‘বন্দুকযুদ্ধ’ নিয়ে মন্তব্যে: ‘অস্ত্রধারীদের ধরতে গেলে এমন হবেই’

গাজীপুর কণ্ঠ ডেস্ক : দেশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দাবি করা বন্দুকযুদ্ধে আবারো নিহতের ঘটনা ঘটছে। মানবাধিকারকর্মী নূর খানের মতে এর মধ্য দিয়ে সমাজে ভীতিকর অবস্থা তৈরি করা হচ্ছে৷ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বলেন, ‘অস্ত্রধারীদের ধরতে গেলে এমন হবেই’।

কুমিল্লার ১৭ নাম্বার ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও মহানগর আওয়ামী লীগের সদস্য মো. সোহেল ও তার সহযোগী হরিপদ সাহা হত্যা মামলার তিন আসামি পুলিশের কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছেন। প্রথমে দুইজন ও তার ৪৮ ঘণ্টার ব্যবধানে আরো একজন নিহত হন৷ তারা হলেন: সাব্বির হোসেন, সাজন ও শাহ আলম।

২২ নভেম্বর বিকালে কাউন্সিলর সোহেল ও হরিপদ সাহাকে তাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ভিতরে ঢুকে গুলি করে হত্যা করা হয়। পরের দিন সোহেলের ভাই মো. রুমান বাদী হয়ে ১১ জন আসামির নাম উল্লেখ করে হত্যা মামলা দায়ের করেন। এজাহারে আরো সন্দেহভাজন অজ্ঞাত আট-দশজনের কথা বলা হয়েছে। এরমধ্যে এজাহারভুক্ত পাঁচ ও সন্দেহভাজন দুইজনকে পুলিশ প্রেপ্তার করেছে। যে তিনজন নিহত হয়েছেন তারা এজাহারভুক্ত আসামি।

সাব্বির ও সাজন সোমবার দিবাগত রাত ১২টা ৪৫ মিনিটের দিকে গোমতী নদীর তীরে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন বলে দাবি করে কুমিল্লার ডিবি পুলিশ। তারা তিন ও পাঁচ নাম্বার আসামি ছিলেন। মামলার এক নাম্বার আসামি শাহ আলমও মঙ্গলবার দিবাগত রাত ১টা ১৫ মিনিটের দিকে গোমতী নদীর তীরে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন বলে দাবি করা হয় পুলিশের পক্ষ থেকে।

মামলার বাদী এবং কাউন্সিলর সোহেলের ভাই মো. রুমান অভিযোগ করেন, ‘‘এই হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে আরো অনেকে আছেন৷ কেউ অর্থ দিয়েছেন। কেউ অস্ত্র দিয়েছেন। আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদের মাধ্যমে তাদের নাম বেরিয়ে আসার কথা।’’ তিনি বলেন, ‘‘এক নাম্বার আসামিসহ প্রধান তিনজন আসামি ক্রসফায়ারে মারা গেছে। আইন শৃঙ্খলা বাহিনী কাজ করছে। ক্রসফায়ারে মারা যেতেই পারে। কিন্তু তারা থাকলে জিজ্ঞাসাবাদে আরো তথ্য পাওয়া যেত।’’

তবে কুমিল্লা সদর কোতোয়ালি মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি ) আনোয়ারুল আজিম দাবি করেন, ‘‘সোহেল হত্যা মামলার তিন আসামি ক্রসফায়ারে নয়, বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছে। আমরা অপরাধীদের গ্রেপ্তারে অভিযান চালালে তারা পুলিশের ওপর গুলি করে। আত্মরক্ষার্থে পুলিশও গুলি করে। আমরা ওখান থেকে অস্ত্রও উদ্ধার করেছি।’’

এখানেই শেষ নয়, রোববার ভোরে দেশের দক্ষিণের জেলা ভোলার চরফ্যাশান উপজেলার চর কুকরি মুকরি এলাকায় র‍্যাবের সঙ্গে অজ্ঞাত দুই ব্যক্তি বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছেন বলে বাহিনীটির পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে। তাদের ভাষ্য অনুযায়ী নিহতরা জলদস্যু ছিলেন।

কক্সবাজারে গত বছরের ২১ জুলাই রাতে পুলিশের গুলিতে মেজর (অব.) সিনহা হত্যাকাণ্ডের পর পুলিশ সেটিকে বন্দুকযুদ্ধ বলে ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করলেও পরে ব্যর্থ হয়। এই ঘটনা তখন সারাদেশে আলোড়ন ফেলে। সিনহা হত্যাকাণ্ডের পর ব্যাপক সমালোচনার মুখে কিছু দিন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কথিত বন্দুকযুদ্ধ বন্ধ থাকলেও এখন তা আবার শুরু হয়েছে। মানবাধিকার সংস্থাগুলো এই ধরনের মৃত্যুকে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড হিসেবেই অভিহিত করে আসছে।

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) হিসাবে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ১০ মাসে ক্রসফায়ার বা বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছেন ৫৪ জন৷ র্যাব ও পুলিশসহ অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের হাতে ২০২০ সালে মোট নিহত হয়েছেন ১৯৬ জন।

আসকের সাধারণ সম্পাদক ও মানবাধিকার কর্মী নূর খান বলেন, ‘‘সিনহা হত্যাকাণ্ডের পর অল্প কয়েকদিন ক্রসফায়ার কম ছিল, কিন্তু এটা সব সময়ই চলমান। কখনও গুম বাড়ে তো ক্রসফায়ার কমে, ক্রসফায়ার বাড়েতো গুম কমে।এটা হলো কৌশল।’’

কুমিল্লায় ওয়ার্ড কাউন্সিলর হত্যা মামলার তিন আসামি নিহতের ঘটনা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘‘জিজ্ঞাসাবাদের নামে তাদেরকে ঠান্ডা মাথায় হত্যা করা হয়েছে বলে মনে করার যথেষ্ট কারণ আছে। একজন বন্দিকে নিরাপত্তা দিতে আইনশৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনী ব্যর্থ হচ্ছে। এই ধরনের হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে সমাজে একটা ভীতিকর অবস্থা তৈরি করা, সেই ভীতির মধ্য দিয়ে মানুষকে দমিত করে রাখা এবং সেটার মধ্য দিয়ে এক ধরনের কবরের শান্তি খুঁজে ফেরা, সেটি হচ্ছে ক্রসফায়ার।’’

আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কথিত ক্রসফায়ার বা বন্দুকযুদ্ধের ঘটনাকে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড হিসেবে মানতে নারাজ সরকার।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, ‘‘ক্রসফায়ার বলে কিছু হয় না৷ এগুলো ক্রিমিনাল অ্যাক্টিভিটিস বেড়ে গিয়েছিলো তাই। কুমিল্লায় দেখেন নাই, নয়জন ডাইরেক্ট শুট করতে করতে পালিয়ে যায়। এগুলো অস্ত্রধারী। অস্ত্রধারীদের ধরতে গেলে তো এরকম হবেই। এটা হয়ই, সেরকমই হয়েছে৷ এটা বন্দুকযুদ্ধ। এটা ক্রসফায়ার না।’’ এমন ঘটনার তদন্ত হয় উল্লেখ করে মন্ত্রী জানান, ‘‘একজন ম্যাজিষ্ট্রেট প্রত্যেকটা ঘটনার তদন্ত করেন।’’

এর আগে গত বছর ধর্ষণকারীদের ‘ক্রসফায়ারে’ হত্যার সমর্থন জানিয়ে জাতীয় সংসদে বক্তব্য দিয়েছিলেন কয়েকজন সংসদ সদস্য, যা নিয়ে তখন সমালোচনা হয়েছিল। সম্প্রতি ঢাকায় একটি অনুষ্ঠানে শিল্প প্রতিমন্ত্রী কামাল আহমেদ মজুমদারও ‘ক্রসফায়ার’ সমর্থন করে বক্তব্য দেন বলে স্থানীয় গণমাধ্যমগুলোতে খবর প্রকাশিত হয়।

 

সূত্র: ডয়চে ভেলে

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button