আদ্যোপান্ত: কালীগঞ্জে পল্লী বিদ্যুতের ২০ লাখ টাকার ক্যাবল চুরি, উদ্ধার ও তদন্তে ‘ব্যর্থ’ পুলিশ!

গাজীপুর কণ্ঠ ডেস্ক : গাজীপুর পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির কালীগঞ্জ জোনাল অফিসের কম্পাউন্ডের ভেতর থেকে প্রায় ২০ লাখ টাকা মূল্যমানের আন্ডারগ্রাউন্ড ক্যাবল চুরির ঘটনার পর তিন মাস অতিবাহিত হলেও চোরাই মালামাল উদ্ধার এবং ঘটনার রহস্য উদ্ঘাটন করতে ব্যর্থ হয়ে তড়িঘড়ি করে মামলার তদন্ত কার্যক্রমের ইতি টেনে দিয়েছে পুলিশ।
যদিও চুরির ঘটনায় জড়িত রয়েছে এমন সন্দেহে চারজনকে গ্রেপ্তার করেছিল পুলিশ। তাদের মধ্যে দু’জনকে আবার রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদও করা হয়েছিল।
তবে পুলিশ এখন বলছে, ‘’গ্রেপ্তার চারজনের বিরুদ্ধে কোন সাক্ষ্য-প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে না তাই তাদের মামলা থেকে অব্যাহতি দেয়া প্রয়োজন!’’
জানা গেছে, ক্যাবল চুরির ঘটনা গত ১৯ জানুয়ারি কালীগঞ্জ জোনাল অফিসের ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার (ডিজিএম) কামরুজ্জামান বাদী হয়ে অজ্ঞাত আসামিদের বিরুদ্ধে কালীগঞ্জ থানায় মামলা দায়ের করেন। এরপর দুই মাস ১২ দিন মামলার তদন্ত কার্যক্রম চালিয়ে জড়িত কোন আসামিকে শনাক্ত করতে পারেনি পুলিশ। এছাড়াও চোরাই মালামাল উদ্ধারেও ব্যর্থ হয়েছে পুলিশ। কিন্তু এরপর আর কোন চেষ্টা না করেই মামলার তদন্ত কার্যক্রমের ইতি টানতে গত ৩১ মার্চ আদালতে চুড়ান্ত প্রতিবেদন (সত্য) দাখিল করেছে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা কালীগঞ্জ থানার উপপরিদর্শক (এসআই) ইসলাম মিয়া।
যা ঘটেছিল
বাদীর বর্ণনা অনুযায়ী, গাজীপুর পল্লী বিদ্যুৎ-এর কালীগঞ্জ জোনাল অফিসের নিজস্ব কম্পাউন্ডের ভেতরে থাকা মসজিদের দক্ষিণ পাশে অবস্থিত খোলা স্টোরে ১১ কেভি/৩৩ কেভি আন্ডারগ্রাউন্ড ক্যাবলের ড্রামসহ বিদ্যুতের অন্যান্য মালামাল সংরক্ষণ করা থাকে। বিভিন্ন সময় স্টোরে মালামাল আসে ও যায়। মালামাল এবং গোটা অফিসের নিরাপত্তার দায়িত্বে ১০ জন আনসার বাহিনীর সদস্য নিয়োজিত রয়েছে। আনসার সদস্যরা তাঁদের নিজস্ব রুলস অনুযায়ী পালা করে দায়িত্ব পালন করে। গত ১০ জানুয়ারি সকাল সাড়ে দশটার দিকে জোনাল অফিসের মালি জজ মিয়া (৪২) মসজিদের পশ্চিম পাশে অবস্থিত নিজস্ব পুকুর পাড়ের আগাছা পরিষ্কার করতে গিয়ে দেখে পুকুরের পশ্চিম পাশে আন্ডারগ্রাউন্ড ক্যাবলের কয়েকটি কাভার আংশিকভাবে পানিতে ভেসে আছে। পরে সে বিষয়টি ডিজিএমকে জানায়। পরবর্তীতে ডিজিএমসহ অফিসের জুনিয়র ইঞ্জিনিয়ার ওমেদ আলী, লাইন টেকনেশিয়ান সেলিম রেজা, মিটার টেস্টিং সুপারভাইজার সাইফুল ইসলাম, এনফোর্সমেন্ট কো-অর্ডিনেটর খাইরুল বাশার, ওয়ারিং পরিদর্শক নাহারুল ইসলামসহ অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে। সে সময় পুকুরে ক্যাবলে ভাসতে দেখে। তাৎক্ষণিক মসজিদের পূর্ব পাশের স্টোরে রাখা আন্ডারগ্রাউন্ড ক্যাবলের একটি ড্রাম খালি অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখা যায়। সে সময় তারা ধারাণা করেন ২০২১ সালের ২৫ডিসেম্বর রাত ১০টা থেকে ২০২২ সালের ১০ জানুয়ারি সকাল ছয়টার মধ্যবর্তী যে কোন সময়ে সংঘবদ্ধ চোর চক্র ঘটনাস্থল থেকে আন্ডারগ্রাউন্ড ক্যাবলের একটি ড্রাম কৌশলে পুকুর পাড়ের পশ্চিম-দক্ষিণ পাশে নিয়ে যায় এবং ক্যাবলের কভার কেটে ইন্সুলেশনের ভেতর থেকে তামার তার বাহির করে প্রায় ১৯ লাখ ২৫ হাজার টাকা মূল্যমানের মালামাল চুরি করে নিয়ে যায়। চুরি করে নিয়ে যাওয়া তারের বিবরণ XLPE Power cable 500 mm2, size cu 11 kv, F-4B , 275 MTR, POLY CABLES।
মামলা ও তদন্ত কমিটি
ঘটনার ৮ দিনপর গত ১৯ জানুয়ারি কালীগঞ্জ জোনাল অফিসের ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার (ডিজিএম) কামরুজ্জামান বাদী হয়ে অজ্ঞাত আসামিদের বিরুদ্ধে কালীগঞ্জ থানায় মামলা দায়ের করেন [মামলা নাম্বার ১২(১)২২]।
এছাড়াও গাজীপুর পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-১ ঘটনা তদন্তে পাঁচ সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করে। তদন্ত কমিটি ঘটনার তদন্ত শেষে ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনার প্রতিরোধে সুপারিশসহ ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ উল্লেখ করে প্রতিবেদন দাখিল করেছে।
যাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছিল
মামলা দায়েরর ১৮ দিন পর ঘটনায় জড়িত রয়েছে এমন সন্দেহে গত ৭ ফেব্রুয়ারি কালীগঞ্জ থানার বাহাদুরসাদী ইউনিয়নের ধোলাসাধুখাঁ গ্রামের জসিম উদ্দিনের ছেলে সাব্বির (২০) এবং ঈশ্বরপুর এলাকার মানিকের ছেলে ইমনকে (১৭) আদালতে পাঠায় পুলিশ।
আদালতে পাঠানো প্রতিবেদনে পুলিশ উল্লেখ করে, ‘গ্রেপ্তার দু’জন ঘটনার পূর্বে, পরে এবং ঘটনার সময় ঘটনাস্থল কম্পাউন্ডের ভেতরে সন্দেহজনকভাবে ঘোরাফেরা করে বলে দেখা গেছে। জিজ্ঞাসাবাদের তারা কোন সন্তোষ জনক জবাব দিতে পারে নাই। তারা ঘটনায় জড়িত রয়েছে বলে তাদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য-প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে। তাই আসামি জামিনে মুক্তি পেলে পলাতক হতে পারে। তখন তদন্ত কার্যক্রমে বিঘ্ন ঘটানোর সম্ভাবনা রয়েছে। তাই মামলার সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচারের স্বার্থে তদন্ত শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত তাদের জেল হাজতে আটকে রাখা দরকার। প্রয়োজনে তাদের রিমান্ডের আবেদন করা হবে।’
এর এক সপ্তাহ পর ১৪ ফেব্রুয়ারি ভাদার্ত্তী এলাকার মিজানুর রহমানের ছেলে জসিম মিয়াকে (৪০) গ্রেপ্তার করে সাত দিনের রিমান্ড চেয়ে আদালতে পাঠানো হয়। পরে আদালত এক দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করে। এরপর ১৮ ফেব্রুয়ারি তাকে রিমান্ডে নেয় পুলিশ। একদিন জিজ্ঞেসাবাদ শেষ করে ১৯ ফেব্রুয়ারি তাকে পূণরায় আদালতে পাঠানো হয়।
রিমান্ড শেষে আদালতে পাঠানো প্রতিবেদনে পুলিশ উল্লেখ করে, “জসিমকে রিমান্ডে নিয়ে ব্যাপকভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলে সে তার দোষ কৌশলে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। এছাড়া মামলার ঘটনার বিষয়ে সে যে সকল তথ্য প্রদান করছে তা যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। তাই মামলার সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে তদন্ত কাজ সম্পন্ন হওয়ার আগ পর্যন্ত তাকে জেল হাজতে রাখা প্রয়োজন।”
অপরদিকে নরসিংদী জেলার পলাশ থানার একটি মামলায় গাজীপুর কারাগারে বন্দি থাকা রায়পুরা থানার মরজাল এলাকার সাদেক মিয়ার ছেলে কবির হোসেন কাউছার (৩০) নামে এক আসামিকে সাতদিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য গত ২৪ ফেব্রুয়ারি বিশেষ সুপারিশসহ আদালতে আবেদন করে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা। পরে গাজীপুরের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট (আমলি) আদালতের বিচারক ইসরাত জেনিফার জেরিন এক দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করে। এরপর তাকে কারাগার থেকে রিমান্ডে থানায় নিয়ে জিজ্ঞেসাবাদ শেষ করে ৯ মার্চ পূণরায় আদালতে পাঠানো হয়।
তাকে রিমান্ড শেষে আদালতে পাঠানো প্রতিবেদনেও পূর্বের ন্যায় পুলিশ একই তথ্য উল্লেখ করেছে, “কবির হোসেন কাউছারকে রিমান্ডে নিয়ে ব্যাপকভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলে সে তার দোষ কৌশলে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। এছাড়া মামলার ঘটনার বিষয়ে সে যে সকল তথ্য প্রদান করছে তা যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। তাই মামলার সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে তদন্ত কাজ সম্পন্ন হওয়ার আগ পর্যন্ত তাকে জেল হাজতে রাখা প্রয়োজন।”
চোরাই কাজে ব্যবহৃত সরঞ্জাম জব্দ
চোরাই মালামাল উদ্ধার করতে ব্যর্থ হলেও গত ২২ জানুয়ারি সকাল সাড়ে দশটার দিকে ঘটনাস্থল থেকে চোরাই কাজে ব্যবহৃত বেশকিছু সরঞ্জাম জব্দ করেছে পুলিশ। জব্দ করা সরঞ্জামের মধ্যে রয়েছে, দুই হাতল বিশিষ্ট তিন ফিট লম্বা কালো কসটেপ পেঁচানো ক্যাবেল কাটার একটি, প্লাস্টিকের কভারসহ ৮ ইঞ্চি লম্বা সেলাই রেঞ্জ একটি, দুই কেজি ৩০০ গ্রাম তামার তার এবং ফ্রেমসহ হ্যাকসো ব্লেড একটি।
চুড়ান্ত প্রতিবেদন
থানা থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী জানা গেছে, গত ৩১শে মার্চ কালীগঞ্জ থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) আনিসুর রহমান এবং কালীগঞ্জ সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ফারজানা ইয়াসমিনের স্বাক্ষর যুক্ত চূড়ান্ত প্রতিবেদনে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এসআই ইসলাম মিয়া উল্লেখ করেন “সার্বিক তদন্তে অজ্ঞাত আসামিদের বিরুদ্ধে মামলার ঘটনার প্রাথমিক সত্যতা প্রতীয়মান হইলেও তদন্তকালে সন্ধিগ্ধ গ্রেপ্তার চার আসামি জড়িত থাকার বিষয়ে কোনো সাক্ষ্য-প্রমাণ পাওয়া যায় নাই। তাই গ্রেপ্তার চার জনকে মামলার দায় থেকে অব্যাহতি প্রদান করা প্রয়োজন।”
“তদন্তকালীন প্রাপ্ত সাক্ষ্য-প্রমাণে এবং ঘটনার পারিপার্শ্বিকতায় মামলার ঘটনাটি অজ্ঞাত আসামিদের বিরুদ্ধে প্রাথমিক সত্যতা প্রতিয়মান হইলেও তদন্তকালে গ্রেপ্তার সন্ধিগ্ধ চার জনের বিরুদ্ধে মামলার ঘটনায় জড়িত থাকার কোনো সাক্ষ্য-প্রমাণ পাওয়া যায় নাই। তাই তাদের মামলা থেকে অব্যাহতি দেয়ার জন্য আবেদন করা হলো (চুড়ান্ত প্রতিবেদন সত্য নং ৮)। মামলার ফলাফল অবহিত করা হয়েছে।”
সংশ্লিষ্টদের বক্তব্য
গ্রেপ্তার সাব্বির ও ইমনের দুইজন স্বজন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বলেন, গত ৫ ফেব্রুয়ারি রাত ১১টার দিকে সাব্বির ও ইমন বাড়ির পাশের সড়কে একটি ব্রিজে বসে গল্প করছিল। সে সময় তাদেরকে আটক করে থানায় নিয়ে যায় পুলিশ। পরের দিন তাদের থানায় আটকে রেখে ৭ ফেব্রুয়ারি দুপুরে ছেড়ে দেয়ার কথা বলে ১৮ হাজার টাকা নিয়েছে এসআই ইসলাম মিয়া। কিন্তু তাদের ছেড়ে না দিয়ে ওইদিন বিকলে পল্লী বিদ্যুতের তার চুরির ঘটনায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে সাব্বির ও ইমনকে আদালতে পাঠিয়ে দেয় পুলিশ। মানুষের কাছ থেকে ঋণ করে পুলিশকে টাকা দেয়ার পরও জেল খাটতে হয়েছে সাব্বির আর ইমনকে। পরে ১৪ ফেব্রুয়ারি ইমন এবং ৭ মার্চ সাব্বির জামিনে মুক্ত হয়েছে।
পাঁচ সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটির প্রধান গাজীপুর পল্লী বিদ্যৎ সমিতি-১ এর পূবাইল জোনাল অফিসের ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার (ডিজিএম) প্রকৌশলী ইউসুফ আলী বলেন, “তদন্তে তার চুরির প্রমাণ পাওয়া গেছে। সংশ্লিষ্টদের দায়িত্বে অবহেলা ছিলো বিধায় এ ঘটনা ঘটে থাকতে পারে। জড়িতদের শনাক্ত এবং চোরাই তার উদ্ধারের মতো সুযোগ রয়েছে পুলিশের। ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনার প্রতিরোধে সুপারিশসহ ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ উল্লেখ করে প্রতিবেদন দাখিল করা হয়েছে।”
মামলার বাদী কালীগঞ্জ জোনাল অফিসের ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার (ডিজিএম) কামরুজ্জামান বলেন, ’’মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করেছে বলে জানিয়েছে পুলিশ। মামলার পরবর্তী শুনানির জন্য ২৭ এপ্রিল ধার্য করেছে আদালত। অধিকতর তদন্তের মাধ্যমে ঘটনায় জড়িতদের শনাক্ত এবং মালামাল উদ্ধারের জন্য ওইদিন চুড়ান্ত প্রতিবেদনের বিরুদ্ধে আদালতে নারাজি আবেদন করার প্রস্তুতি চলছে।’’
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা কালীগঞ্জ থানার উপপরিদর্শক (এসআই) ইসলাম মিয়া বলেন, ’’মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হয়েছে। সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি আর কোন মন্তব্য করতে রাজি হননি।’’