মুনশির সফরনামা
গাজীপুর কণ্ঠ ডেস্ক : ইতিহাস থেকে জানা যায়, পর্তুগিজ নাবিক এবং অভিযাত্রী ভাস্কো দা গামা ১৪৯৮ সালে প্রথম ইউরোপীয় ব্যক্তি হিসেবে সমুদ্রপথে ভারতে পৌঁছেছিলেন। তার প্রায় ১০০ বছর পরে (১৬০০ সালে) ব্রিটিশরা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ভারতবর্ষের মাটিতে পা রাখে। অবশ্য তার কিছু আগে ব্যক্তিগত উদ্যোগে খ্রিস্ট ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে ইউরোপ থেকে অনেক পাদরি বা ধর্মযাজক ভারতে আসেন। পরবর্তী সময়ে ১৬০৭ সালে রানী প্রথম এলিজাবেথের চিঠি নিয়ে সম্রাট জাহাঙ্গীরের কাছে দূত হয়ে এসেছিলেন স্যার থমাস রো। সে চিঠিতে রানী প্রথম এলিজাবেথ সম্রাটকে অনুরোধ করেছিলেন সম্রাট যেন ভারতবর্ষে ব্যবসার জন্য দোকান খোলার অনুমতি দান করেন।
তারপর সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ভারতবর্ষে অনেক ঘটনা ঘটেছে, গঙ্গা-যমুনা দিয়ে গড়িয়ে গেছে অনেক পানি। ভারত ও পূর্ব এশিয়ায় বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে ইংল্যান্ডের একদল বণিক ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি গঠন করে। অবশেষে একসময় ভারত থেকে বিলাতে যাওয়ার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। ভারতীয়রা আসলে বিলাতে ভ্রমণ শুরু করেছিল যখন ব্রিটিশরা ভারতে ঔপনিবেশিক কর্তৃত্ব প্রয়োগ করতে শুরু করে। প্রথম দিকে (অবশ্য কয়েকজন নামহীন এবং অপরিচিত লস্কর বা জাহাজের খালাসি ছাড়া) রাজা রামমোহন রায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মচারী হিসেবে মোগল সম্রাট দ্বিতীয় আকবর শাহর (১৭৬০-১৮৩৭) দূত হয়ে বিলাতে গিয়েছিলেন। জানা যায়, দীন মোহাম্মদ (১৭৫৯-১৮৫১) প্রথম ভারতীয় হিসেবে বিলাতের অভিবাসী হয়েছিলেন।
মির্জা শেখ ইতিসামুদ্দিন (মতান্তরে এহতেশাম উদ্দিন, পুরো নাম শেখ মির্জা সৈয়দ মোহাম্মদ ইতিসামুদ্দিন) অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি প্রথম বাঙালি মুসলমান হিসেবে ইউরোপ, নির্দিষ্ট করে যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্স সফর করেন। বিলাত থেকে ফিরে আসার পর লোকজনের মুখে তার পরিচয় হয় ‘বিলায়েত মুনশি’।
শেখ ইতিসামুদ্দিনের ইংল্যান্ড সফর ছিল গুরুত্বপূর্ণ। তিনি ইংল্যান্ডের তত্কালীন রাজা তৃতীয় জর্জের কাছে বাদশা দ্বিতীয় শাহ আলমের (জন্ম ১৭২৮ ও মৃত্যু ১৮০৬) ফারসিতে লেখা চিঠি যথাযথ ব্যাখ্যা করার জন্য ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সাবেক কর্মকর্তা ক্যাপ্টেন আর্চিবল্ড সুইনটনের সফরসঙ্গী হন ও ১৭৬৬ সালের জানুয়ারি মাসের শেষের দিকে একটি ফরাসি জাহাজে চেপে হুগলি থেকে লন্ডনের উদ্দেশে সমুদ্রযাত্রা করেন। বিলাতে তিন বছর অবস্থানের পরে তিনি ভারতে ফিরে আসেন এবং পুনরায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির চাকরিতে ফিরে যান। জানা যায়, সে সময় তিনি প্রথম অ্যাংলো-মারাঠা যুদ্ধের (১৭৭৫-৮২) সময় ইংরেজের হয়ে মারাঠাদের সঙ্গে কূটনৈতিক দেনদরবারে বেশ দক্ষতার পরিচয় দেন। পরিতাপের বিষয়, দেশে ফিরে আসার পর তিনি কোম্পানির কাছ থেকে পুরস্কার, বেতন বৃদ্ধি বা পদোন্নতি—এসব কিছুই পাননি। তার বাকি জীবনটা কোম্পানির মুনশি হিসেবেই কেটে যায়।
বিলাত থেকে ফিরে আসার অনেক পরে, ১৭৭৯ সালে মির্জা শেখ ইতিসামুদ্দিন তার সেই যাত্রা এবং বিলাতে অবস্থানের অভিজ্ঞতা নিয়ে ক্ল্যাসিক্যাল ফারসিতে রচনা করেন এক ভ্রমণ গ্রন্থ, যা অপ্রকাশিত ছিল বহুকাল। সে গ্রন্থে তিনি তার ভ্রমণের সময়কাল অনুসরণ করে বিলাত ও ফ্রান্সে যা দেখেছেন এবং যেসব নতুন নতুন পরিস্থিতির মোকাবেলা করেছেন, তার একটি সার্বিক ধারাবিবরণী এবং সেখানকার সমাজ, প্রতিষ্ঠান ও জীবনযাত্রা সম্পর্কে তার নিজস্ব মূল্যায়ন তুলে ধরেন ।
জেমস এডওয়ার্ড আলেকজান্ডার গ্রন্থটি ফারসি থেকে ইংরেজিতে ‘Shigurf Nama-e Vilayet’ বা ‘Excellent Intelligence concerning Europe, Being the Travels of Mirza Itesa Mpdeen’ শিরোনামে অনুবাদ করে ১৮২৭ সালে প্রকাশ করেন। সম্প্রতি গ্রন্থটি ‘The Wonders of Vilayet, Being the Memoir, Originally in Persian, of a Visit to France and Britain in 1765’ শিরোনামে ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন কায়সার হক, যা ২০০২ সালে প্রকাশিত হয়। তার এ ইংরেজি গ্রন্থটি এ বি এম হাবিবুল্লাহ অনূদিত ‘বিলায়েতনামা’ বাংলা গ্রন্থের ইংরেজি অনুবাদ এবং বাংলায় গ্রন্থটি ১৯৮১ সালে প্রকাশিত হয়। উল্লেখ্য, দুটি ফারসি পাণ্ডুলিপির ওপর ভিত্তি করে ‘বিলায়েতনামা’ গ্রন্থটি অনূদিত হয়েছে।
মির্জা শেখ ইতিসামুদ্দিনের সেই ঐতিহাসিক ভ্রমণ গ্রন্থে, যা কায়সার হক অনুবাদ করেছেন, বর্ণিত কিছু উল্লেখযোগ্য ঘটনা ও অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরা হলো।
মির্জা শেখ ইতিসামুদ্দিনের জন্ম তদানীন্তন ভারতবর্ষের নদিয়া জেলার চাকদহর পাঁচনুর গ্রামের অভিজাত মুসলিম পরিবারে আনুমানিক ১৭৩০ সালে এবং অনুবাদক কায়সার হকের মতে, আনুমানিক ১৮০০ সালে তিনি মারা যান। শৈশবে তিনি মুর্শিদাবাদের নবাব মীর জাফরের দরবারের মুনশি সলিমুল্লাহর কাছে ফারসি ভাষায় ব্যুত্পত্তি অর্জন করেন। তিনি বক্সার যুদ্ধের (২২-২৩ অক্টোবর ১৭৬৪) পর কোম্পানির কাজের সূত্রে বাদশা দ্বিতীয় শাহ আলমের অনুগ্রহে শাহি দরবারে মুনশি, অর্থাৎ দলিল লেখক বা কেরানি (তবে সেই সময় মুনশি বলতে ভাষাবিদ বা পণ্ডিত বোঝাত) পদে চাকরি পান ও বাদশা তাকে মির্জা খেতাবে ভূষিত করেন। কর্মদক্ষতার জন্য তিনি অচিরেই বাদশার দরবারে সভাসদ পদে উন্নীত হন। তার কাজ ছিল দোভাষীর ও তিনি অনুবাদকেরও দায়িত্ব পালন করেছেন। এছাড়া তিনি কোম্পানি এবং ভারতীয় কোনো শাসনকর্তার মধ্যে দ্বিপক্ষীয় আলোচনা কিংবা চুক্তি স্বাক্ষরের সময় মধ্যস্থতার ভূমিকাও পালন করতেন।
জানা যায়, মির্জা শেখ ইতিসামুদ্দিনের মনের মধ্যে পশ্চিমের প্রতি বিস্ময় শুরু হয় যখন তিনি হিজলি থেকে জীবনের প্রথম সমুদ্র যাত্রা শুরু করেন। তিনি তার সেই যাত্রাপথের বর্ণনা করেন। পথে প্রচণ্ড ঝড়ের সময় ইউরোপীয় নাবিকদের সাহস এবং দক্ষতা দেখে তিনি লিখেছেন, ‘তারা হনুমানের ক্ষিপ্রতার সঙ্গে সাহস নিয়ে পালের খুঁটির শীর্ষে উঠে এবং সেখান থেকে বাদুড়ের মতো ঝুলে থাকে।’
অবশেষে ক্যাপ্টেন সুইনটন ও মির্জা শেখ ইতিসামুদ্দিন দীর্ঘ ছয় মাস সমুদ্রযাত্রার পর ফ্রান্সের নান্তেস হয়ে ইংল্যান্ডের ডোভারে পৌঁছেন। ইংরেজ রমণী দর্শনের পর তার অনুভূতির কথা তিনি বর্ণনা করেছেন, ‘তাদের সুন্দরী মহিলাদের দর্শন নির্জনতার দুঃখ দূর করে এবং আমাকে খুব উৎসাহিত করেছে… মহিলারা হুরপরীদের মতো সুন্দর; তাদের সৌন্দর্য, এমনকি তাদের সুন্দর মুখ অবগুণ্ঠনের আড়ালে থাকলেও পরীরা রীতিমতো লজ্জা পেত… প্রশংসায় বাকরুদ্ধ হয়ে আমি মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে ছিলাম।’ তারপর একসময় ক্যাপ্টেন সুইন্টন এবং তিনি ডোভার থেকে লন্ডনে যান। সেখানে তার জন্য অপেক্ষা করেছিল অন্যরকম অনুভূতি এবং বিস্ময়। লন্ডন দেখার অনুভূতি তিনি প্রকাশ করেন, ‘পৃথিবীতে এত বড় বা সুন্দর কোনো শহর নেই।’ অথচ ভারতবর্ষে নিযুক্ত প্রথম ব্রিটিশ গভর্নর রবার্ট ক্লাইভ (১৭২৫-১৭৭৪) মনে করতেন যে, সেই সময় লন্ডন থেকে মুর্শিদাবাদ ছিল বৃহত্তর এবং আরো উজ্জ্বল।’ ক্রমান্বয়ে তিনি আরো অনেক জিনিসের সঙ্গে পরিচিত হন, যেসব আগে কখনো তার দেখার সৌভাগ্য হয়নি, যেমন কাচের দালান, পাবলিক থিয়েটার ও উন্মুক্ত এবং অনুপ্রবেশকারী পতিতালয়। তবে ব্রিটিশ জাদুঘরে তিনি এমন কিছু জিনিস দেখেছেন, যা তার কাছে অদ্ভুত কিন্তু পরিচিত লেগেছে, বিশেষ করে বইপুস্তক, যেমন বেদ এবং নাগরী, বাংলা ও ডেকানিজ লিপিতে লিখিত হিন্দুদের শাস্ত্র।
মির্জা শেখ ইতিসামুদ্দিন অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে প্রথম পদার্থবিদ্যার গবেষণাগারে টেলিস্কোপ এবং মানুষের কংকাল দেখেন। শুধু তাই নয়, সেখানে তিনি লাইব্রেরিতে রক্ষিত ফারসি এবং তুর্কি (উভয়ই?) ভাষায় লেখা চিঠি ইংরেজিতে তরজমা করেছেন, কেননা ‘তখন ইংল্যান্ডের কেউ সেই দুই ভাষা ভালো মতো জানত না।’ এছাড়া সেখানে তিনি স্যার উইলিয়াম জোনসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। স্যার জোন্স সামান্য ফারসি জানতেন। তিনি ছিলেন একজন ওয়েলশ ফিলোলজিস্ট। উল্লেখ্য, তিনি ‘ওরিয়েন্টাল জোন্স’ নামে পরিচিত ছিলেন। পরবর্তী সময়ে (১৭৮৬ সালে) তিনি বাংলার সর্বোচ্চ আদালতের বিচারক নিযুক্ত হয়েছিলেন ও ১৭৯৪ সালে কলকাতায় তার মৃত্যু হয়।
একসময় মির্জা শেখ ইতিসামুদ্দিন ক্যাপ্টেন সুইন্টনের সঙ্গে স্কটল্যান্ডে তার আদি বাড়িতে আতিথেয়তা গ্রহণ করেন। সেখানে তিনি জীবনের প্রথম তুষারপাত দেখে বর্ণনা করেছেন এভাবে: ‘এটা আবিরের মতোই, যা হোলি উৎসবে হিন্দুরা একে অপরের উপর ছিটিয়ে দেয়। শুধু পার্থক্য হলো—এটা ধবধবে সাদা।’ এছাড়া সেখানে তিনি জিনিসপত্রের, বিশেষ করে খাবারদাবারের সস্তা দাম দেখে (অবশ্য পাউন্ড স্টার্লিংকে ভারতীয় মুদ্রায় পরিবর্তন করে) রীতিমতো অবাক হন। তিনি লিখেছেন, ‘মাত্র কয়েক পয়সার বিনিময়ে এক টুকরো রুটি, কিছু পরিমাণ মাংস এবং আধাসের বিয়ার ক্রয় করা যায়।’ তার দীর্ঘ ভ্রমণের সময় তিনি খাদ্য ও ব্রিটিশ সমাজের অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরেছেন, এমনকি তিনি শিল্প ও সাহিত্যের প্রতি তাদের আবেগ সম্পর্কে মন্তব্য করেন। তিনি এক পর্যায়ে উল্লেখ করেছেন, ‘এই দেশে (ইংল্যান্ডে) জ্ঞান এবং শিল্পকলাসমৃদ্ধ না হলে অবাক হতে হবে।’
মির্জা শেখ ইতিসামুদ্দিন তার স্মৃতিকথার শেষ কয়েকটি পরিচ্ছেদে শুধু ভ্রমণকাহিনী কিংবা নিত্যনতুন অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেননি বরং বৃটেন ও ভারতের মধ্যে একাধিক পার্থক্য উল্লেখ করেছেন, বিশেষ করে ধর্মীয় বিশ্বাস, শিক্ষা, প্রশাসন এবং আইন ব্যবস্থার পর্যালোচনা করেছে। সমাজতত্ত্ব কিংবা ইতিহাস নিয়ে আগ্রহী যে কারো জন্য ইতিসামুদ্দিনের এ রচনা মূল্যবান। যা হোক, তিনি যত বেশি ব্রিটিশদের পর্যবেক্ষণ করেছেন, ততই তিনি ব্রিটিশ জনগণের নিখুঁত শিল্প এবং উদ্ভাবনশীলতার ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। একসময় তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, কেন এবং কীভাবে তারা ভারতবর্ষে আধিপত্য বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছিল।
মির্জা শেখ ইতিসামুদ্দিন ছিলেন ধর্মীয় বিশ্বাসে একজন খাঁটি মুসলমান। তিনি ছিলেন এমন এক ব্যক্তি, যিনি পশ্চিমা সমাজের মধ্য দিয়ে ভ্রমণকারী হিসেবে ইসলামের ওপর তার অগাধ বিশ্বাস ও সংস্কৃতিকে শক্তিশালী প্রমাণ করেছেন। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, বিলাতের তার অবস্থানের প্রায় শেষদিক পর্যন্ত তিনি তার নিজস্ব পাচক মোহাম্মদ হাকিমের সংগ্রহ এবং রান্না করা হালাল খাবার খেয়েছেন। বলা বাহুল্য সেসব খাবার তার জন্য আলাদা রান্না করা হতো। উল্লেখ্য, মোহাম্মদ হাকিমকে তিনি ভারত থেকে সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু একসময় ক্যাপ্টেন সুইন্টন তাকে জোর করতে শুরু করে যে, যখন তারা ভ্রমণে থাকবেন, তখন তিনি যেন মোহাম্মদ হাকিমকে সঙ্গে করে না নিয়ে যান এবং সুইন্টন ও অন্যরা যা খায়, তাকে তা-ই খেতে হবে। এ নিয়ে তাদের মধ্যে রীতিমতো বৈরী সম্পর্ক তৈরি হয়। ক্যাপ্টেন সুইন্টন বলেছেন, “তিনি যদি আমাদের মাংস না খান কিংবা আমাদের মদিরা পান করেন না, তাহলে তার একমাত্র ব্যাখ্যা হতে পারে, ইতিসামুদ্দিন একজন নিরেট বাঙালি এবং বাঙালিরা ভারতীয়দের মধ্যে মূর্খ, এমনকি মূর্খতার জন্য তারা কুখ্যাত।”
পুরো জাতির প্রতি ক্যাপ্টেন সুইন্টনের সেই অপমানের জবাব তিনি বেশ উচ্চৈঃস্বরে দিয়েছিলেন, ‘মুসলমানদের মধ্যে প্রকৃত আভিজাত্য পার্থিব সম্পদ দিয়ে পরিমাপ করা হয় না, বরং জ্ঞান অর্জন, সরল জীবনযাপন, আল্লাহর আইন মেনে চলা নিয়ে গঠিত পথই আসল মাপকাঠি।’ এছাড়া গ্রন্থের অন্যত্র তিনি নিজেকে একজন বিশ্বস্ত এবং আপসহীন মুসলমান হিসেবে তুলে ধরেছেন, যা বর্তমান পরিভাষায় হয়তো ‘মৌলবাদী’ বলে মনে হতে পারে, যেমন যখন তিনি চার স্ত্রীর উপস্থিতি সমর্থন করার কথা বলেন।
তবে এ কথা সত্যি, মির্জা শেখ ইতিসামুদ্দিন ব্রিটেন সম্পর্কে পুরোপুরি একচোখা ছিলেন না। ধনবান ইংরেজরা যেভাবে দরিদ্র মানুষকে অবজ্ঞার চোখে দেখত, তিনি তার সমালোচনা করে বলেন, ইসলামের মধ্যে দরিদ্র হওয়া কোনো অপমানজনক বিষয় নয়। তিনি সেই সময় ব্রিটিশ ন্যায়বিচারের কঠোরতা সম্পর্কেও মন্তব্য করতে দ্বিধা করেননি। এছাড়া তিনি পর্যবেক্ষণ করেছেন, ইসলামের ধর্মীয় অনুশাসনের মতে, একজন চোরের হাত কেটে ফেলা হয়, অথচ ব্রিটেনে চুরির দায়ে দোষী সাব্যস্ত কাউকে ফাঁসি দেয়া হতে পারে। তার পরও তিনি দেখেছেন, ‘ইংল্যান্ডে পকেটমার, ছিঁচকে চোর এবং ডাকাতদের সংখ্যা প্রচুর।’
যা হোক, যদি কেউ অ-ইউরোপীয় দৃষ্টিভঙ্গিতে অষ্টাদশ শতাব্দীর ব্রিটেন সম্পর্কে জানতে আগ্রহী হন, তবে গ্রন্থটি নিঃসন্দেহে একটি আকর্ষণীয় দলিল। কারণ বইটি অষ্টাদশ শতাব্দীর ব্রিটেন সম্পর্কে একটি অনন্য দৃষ্টিভঙ্গি ধারণ করেছে। এছাড়া গ্রন্থটি ভারতের একজন শিক্ষিত ব্যক্তির ব্রিটেন সফরকারীর প্রথম বিবরণ। যদিও জাহাজের খালাসীরা মির্জা শেখ ইতিসামুদ্দিনের আগে থেকেই ইউরোপ ভ্রমণ করছিল, কিন্তু সেসব লোক নিরক্ষর ছিল এবং তারা কোনো কিছু লিপিবদ্ধ করে রাখেনি।
পরিশেষে বলা যায়, আঠারো শতকের মধ্যভাগের বৃটেন ও ব্রিটিশ সমাজ নিয়ে রচিত আকর্ষণীয় এবং তথ্যসমৃদ্ধ বইটির একটি বিশেষ ইতিবাচক দিক হলো, মির্জা শেখ ইতিসামুদ্দিন নিজেই পশ্চিমের কাছে যতটা বিস্ময়ের ছিলেন, পশ্চিমারাও তার কাছে ততটাই বিস্ময়কর ছিল। অন্যভাবে বলা যায়, ‘তিনি ইউরোপ দেখেছেন এবং ইউরোপও তাকে দেখেছে।’
তথ্যসূত্র
১. Harish Trivedi (2003), The First Indian in Britain or The Wonders of Vilayet, Indian Literature, Vol. 47, No. 6 (218) (Nov-Dec 2003), pp. 169-177, Published By: Sahitya Akademi
২. Kaiser Haq (2001), The Wonders of Vilayet, Being the Memoir, originally in Persian, of a Visit to France and Britain in 1765 Mirza Sheikh I’tesamuddin, (English translation), Peepul Tree Press, Leeds, UK.
অনুবাদক ও লেখক: ফজল হাসান