে কেউ কোন ধরনের প্রশ্ন করতে পারবে না এবং পুরো টাকার উপর মাত্র ১০ শতাংশ কর দিলেই টাকাটা বৈধ হয়ে যাবে৷ এটা তো বিশাল সুযোগ।’’
বুধবার জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, কালো টাকা সাদা করার তালিকায় আছেন চিকিৎসক, সরকারি চাকরিজীবী, তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক, ব্যাংকের উদ্যোক্তা মালিক ও স্বর্ণ ব্যবসায়ীসহ আরও অনেকে। এর মধ্যে নগদ টাকা সাদা হয়েছে প্রায় ১৭ হাজার কোটি৷ ব্যাংক বা নগদে রাখা এই বিপুল পরিমাণ টাকা সাদা করেছেন প্রায় সাত হাজার ব্যক্তি। বাকি টাকা জমি-ফ্ল্যাট ও শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ হয়েছে। কালো টাকা সাদা করার ফলে ১০ শতাংশ কর হিসেবে এনবিআর ২ হাজার ৬০ কোটি টাকা রাজস্ব পেয়েছে।
এই বিপুল পরিমাণ কালো টাকা সাদা হলেও মূল কালো টাকার মালিকরা তাদের অর্থ সাদা করেননি বলেই মনে করেন পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর। তিনি বলেন, ‘‘সরকার বিশেষ সুবিধা দেওয়ার কারণে কিছু মানুষ কালো টাকা সাদা করেছেন। এদের মধ্যে আইনজীবী, চিকিৎসকসহ বিভিন্ন পেশাজীবী আছেন। এদের টাকাগুলো অপ্রদর্শিত ছিল। ১০ শতাংশ কর দিয়ে বৈধ করে নিয়েছেন। কিন্তু যারা কালো টাকার মালিক তারা কিন্তু তাদের টাকা সামনে আনেননি৷ যদিও সরকার বারবার এই সুযোগ দিচ্ছে, এটা অবশ্যই অনৈতিক। আমি মনে করি, এই সুযোগটা এখন সীমিত করতে হবে। এটা যদি অব্যাহত থাকে তাহলে বৈধ ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্থ হবেন।’’
২০০৭ সালের সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পর বর্তমান সরকারের তিন মেয়াদে একাধিকবার কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হলেও তেমন একটা কাজে লাগেনি। ওই তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে ৩২ হাজার ৫৫৮ জন ব্যক্তি কালো টাকা সাদা করার সুযোগ নিয়েছিলেন। তখন অবশ্য সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকার মতো কালো টাকা সাদা হয়েছিল। তখনও বিদায়ী অর্থবছরের মতো এত ঢালাওভাবে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হয়নি। এনবিআরের হিসেবে স্বাধীনতার পর থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে জরিমানা দিয়ে বৈধ করার মোট টাকার পরিমাণ প্রায় সাড়ে ১৮ হাজার কোটি।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘‘বারবার কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়াটা কালো টাকার মালিকদের ফুলের মালা দিয়ে বরণ করার মতো। এটা শুধু অন্যায়ই না, অনৈতিক, সুসাশনের পরিপন্থী ও সংবিধান বিরোধী। আপনি বৈধ ব্যবসায়ীদের অনুৎসাহিত করে অবৈধ টাকার মালিকদের বারবার সুযোগ দিয়ে যাচ্ছেন। মাত্র ১০ শতাংশ কর দিয়ে তারা অবৈধ টাকাকে বৈধ করে নিলেন, অথচ বৈধ ব্যবসায়ীদের কর দিতে হচ্ছে এর চেয়েও অনেক বেশি। তাহলে সরকার কী মেসেজ দিচ্ছে? তোমাদের বৈধ কর দিতে হবে না? এটা কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। দেখেন, সরকার বলছে, তারা এখান থেকে বড় ধরনের রাজস্ব আহরণ করবে। অথচ গত অর্থবছরে মহামারির মধ্যেই এনবিআর ২ লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আহরণ করেছে। এখন ২০ হাজার কোটি টাকা বৈধ করে এনবিআর কর পেয়েছে ২ হাজার ৬০ কোটি টাকা। এই টাকা এনবিআরের রাজস্বের এক শতাংশও না। তাহলে কেন এই কালো টাকার মালিকদের এই সুযোগ দিতে হবে?’’
কালো টাকার মালিকরা বিশেষ সুবিধা পাওয়ায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হন ব্যবসায়ীরা। বরাবরই ব্যবসায়ীরা এটার বিরোধিতা করে আসছেন। ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ড্রাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সভাপতি রিজওয়ান রাহমান বলেন, ‘‘আপনি আমাকে বলেন, কালো টাকা যদি ১০ শতাংশ কর দিয়ে সাদা করা যায়, অর্থাৎ বৈধ করা যায় তাহলে আমি কেন ব্যবসা করে ২৫-৩০ শতাংশ কর দেব? এ নিয়ে আমরা নিয়মিতই চেঁচামেচি করছি। তারপরে এবার বাজেটে কালো টাকা সাদা করার জন্য নিয়মিত ট্যাক্সের সঙ্গে ১০ শতাংশ অতিরিক্ত কর ধার্য্য করা হয়েছে। তাতেও সাড়ে ২৬ শতাংশের বেশি হবে না। স্বল্পোন্নোত দেশে এই সুবিধার দরকার হয়৷ কিন্তু সেটা কত দিনের জন্য? আমাকে যেভাবেই বোঝান না কেন বিশেষ সুবিধার কারণে টাকা পাচার না হয়ে দেশেই থেকে গেছে? যে পাচার করবে সে করবেই।’’
রিজওয়ান রাহমান বলেন, ‘‘এভাবে চলতে থাকলে বৈধ ব্যবসায়ীরা ট্যাক্স দিতে অনুৎসাহিত হবেন৷ কালো টাকা সাদা করতে গেলে কাউকে কোন প্রশ্ন করা যাবে না? এটা কেন? আমরা তো বৈধভাবে ব্যবসা করি, ট্যাক্স দেওয়ার সময় তো এনবিআর আমাদের এক লক্ষ প্রশ্ন করে? তাহলে কালো টাকা আপনি কোথা থেকে পেলেন সেটা কেন প্রশ্ন করা যাবে না? জাতীয় অর্থনীতিতে আপনার ভূমিকা কী? যে আপনাকে প্রশ্নই করা যাবে না? আসলে কালো টাকা আর অপ্রদর্শিত অর্থ এটা আলাদা করতে হবে। এখন একজন ব্যবসায়ী আগের বছর ব্যবসা করে কিছু ট্যাক্স কম দিয়েছেন, এবার ট্যাক্সটা তিনি দিয়ে টাকাটা বৈধ করছেন। এটা এক ধরনের৷ আর আরেকজন মাদক ব্যবসা করে টাকা উপার্জন করেছেন বা দুর্নীতির মাধ্যমে টাকা উপার্জন করেছেন, এই দুইটা বিষয় এক হয়ে যাচ্ছে। এখন মাদক চোরাকারবারীর কাছ থেকে ১০ শতাংশ কর নিয়ে তারা টাকাও সরকার বৈধ করে দিচ্ছে। দুর্নীতিবাজকেও বৈধ করে দিচ্ছে, এটা হতে পারে?’’
সূত্র: ডয়চে ভেলে